তাওহীদুল ইসলাম নূরী:
তলাবিহীন ঝুড়ির যে বাংলাদেশ ছিল, সেই বাংলাদেশ আজ অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামরিকসহ সব দিক মিলিয়ে উন্নত দেশ হওয়ার পথে। দিন দিন উন্নত হচ্ছে আমাদের জীবন ধারা। কিন্ত, দেশ যখন বিশ্ব মানচিত্রে উন্নত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সেখানে দেশের কতিপয় ব্যবস্থাপনা মরণ দানবের মত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের যোগাযোগ ও পরিবহন খাত সেখানে অন্যতম। প্রতিদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম এবং টেলিভিশনের সংবাদ আমাদের যেটা জানান দিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে মৃত্যুর হার বৈশ্বিক এমনকি আঞ্চলিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, উচ্চ আয়ের রাষ্টগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক নৈপুণ্য প্রদর্শন করা রাষ্ট্রগুলোর পাঁচ গুণ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে থাকে বাংলাদেশের মানুষ।

ব্যাপকহারে বেড়ে চলছে সড়ক দুর্ঘটনা। একটা দিনও বাদ না গিয়ে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংগঠিত দুর্ঘটনাগুলোতে আহতের পাশাপাশি নিহতের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। দেশের প্রথম সারির একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতিদিন সারাদেশে গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৫০ জন আহতের পাশাপাশি নিহতের সংখ্যা ৭ জন। যেটার পরিমাণ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে ছাড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে, একটি গবেষণা সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় চব্বিশ হাজারের (২৪০০০) বেশী লোক প্রাণ হারায়। সে হিসাবে সড়ক দূর্ঘটনায় দৈনিক নিহতের সংখ্যা ৬৬ জন। এই যে একসময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আমাদের আজকের অগ্রযাত্রা, সেখানে ঐ দৈনিকের রিপোর্ট এবং গবেষণা সংস্থাটির প্রতিবেদন নি:সন্দেহে অন্তরায়। যদিও বেসরকারি সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) দাবি করে, সড়ক দুর্ঘটনা এবং এতে মৃত্যুর হার আগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে।

অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালকদের খামখেয়ালিপনা, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক ব্যবস্থার ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনা, অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের গতি সর্বোপরি এখনও পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সড়কের বেহাল দশা ক্রমবর্ধমান এই সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। উন্নত দেশে যেখানে পরিবহন বিভাগে শিক্ষিত,দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক নিয়োগ করা হয় সেখানে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, চার ভাগের তিন ভাগেরও বেশী চালক অশিক্ষিত,অদক্ষ ও প্রশিক্ষণবিহীন। তাদের এই দুরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতার অভাবেই প্রতিদিন সড়কে ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। পুলিশের অভ্যন্তরীণ এক পরিসংখ্যান মতে, দেশের ৯০.৬৯ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যই অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালকগুলো দায়ী।
ওভারটেকিং কিংবা আগে যাওয়ার প্রবণতা, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইও সড়ক দূর্ঘটনার অন্যতম কারণ। পরিসংখ্যান বলছে, ৮৬.৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনার পিছনেই চালকদের বেপরোয়া গতি দায়ী। আর, ওভারটেকিং এর কারণেও রেকর্ড সংখ্যক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও পর্যন্ত সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা সকলের কাছে জানা। যদিও, বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে সড়ক অবকাঠামো আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও নজরদারির অভাবে সড়ক পথে দুর্ঘটনা থামছে না।

সড়ক দুর্ঘটনারোধ এবং সড়কে শৃঙ্খলার জন্য ২০১৯ সালে সড়ক আইন পাশ করে সরকার। প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও সেই আইনটি এখনো একদিকে যেমন কার্যকর হচ্ছে না, তেমনি বাতিলও হচ্ছে না। যদিও, আইনটি পাশের পর মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। তবুও সড়ক দুর্ঘটনার মিছিল যেন কিছুতেই থামবার নয়। ফিরে নি সড়কে কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলাও। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসাটা অরণ্যরোদন হয়েই দাঁড়িয়েছে।
চালক নিয়োগে সতর্কতা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং না করা, ট্রাফিক সংকেত মানা, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং না করা এবং লাইসেন্সবিহীন চালকদের জনসম্মুখে কঠোর শাস্তির বিধান কার্যকরের পাশাপাশি এখনও পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সকল সড়কগুলো অবহেলিত আছে সরকার সেখানে সু নজর দিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট সড়কগুলো সম্প্রসারণ করলে এবং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও নজরদারি দিলে সড়ক দুর্ঘটনা রেকর্ড সংখ্যক পরিমাণে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা করা যায়।

লেখক :
তাওহীদুল ইসলাম নূরী
আইন বিভাগ (অধ্যয়নরত)
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম
গ্রামের বাড়ি: শাহারবিল সদর, চকরিয়া, কক্সবাজার।