মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী 

 

কক্সবাজার জেলায় করোনা সংক্রামণ আশংকাজনক ভাবে বাড়ছে। অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে সার্বিক করোনা পরিস্থিতি। গত ৮ দিনে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে নমুনা টেস্ট করে কক্সবাজার জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৬০ জন রোগীর করোনা শনাক্ত করা হয়েছে। তারমধ্যে, ১ এপ্রিল ৪৮ জন, ২ এপ্রিল ২০ জন, ৩ এপ্রিল ৪৯ জন, ৪ এপ্রিল ৫৫ জন, ৫ এপ্রিল ৮১ জন, ৬ এপ্রিল ৭২ জন, ৭ এপ্রিল ৫৭ জন এবং ৮ এপ্রিল ৯৪ জন। গত ৮ দিনে মোট ৪৭৬ জনের দেহে করোনা শনাক্ত করা হয়েছে। এভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে কক্সবাজারে করোনা সংক্রামণ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশংকা পোষন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সার্বিক করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধ কার্যক্রম সমন্বয়হীন হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। আক্রান্তের সাথে মৃত্যুও থেমে নেই। গত ৮ এপ্রিল পর্যন্ত জেলায় মোট ৮৮ জন করোনা রোগী মারা গেছে। এরমধ্যে ১০ জন রোহিঙ্গা শরনার্থী। আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার ১’২৭%।

এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণে করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধে সক্রিয়ভাবে জড়িত অভিজ্ঞ একজনের মতামত হলো-হোম আইসোলেসনে যেসব করোনা রোগী আছেন, তারা কতটুকু আইসোলেসন মানছেন-তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। এটা সুষ্ঠু পর্যবেক্ষন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কঠোর তদারকি থাকতে হবে। কারণ, দেহে করোনা শনাক্ত হওয়া প্রায় ৮১ শতাংশ রোগী হোম আইসোলেসনে রয়েছেন। অনেক রোগী ‘আইসোলেসন’ কি, আদৌ সেটাও জানেনা, বুুুঝেনা। আক্রান্তরা অবাধে মিশে যাচ্ছে পরিবারের সদস্য ও গণমানুষের সাথে, পাবলিক স্পেসে। নিজ নিজ পেশাতে, কর্মস্থলে অন্যান্যদের সাথে মিশে কাজ করছে। আক্রান্তদের বেশির ভাগের করোনার উপসর্গ না থাকায় সাধারণ লোকজন করোনা রোগীকে চিহ্নিত করতে পারছেন না। কে করোনা আক্রান্ত, কে করোনা আক্রান্ত নন, সেটা বুঝতে পারছেন না কেউ। করোনা সংক্রামণের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা একেবারে কমে গেছে। করোনা শনাক্ত হওয়া রোগীর উপসর্গ না থাকা বা অসুস্থ না হওয়া মানেই, ল্যাবের টেস্ট রিপোর্ট ভূল মনে করে অনেকেই। অনেকে করোনা নামক রোগটাও পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চায়না।

আবার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও আগের মতো আক্রান্তদের বাড়ি, অবস্থান চিহ্নিত করে ‘লকডাাউন’ করে না দেওয়ায় এ বিষয়ে উদাসীন হয়ে উঠেছেন সংক্রামিতরা। আক্রান্ত রোগীর সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনের এসব নিয়ে আগের মতো কোন মাথা ব্যাথাও নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে আগের মতো খুব একটা তৎপর নয়। কোথাও স্বাস্থবিধি ও সরকারি নির্দেশনার কোন বালাই নেই।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজার জেলায় ৮ এপ্রিল কোভিড শনাক্ত হওয়া অসুুস্থ রোগী আছে মোট ৭৪৪ জন। এরমধ্যে মাত্র ১৩৭ জন প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেসনে আছে। বাকী ৬০৭ জন করোনা রোগী নিজ নিজ দায়িত্বে হোম আইসোলেসনে রয়েছে। হোম আইসোলেসনে থাকা ৬০৭ জনের মধ্যে প্রায় ২ শত করোনা শনাাক্ত হওয়া রোগী কোথায় আছে, কেমন আছে, কিভাবে আছে, তার কোন হদিস নেই। নমুনা পরীক্ষার সময় দেওয়া ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বরে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। জেলায় করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধে কর্মরত একজন গবেষক এ বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন। মূলত এরাই বেশী সংক্রামণ ছড়াচ্ছে। যা নিয়ন্ত্রণে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ বিশেষজ্ঞের মতে, আক্রান্তদের সম্ভব হলে শতভাগ, নাপারলে অধিকাংশকে সরকারী উদ্যোগেই প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেসনে নিয়ে আসা দরকার। যারা ক্ষুদ্র অংশ হোম আইসোলেসনে থাকবেন, তাদের যথাযথ সম্পূর্ণ আইসোলেসন সুনিশ্চিত করতে হবে সরকারি উদ্যোগে। প্রয়োজনে এজন্য আইন প্রয়োগ করতে হবে কঠোরভাবে।

কক্সবাজার জেলায় কাগজে কলমে (!) প্রায় সাড়ে ১৪ শত করোনা আইসোলেসন বেড রয়েছে। এরমধ্যে, রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ১৩ টি SARI আইসোলেসন সেন্টারে ৯৬৪ টি বেড রয়েছে। আরো ৩ টি SARI আইসোলেসন সেন্টার চালুর অপেক্ষায় আছে রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের অভ্যন্তরে। যেখানে আরো প্রায় ২ শত বেড আইসোলেসন থাকবে।এগুলো সব জাতি সংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আইএনজিও, এনজিও দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় সেখানে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও বেশী। রামু ও চকরিয়া ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল এবং ডুলাহাজারা খৃষ্টান মেমোরিয়াল হসপিটাল এ ৩ টিতে রয়েছে আড়াইশত আইসোলেসন বেড। কক্সবাজার শহরের পশ্চিম বাহারছরা ফ্রেন্ডস SARI আইসোলেসনে রয়েছে, ১ শত বেড। সদর উপজেলা ছাড়া বাকী ৬ টি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের করোনা ওয়ার্ডে রয়েছে ১০ করে মোট ৬০ টি আইসোলেসন বেড। কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ, ৮ টি এইসডিইউ এবং চাদের উপর তৈরি করা ৫০ বেডের আইসোলেসন ‘রেড জোন’। আক্রান্ত হওয়া রোগীদের আইসোলেসন নিশ্চিত করার জন্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে হলেও এসব আইসোলেসন সেন্টার গুলোতে নিয়ে আসতে হবে। যে উপজেলার রোগী সে উপজেলার নিকটস্থ আইসোলেসন সেন্টারে নিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দিতে হবে। অপেক্ষাকৃত অস্বচ্ছল রোগীদের ফ্রী চিকিৎসা সুবিধা, পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দিতে হবে। এক্ষেত্রে, সরকারী সহায়তার পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সহায়তার ২৫ শতাংশ অর্থ দিয়েও এসব জরুরী ও মানবিক কাজ গুলো করা যায়।

এছাড়া, কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক টিম আবার কন্ট্রাক ট্রেসিং শুরু করলেও তা আরো জোরদার করতে এবং কন্ট্রাক ট্রেসিংকে আরো ব্যাপৃত করতে হবে। বাড়াতে হবে আরো স্বেচ্ছাসেবক। জেলার অন্যান্য জায়গাতেও জরুরী ভিত্তিতে কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের মতো কন্ট্রাক ট্রেসিং শুরু করতে হবে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে আরো সক্রিয় হতে হবে। কক্সবাজার জেলায় করোনা সংক্রামণ ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষককে সময় থাকতে আরো বেশী তৎপর হওয়ার ও জরুরী পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন একাাধিক অভিজ্ঞজন।

প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেসন সেন্টার বাড়ানো পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০২০ সালে গড়ে তোলা সাগরপাড়ের হোটেল সী প্রিন্সেস এর মত আবাসিক হোটেল, রামু’র নব নির্মিত বিকেএসপি ভবনের মতো দালানকে সাময়িকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেসন সেন্টার করতে হবে জরুরীভিত্তিতে।

আবার কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের একজন দায়িত্বশীল চিকিৎসক জানান, ২৫০ বেডের এ হাসপাতালে সবসময় প্রায় ৪ শত রোগী ভর্তি থাকে। করোনা আক্রান্তদের জরুরী চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ক্রিটিকাল রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে। একেতো চিকিৎসক স্বল্পতা, তার উপর করোনা রোগীর চাপে তারা রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছেন। জাতি সংঘের সংস্থা আইওএম এর সহায়তায় ৩ জন চিকিৎসক নিয়ে জেলা সদর হাসপাতালের চাদের উপরে থাকা করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ‘রেড জোন’ টি গত ৬ এপ্রিল হতে আবার চালু করা হয়েছে। করোনা আক্রান্ত রোগীরা জেলা সদর হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে চাচ্ছেন বেশী। এ অবস্থায় অত্যাধিক রোগীর চাপে আছেন-কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ হাসপাতালটি জেলাবাসীর জন্য সর্বোচ্চ আস্থা ও নির্ভরতার জায়গা। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক সংকট থাকলেও সর্বোচ্চ সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এখানেই বেশী। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই, ১০ টি ভেন্টিলেটর সমৃদ্ধ আইসিইউ, ৮ টি এইসডিইউ আছে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। দেশে জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল গুলোর মধ্যে চিকিৎসা সুবিধা মনে হয়, এ হাসপাতালেই সর্বোচ্চ। তাই ক্রিটিকাল করোনা রোগীদের জন্য জেলা সদর হাসপাতালের কিছু ভেন্টিলেটর বেড সবসময় ফ্রী রাখা দরকার। তাতে হয়ত করোনা মহামাারীতে আপদকালীন সংকট ও জরুরী অবস্থা সামলানো যাবে। ক্রিটিকাল ও ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দিতে হবে, এমন রোগীরা যাতে জরুরী চিকিৎসা সেবা পায়।

এদিকে, ৯ এপ্রিল পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ২৯ জনে পৌঁছেছে। জেলায় করোনা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে শুধু সদর উপজেলার রোগী রয়েছে ৩৪৪৫ জন। যা জেলার মোট আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসের সাথে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের সমন্বয়হীনতাও লক্ষ্য করা গেছে। জেলা সদর হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী মারা গেলে তার হিসাব কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে পৌঁছাতে কমপক্ষে ২ দিন লাগে। এজন্য, ৮ এপ্রিল পর্যন্ত সিভিল সার্জন অফিসের মতে, কক্সবাজার জেলায় করোনা আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা ৮৫ জন। আর একই সময়ে কক্সবাজারে করোনা রোগী নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজনের মতে, ডকুমেন্টারি সংখ্যা মোট ৮৮ জন। এ সমন্বয়হীনতাও কাটিয়ে উঠতে হবে।

কক্সবাজারে করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধে এসব বিষয় কক্সবাজারের দায়িত্ব প্রাপ্ত, দরিয়ানগরের ভুমিপুত্র, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, কক্সবাজারের ৫ জন সম্মানিত সংসদ সদস্য, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো: মামুনুর রশীদ, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্ণধার, সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. রফিকুস সালেহীন, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. অনুপম বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম, জেলা বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহবুবুর রহমান সহ সংশ্লিষ্ট সকলেই পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। যাতে সময় থাকতে কক্সবাজার জেলায় করোনা সংক্রামণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

(লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।)