আব্দুল্লাহ আল নোমান

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে পুরো পৃথিবী আজ নিস্তব্ধ। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে করোনা ভাইরাসের আবিষ্কার হয়েছিল। তবে ২০১৯ সালে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে কাঁচা মাংসের বাজারে কর্মীর মাধ্যমে প্রথম ছড়ায়। পর্যায়ক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে করোনা ভাইরাস। একটা জ্বলন্ত মোমবাতির উপরে শূন্য কাচের গ্লাস রাখলে যেমন দ্রুতই নিভে যায় ঠিক তেমনি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে পুরো পৃথিবী আজ নিভন্ত। এই যান্ত্রিকতার যুগে গোটা বিশ্ব আজ অসহায়ত্বের চাদরে ঘেরা। প্রতিনিয়ত মানুষ হেরে যাচ্ছে ক্ষুদ্র এক করোনা নামক ভাইরাসের কাছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের মাঝে যেমন আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে তেমনি নানা কুসংস্কার ও ছড়িয়ে পড়েছে। দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। পরিস্ফুটিত আশাগুলো ক্রমাগত নিরাশায় পরিণত হচ্ছে। মানব জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। স্থবির হয়ে যাচ্ছে জনজীবন,শিক্ষাহীন এবং কর্মহীন হয়ে পড়ছে মানুষ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাসের কারণে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশ্বে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের চাকরি হারাতে যাচ্ছে। তাহলে বেকারের সংখ্যাও লাগামহীনভাবে চলতে থাকবে। অপরদিকে নিম্নবিত্ত বা দিনমজুর মানুষের অবস্থা শোচনীয়। শিক্ষা, অর্থনীতি, অবকাঠামো সবকিছুই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে করোনা ভাইরাসের জন্য। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কেউ বা লকডাউনের কষাঘাতে বেছে নিয়েছে শিশুশ্রম। ভয়াবহ সেশনজটের কবলে পড়ে গেছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী তার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১৩ লক্ষ (বাংলাদেশ প্রতিদিন)। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এক বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে যে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশই নিতে পারেনি। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, অপর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক, নগরায়নের পার্থক্য ইত্যাদি প্রাথমিক কারণ বলে মনে করা হয়।। এই ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থীদের বিষয়েও সরকারকে এখনও উদাসীন মনে হচ্ছে।। এছাড়াও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাংস্কৃতিক ব্যবধানের জন্য প্রযুক্তিতে কিছুটা পশ্চাৎপদ। একজন শিক্ষক পাঠদানের বাহিরে ভালো বন্ধু, অভিভাবক কিন্তু অনলাইন ক্লাসে পাঠদান হলেও শিক্ষার্থীরা অন্য দিকগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আমাজনে প্রকাশিত শিক্ষকের বক্তব্য মতে, “একজন শিক্ষকের সবচেয়ে ভালো অনুভূতি হচ্ছে তরুণ শিক্ষার্থীদের নবীনতা দেখে দিন শুরু করা। কিন্তু এই কোভিড-১৯ এর কারণে আজ শিক্ষকরা সেই অনুভূতি থেকে অনেক দূরে।” অনলাইন ক্লাসের নামে অনেক শিক্ষার্থী জড়িয়ে পড়ছে প্রযুক্তির আসক্তিতে-পর্নোগ্রাফি, গেম এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। কিছু বেসরকারি স্কুল অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে লকডাউনের কারণে। হাট-বাজার, মসজিদ-মন্দির, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সবখানে নিষেধাজ্ঞা। লকডাউনে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য দ্রব্যের দাম বাড়িয়েছে; চরম ভোগান্তিতে রয়েছে জনসাধারণ। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা সবখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেও দিনমজুর মানুষের কাছে তা অকল্পনীয়-যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বিলাসিতা মাত্র। চাঙ্গা অর্থনৈতিক দেশগুলো যেখানে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যর্থ, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা ডাঙ্গার কুমিরের মতো। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে কেউ জিতে যাচ্ছে কেউ বা যাচ্ছে হেরে।। বাংলাদেশ যাচ্ছে কোন পথে?? পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এইসব বিষয় নিয়ে সরকারের কোন মাথা ব্যাথা নেই!!তাদের মাথা ব্যাথা হচ্ছে সরকার বিপরীত লোকগুলোকে এই করোনাকালীন লকডাউনের মধ্যেও গণ গ্রেফতার করে স্বীকারোক্তীর নামে নিত্য নতুন কল্পকাহিনীর নাটক সৃষ্টি করে যেনতেনভাবে গদি রক্ষা করা।

এই বিপন্ন জনজীবনে সুস্থ একটা পৃথিবী সকলের একান্ত কাম্য। কিন্তু সুস্থ একটা পৃথিবী কবে হবে সেটা আমি আপনি কেউ জানি না! ততদিনে হয়তো চেনা মুখগুলো আর থাকবে না। প্রানঘাতি করোনা ভাইরাস যেমন প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুকে জানান দিচ্ছে অপরদিকে পুরো পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করছে।

আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউনের কারণে বাতাসে বিষাক্ত নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। অথচ এই বিষয় নিয়েও সরকারের কোন মাথা ব্যাথা নেই বললেই চলে।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মানুষ তাদের জীবন ধারণ পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশ সরকার করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় গত এক বছরে বাস্তবিক কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনাই।। একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানবজাতি আজ গভীরভাবে উপলব্ধি করছে প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটা অসহায়। প্রতিটি ক্ষণ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হলেও আমরা আশাবাদী কোনো একদিন নতুন সূর্য উদিত হবে, চারপাশের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠবে আমাদের পৃথিবী। লকডাউনের নামে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে থাকবে না ধর্মহীন করার প্রচেষ্টার আশংকা এবং নিম্ন -মধ্যবিত্তের মাঝে থাকবে না কোনো আতঙ্কের ছায়া।

লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক,বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। aanoman29@gmail.com