হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর:
মাওলানা আব্দুচ্ছালাম কুদছী রহ. সংগ্রামুখর জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের নাম। তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ আলিম, আদর্শ শিক্ষক, বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক, মানবতার একনিষ্ঠ সেবক, বিচক্ষণ ইসলামী রাজনীতিবিদ, তাত্ত্বিক লেখক, ঈমানী আন্দোলনের একজন সাহসী নেতা, বাতিল অপশক্তির মোকাবিলায় রাজপথের লড়াকু সৈনিক ও নির্ভীক সিপাহসালার।নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইসলামী ছাত্রসমাজ যাঁর কাছে ছিল অতিপ্রিয় দু’টি নাম। সংগঠন দু’টির কর্মতৎপরতার গতিশীলতায় আনন্দে যাঁর মন ভরে উঠতো। উভয় সংগঠনকে নিয়ে তিনি ভাবতেন। আমাদের উৎসাহিত ও সহযোগিতা করতেন, দিক-নির্দেশনা দিতেন, অনুপ্রেরণা যুগাতেন। একটু অবকাশ পেলেই যিনি নিজ চেম্বারে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে আপ্যায়িত করতেন, সাংগঠনিক খবরাখবর নিতেন। আমরাও প্রায় প্রতিদিন ছুটে যেতাম যে অভিভাবকের মমতাপূর্ণ সান্নিধ্যে। আমাদের সেই অকৃত্রিম অভিভাবক মাওলানা আব্দুচ্ছালাম কুদছী রহ. আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেলো। হুজুরের শুণ্যতা অনুভূতই হচ্ছে শুধু। সেই শুণ্যতা পূরণ হওয়ার নয়। হুজুরের কথা মনে পড়তেই হৃদয়রাজ্যে শোকের প্লাবন বয়ে যায়। এখনো মাঝে -সাঝে যাই হুজুরের স্মৃতিবিজড়িত দারুসসালাম কমপ্লেক্সে। কিন্তু আগে সেখানে গেলে অনুভূত হতো প্রশান্তি আর এখন অনুভূত হয় হৃদয়ফাটা আর্তনাদ। চোখের পানি সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৮ সালের ২৯ মার্চ (বৃহস্পতিবার) তিনি লিংক রোড থেকে মোটর সাইকেল যোগে রামু ফেরার পথে চট্টগ্রামগামী শ্যামলীমা নামক বেপরোয়া একটি গাড়ী পিছন দিক থেকে তাকে ধাক্কা দিলে মোটর সাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে তাঁর ডান পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ মারাত্মক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে গুরতর আহত হন। উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হয়ে ট্রিটমেন্ট হসপিটাল নামের এক বেসরকারি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হয়। দেশ-বিদেশের অসংখ্য প্রিয়জনেরা হুজুরের সুস্থতা ও দীর্ঘ জীবন কামনায় কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ করেন আল্লাহ তা’আলার দরবারে। কিন্তু মহান আল্লাহর মনশা ছিল তাঁর প্রিয় বান্দাহকে নিয়ে যাওয়ার। ঠিক তা-ই হলো। চট্রগ্রামে চিকিৎসাধীন, অবস্থায় (দূর্ঘটনার ১০ দিনের মাথায়) ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল ( শনিবার) ভোর ৫ টা ২০ মিনিটে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদেরকে কাঁদিয়ে তিনি চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
অত্যন্ত সজ্জন, প্রাণবন্ত, কর্মোদ্যমী, নিরহঙ্কারী, বন্ধুবৎসল এ আলেমেদ্বীনের ইন্তেকালের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই কক্সবাজারের সর্ব মহলে নেমে এসেছিলো শোকের ছায়া। একই দিন বিকাল সাড়ে ৫ টায়, তাঁরই হাতে সাজানো দ্বীনি বাগিচা রাজারকুল পশ্চিম সিকদার পাড়া আসমা ছিদ্দিকা র. মাদ্রাসা মাঠে বিশাল নামাজে জানাযা শেষে মরহুমকে দাফন করা হয়। ইন্তেকালের সময় তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়েসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে যান।
বরেণ্য এ আলেমেদ্বীন একাধারে ইসলামী শিক্ষা বিস্তার, দ্বীনি দাওয়াত, সমাজ সংস্কার, মানবসেবা, আদর্শিক ধারায় লেখালেখি, সততার সাথে ব্যবসা -বাণিজ্যসহ বহুমুখী কল্যাণমূলক কর্মতৎপরতায় নিষ্ঠা ও সুনামের সাথে অনন্য অবদান রেখে গিয়েছেন।
ছাত্রজীবনে তিনি বিভিন্ন স্তরে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। আল-জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া থেকে দাওরায়ে হাদীস পাশ করে ফিক্হ নিয়েও তিনি বিশেষায়িত পড়াশোনা করেন। কর্মজীবনে ইসলামী শিক্ষা প্রসারের ব্রত নিয়ে কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রামু রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসায় দ্বীনি শিক্ষাদানের খেদমতে আত্মনিবেদন করেন। দীর্ঘকাল শিক্ষকতার গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে। এক পর্যায়ে তিনি পবিত্র সৌদি আরব যাত্রা করেন। হালাল জীবন- জীবিকার তাগিদে সেখানেও বেশ কিছুকাল ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। দেশে ফিরেও তিনি আজীবন ব্যবসার মাধ্যমে হালাল জীবন- জীবিকা নির্বাহ করেন। রামু বাইপাসস্থ দারুচ্ছালাম কমপ্লেক্স তাঁরই গড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে তিনি আপন উস্তায মাওলানা আইয়ুব আনছারী রহ. কে নিয়ে রাজারকুল আসমা ছিদ্দিকা র. মাদ্রাসা ও এতিমখানা নামক একটি দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আমৃত্যু এ মাদ্রাসার পরিচালক হিসেবে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পাশাপাশি তিনি বহু মসজিদ -মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, নির্মাণ ও পরিচালনায়ও সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি ছাত্রজীবনে আকাবিরে দেওবন্দের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষে ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সাথে যুক্ত হন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি এ সংগঠনের রামু উপজেলা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন৷ সেই সাথে তিনি সংগঠনটির জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলা প্রচার সম্পাদক, রামু প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা মক্কার ধর্মবিষয়ক সম্পাদক। রামু বাইপাস স্টেশন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অগ্রণী ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি আমৃত্যু এ মসজিদের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি সর্বসাধারণের মাঝে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে বাইপাস স্টেশনে একটি ইসলামী সম্মেলনও চালু করে যান। তিনি ছিলেন কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রামু লেখক ফোরামের উপদেষ্টা । দৈনিক দৈনন্দিন পত্রিকায় বেশ কিছুকাল “ইসলাম ও জীবন” বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। “মিরাজুন্নবী স.” নামে একটি গবেষণাধর্মী পুস্তিকাও রচনা করেন তিনি। এছাড়াও ইসলাম ও সমসাময়িক অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি কলম ধরেছেন। অনৈসলামিক ও অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধেও তিনি ছিলেন এক আপোষহীন সংগ্রামী নেতা।
তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই; তবে আছে তাঁর রেখে যাওয়া বহু অমর কীর্তি। যে কীর্তগাঁথায় তিনি থাকবেন চির অম্লান ও অবিস্মরণীয়।
আল্লাহ আমাদের মরহুম উস্তাযকে জান্নাতুল ফিরদাউসের আ’লা মকাম নসীব করুন। আমিন।