সিবিএন ডেস্ক:

বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক কী কর্মহীন থাকবে? তাদের কর্মসংস্থানের কী হবে? রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কেউ কেউ বলছেন, রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান করা উচিত। বসিয়ে না রেখে তাদের দিয়ে হাতের কাজ করিয়ে আয় করানো সম্ভব। আবার কেউ বলছেন, এমন কিছু করা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ, তখন তাদের প্রত্যাবাসন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তারা নতুন নতুন দাবি তোলা শুরু করবে, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা এখন ১১ লাখেরও বেশি। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত হয়ে তারা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর। তখন তাদের ওপরে বড় ধরনের নিপীড়ন শুরু হলে সাত লাখ ৪১ হাজার ৮৪১ জন রোহিঙ্গা নাগরিক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। কবে নাগাদ তারা নিজ দেশে ফিরে যাবেন, সেটাও অনিশ্চিত। সরকার ছাড়াও দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থা তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

আশ্রয়ন-৩ প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলো থেকে অস্থায়ীভাবে ভাসানচরের শেল্টারগুলোতে স্থানান্তরের কাজ চলমান রয়েছে। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর থেকে স্থানান্তর কার্যক্রম শুরু হয়। ছয় ধাপে এ পর্যন্ত ১৮ হাজার ৩৪৭ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এরমধ্যে চার হাজার ৩৯৫ জন পুরুষ, পাঁচ হাজার ৩০৬ জন নারী এবং ১২ বছরের নিচের আট হাজার ৬৪৬টি শিশু রয়েছে। এ মাসের (এপ্রিল) মধ্যেই ভাসানচরে রোহিঙ্গার সংখ্যা ২২ থেকে ২৩ হাজারে উন্নীত হওয়ার কথা রয়েছে।

ভাসানচরে বর্তমানে স্বল্প পরিসরে ৩০০ রোহিঙ্গা শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে একটি এনজিও। আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের কাছে তাদের প্রধান দাবিও ছিল রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করা। এছাড়া সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের হস্তশিল্প, মৎস্য চাষ, মুরগি পালনসহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দু’টো জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু তারা দিনের পর দিন একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে এখানে থাকছেন। কবে ফেরত যেতে পারবেন সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। এমন একটি অবস্থায় তাদেরকে লেখাপড়া এবং কাজে যুক্ত করা জরুরি। এটা সরকারি উদ্যোগ কিংবা কোনও এনজিওর মাধ্যমে হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পের ভেতরেই তাদের উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের উৎপাদিত পণ্য দেশে ও দেশের বাইরে বাজারজাত করা সম্ভব। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছোট ছোট গার্মেন্ট কারখানা তৈরি করা যেতে পারে। সেখানে যেটা উৎপাদিত হবে, সেটা শুধুমাত্র বিদেশে রফতানি করা হবে। অনেক দাতা সংস্থা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে রাজি থাকার কথা। এছাড়াও ক্যাম্প এলাকায় তাদের বনায়ন কর্মসূচিতে লাগানো যেতে পারে। সেখানে সারা দেশের জন্য গাছের চাড়া উৎপাদন করা যায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প হতে পারে তাদের দিয়ে। মশল্লা ভাঙানোর কারখানা হতে পারে। সেলাইসহ হাতের কাজ শিখিয়ে কর্মক্ষম করা যেতে পারে।’

নূর খান বলেন, ‘আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তাদের লেখাপড়া। মিয়ানমারের কারিকুলামে হোক আর ইংলিশ কারিকুলামে হোক, তাদের লেখাপড়াটা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, একটা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যাক, সেটা নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়। ধ্বংস হওয়ার দু’টি পথ আজকের আধুনিক যুগে আছে। একটা হচ্ছে তাকে হত্যা করা, অথবা তাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা।’

রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আমরা রিফিউজি স্ট্যাটাস দেইনি বহুবিধ কারণে। আর তাদের যদি বাংলাদেশে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তারা আরও দাবি-দাওয়াসহ নানা ইস্যু শুরু করবে। তারা মনে করবে এটা তাদের অধিকার। নাগরিক অধিকার। নাগরিকদের কিন্তু অনেক ধরনের অধিকার থাকে। শুধু খাওয়া পরার অধিকার নয়। তারা তো সেটা শতভাগ পাচ্ছে। মানুষের যেসব মৌলিক চাহিদা সবইতো তাদের দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় সরকার সেগুলো দিচ্ছে। ওই এলাকায় আমাদের বাঙালি নাগরিকরা আছে, তাদের চেয়েও তারা ভালো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। আর সেই জায়গায় তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এটা দেশের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনবে, যদি এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়। এটা মোটেই ঠিক হবে না। উপরন্তু, তাদের আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।’

এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘তারা নির্যাতিত হয়ে এসেছেন এটা ঠিক। কিন্তু তাদের সামনে রেখে এদের ভেতর থেকেই এখানে বহুবিধ অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, চোরাচালানি, মাদক ব্যবসায়ী সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সময় ধরাও কঠিন। তাদের মধ্যে কারা এসব করছে। আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা তখন আরও জোরেশোরে চালাবে। স্থানীয় বাংলাদেশিদের তারা উৎখাত করে দেবে। এখনইতো তারা হুমকি দিচ্ছে নানাভাবে। সংখ্যায় তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চেয়েও দ্বিগুণ। তাদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া হবে আত্মঘাতী।’

রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্‌ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘এটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। আমি হচ্ছি মাঠ পর্যায়ের ম্যানেজার। আমি সরকারের সিদ্ধান্ত ও পলিসিকে ম্যানেজ করি ও সমন্বয় করি। তবে বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো সরকারের কাছে আছে। নিশ্চয়ই তারা এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে সব কিছুরই পজিটিভ ও নেগেটিভ সাইড আছে। সবগুলো বিষয় চিন্তা করেই সরকার সিদ্ধান্ত দেবেন। আর আমাদের দেশের তো একটা নিয়ম কানুন আছে। তাছাড়া শুরু থেকেই তাদের ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।’ -বাংলা ট্রিবিউন