রেজাউল করিম চৌধুরীঃ
আপনার আশপাশে, বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সংস্থার এমন অনেকেই আছে, যারা আপনার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে- আপনি এটা জানেন না, আপনি ওটা জানেন না, সুতরাং আপনার আসলে কোন সক্ষমতা নেই। যেহেতু তাদের কাছে অর্থ আছে, এবং আপনি আশা করেন যে সেই অর্থের থেকে কিছু অংশ হয়তো তারা আপনাকেও দিবে, আপনি তাদের সেসব কথাবার্তার প্রতিবাদ করতে পারেন না, আপনি সেগুলো মেনেও নেন- জেনে বা না জেনে, বুঝে- না বুঝে। একারণে অত:পর আপনি নিজেকে তুচ্ছ ভাবা শুরু করে দিয়েছেন, নিজেকে অনন্যোপায় পরনির্ভরশীল ভাবছেন, এবং তাদের তথাকথিত অনুগ্রহ-সহায়তার জন্য একজন প্রভূভক্তের মতো আচরণ করছেন, হীনমন্যতায় ভুগছেন। অথচ, এটা কোনভাবেই সত্য হওয়ার কথা নয়।

আপনি যদি একজন সফল মা বা বাবা হয়ে থাকেন, তবে আপনি ভালো করেই জানেন যে কিভাবে আপনি আপনার সন্তানকে মানুষ করেছেন। আপনি সবসময়ই তাকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন, তাকে অভয় দিয়ে বলেছেন- তুমি বেশ কিছু বিষয় জান, এবং আরেকটু চেষ্টা করলে তুমি আরও ভাল কিছু করতে পার। আপনি তার সাফল্যের স্বীকৃতি দিয়েছেন, এবং তাকে আরও ভাল করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। মানুষের বিকাশে এটি একটি উত্তম উপায়। আপনি কতবার ব্যর্থ হয়েছেন তাতে কিছু আসে যায় না, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কতবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। আপনি খুব কমই হীনমন্যতা ছড়িয়েছেন, কারণ হীনমন্যতা অধিকতর অগ্রগতির জন্য সাহস জুগাতে বাধা দেয় এবং বিকাশমান মনোভাবকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

একটি গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার ভিত্তিক সমাজ বিকাশ করতেও আমাদের জাতির এমন ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন।

হীনমন্যতা প্রকৃতপক্ষে নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলোতে সক্রিয়-অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন-দূরদর্শী-অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিত্ব বিকাশের বড় বাধা, এই জাতীয় ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন অজ্ঞতা এবং অহংকারপূর্ণ সমাজের পরিবর্তে মত প্রকাশের স্বাধীনতাসমৃদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক এবং সহনশীল সমাজ বিনির্মাণে। আপনি যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাসী হোন, এবং যদি সহনশীলতা আশা করেন, তবে আপনার মধ্যে অন্যের কথা শোনার ধৈর্য্য থাকতে হবে, অন্যকে বোঝার-অন্যকে উপলব্ধি করার মনোভাব আপনার থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা, দাতা সংস্থা বা ধনী মানুষের কাছ থেকে বরং এর বিপরীতধর্মী নানা কথা আপনাকে শুনতে হবে। আপনাকে শুনতে হবে যে, আপনি কিছুই জানেন না। যদি ঐ সংস্থার সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি, বা ধনী ব্যক্তিটি অহংকারী হয় তবে আপনাকে শুনতে হবে যে- আপনি বরং তাকে হুমকি দিচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে এটি আপনার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার একটি অপকৌশল মাত্র।

কেবল উন্নয়ন সহায়তা খাতই নয়, এ জাতীয় প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও। উন্নয়ন সহায়তা খাতে, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোতে আমাদের প্রচুর ভালো বন্ধু রয়েছে, তবে তাদের কারো কারো মধ্যে এরকম নেতিবাচক মনোভাব বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে এটি ঔপনিবেশিক এবং স্বৈরাচারী মনোভাব। ইতিহাস প্রমাণ করে যে, সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষ, স্থানীয় এনজিও এবং সিএসও কর্মীদের মধ্যে হীনমন্যতা ছড়িয়ে দিয়ে ঔপনিবেশিক ও স্বৈরাচারীরা তাদের অযৌক্তিক শক্তি-ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছে।

দাতা সংস্থা, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক এনজিওসমূহের প্রধান কার্যালয়ের বিদেশি কর্মকর্তাদের মধ্যে স্থানীয় এনজিও এবং সিএসওগুলিকে উৎসাহিত করার ও ক্ষমতায়িত করার ইচ্ছা-আগ্রহ-প্রচেষ্টা অবলোকন করার দারুণ কিছু অভিজ্ঞতা আমার আছে। তবে দেশীয় পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়ই এর বিপরীত অবস্থা দেখা যায়- দেশীয় পর্যায়ে দাতা সংস্থা, জাতিসংঘ, আইএনজিওর দেশি-বিদেশি কর্মীরা সবসময়ই আপনাকে বলবে যে, আপনার দক্ষতা-সক্ষমতা নেই, আপনার ক্ষমতা সামান্য এবং আপনি খুব কমই জানেন। আপনি যদি তাদের সমালোচনা করেন তবে তারা আপনাকে এড়িয়ে যাবে বা তারা আপনাকে হুমকি দেবে। আমি মনে করি এটি আপনার ক্ষতি করার প্রয়াস, যাতে তারা চিরদিনই আপনাকে আজ্ঞাবহ করে রাখার সুযোগ পায়।

একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বা উন্নয়নের গণতান্ত্রিক মালিকানার জন্য আমাদের গঠনমূলক সমালোচনায় সক্ষম- অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন। পাশাপাশি আমাদের সহনশীলতার সংস্কৃতি লালন করতে হবে, অন্যের কথা ধৈর্য্যসহকারে শোনার অভ্যাস থাকতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনাকে প্রশংসা করার জন্য আন্তরিক মনোভাবের সংস্কৃতি খুবই প্রয়োজন।

-রেজাউল করিম চৌধুরী
নির্বাহী পরিচালক
কোস্ট ফাউন্ডেশন।