সিবিএন ডেস্ক: জর্ডানের সাবেক যুবরাজ প্রিন্স হামজা বিন হুসেইন এক ভিডিও বার্তায় তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে বলে জানানোর পর দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী আয়মান সাফাদি দাবি করেছেন, প্রিন্স হামজা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।

প্রিন্স হামজার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে এক সংবাদ সম্মেলনে জর্ডানের উপ-প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রিন্স হামজা ‘বিদেশি শক্তির’ সঙ্গে মিলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

প্রিন্স হামজা জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর সৎ ভাই।

ভিডিও বার্তায় প্রিন্স হামজা বিন হুসেইন। ছবি : সংগৃহীত

উপ-প্রধানমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেন, প্রিন্স হামজা সরকারের বিরুদ্ধে উপজাতীয় নেতাদের একাট্টা করার চেষ্টা করছিলেন। এ ব্যাপারে অনেক দিন ধরেই তদন্ত চলছিল এবং ব্যাপারটি আদালতে তোলা হবে বলেও সাফাদি জানান।

এর আগে প্রিন্স হামজার মা যুক্তরাষ্ট্র বংশোদ্ভুত রানি নূর এক  টুইট বার্তায় বলেন, ‘অসৎ অপপ্রচারের শিকার সবাই ন্যায়বিচার পাবে এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে’—তিনি সে প্রার্থনাই করছেন।

উপ-প্রধানমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেন, প্রিন্স হামজার স্ত্রী প্রিন্সেস বাসমাকে প্লেনে করে জর্ডানের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্যএকটি বিদেশি নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আয়মান সাফাদি সংস্থাটির নাম বলেননি। তিনি জানান, আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে প্রিন্স হামজাকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাতে নেতিবাচক সাড়া দেন।

তবে, এখনও প্রিন্স হামজার সঙ্গে ‘আলোচনা চলছে’ বলে আয়মান সাফাদি জানান।

প্রিন্স হামজাকে গৃহবন্দি করার পাশাপাশি মোট ১৬ জনকে গত শনিবার আটক করা হয়, যাঁদের মধ্যে বাদশাহ আবদুল্লাহর একজন উপদেষ্টাসহ রাজপরিবারের একজন সদস্য রয়েছেন।

উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের আটক করাকে এক ‘কথিত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে সম্পর্কিত’ বলা হচ্ছে।

বিবিসি জানিয়েছে, সম্প্রতি প্রিন্স হামজা কয়েকজন আদিবাসী  নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, যাদের কয়েকজনের কাছ থেকে তিনি সমর্থন পেয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রিন্স হামজা অবশ্য কোনো রকম অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন না।

প্রিন্স হামজা তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে বিবিসির কাছে পাঠানো এক ভিডিওতে তাঁর দেশের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও হয়রানির অভিযোগ আনেন।

ভিডিও বার্তায় কী বলেছেন প্রিন্স হামজা?

গত শনিবার রেকর্ড করা ভিডিওতে প্রিন্স হামজা দাবি করেন, জর্ডানের সেনাপ্রধান তাঁকে জানিয়েছেন যে, তিনি বাড়ি থেকে বের হতে পারবেন না, এবং লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না।  কারণ, তিনি এমন কিছু বৈঠকে অংশ নিয়েছেন যেখানে সরকার ও বাদশাহর সমালোচনা করা হয়েছে।

অবশ্য, প্রিন্স হামজা নিজে সমালোচনা করেছেন এমন কোনো অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়নি।

প্রিন্স হামজা বলছেন, গত ১৫-২০ বছরে জর্ডানের প্রশাসন যেভাবে ভেঙে পড়েছে, সরকার কাঠামোয় যে অদক্ষতা ও দুর্নীতি দেখা গেছে- তার জন্য তিনি দায়ী নন। তিনি বলেন, ‘জনগণ যে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে- তার জন্যও আমি দায়ী নই।’

প্রিন্স হামজা আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে, কেউ কথা বলতে পারে না, নিগ্রহ-হুমকি-হয়রানি-গ্রেপ্তার শিকার না হয়ে কেউ কোনো মত প্রকাশ করতে পারে না।’

প্রিন্স হামজা বলছেন, তাঁর সব কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি ও তাঁর পরিবারকে রাজধানী আম্মানের বাইরে আল-সালাম প্রাসাদে গৃহবন্দি করা হয়েছে এবং তাঁর যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত করে দেওয়া হয়েছে।

ভিডিওতে প্রিন্স হামজা আরও বলেন, দেশে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই গোপন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্কে থাকতে হয়।

বাদশাহ আবদুল্লাহর প্রতি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সমর্থন

এরই মধ্যে মিসর, তুরস্ক ও সৌদি আরবের মতো আরব বিশ্বের আঞ্চলিক শক্তিগুলো জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে।

ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের লড়াইয়ে মিত্র দেশ জর্ডান। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে বাদশাহ আবদুল্লাহকে একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করে তাঁর প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে।

জর্ডানের প্রাকৃতিক সম্পদ কম এবং তাদের অর্থনীতি কোভিড-১৯ মহামারির কারণে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া থেকে বিপুল শরণার্থীও জর্ডানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

রাজপরিবারের ভেতরে উত্তেজনা

জর্ডানি সাংবাদিক রানা সোয়েইসের বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, বেশ কিছুদিন ধরেই রাজপরিবারের ভেতরে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

রানা সোয়েইস বলেন, ‘সাবেক যুবরাজ হামজা জনপ্রিয় বলে পরিচিত। তাঁর সঙ্গে বাদশাহ হুসেইনের চেহারার অনেক মিল আছে। তিনি স্থানীয় উপজাতিগুলোর মধ্যেও জনপ্রিয়।’

জর্ডানে করোনার মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশটির শক্তিধর গোয়েন্দা সংস্থাকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল এবং এজন্য মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এর সমালোচনাও করেছিল।

তবে জর্ডানে উচ্চস্তরের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের ঘটনা খুবই বিরল।

বিবিসির বিশ্লেষক ফ্র্যাংক গার্ডনার বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজপরিবারের এই সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

ফ্র্যাংক গার্ডনার বলেন, দেশটির অর্থনীতি কোভিড মহামারির আগে থেকেই খারাপ অবস্থায় ছিল। সেখানে এখন গণঅসন্তোষ বাড়ছে। দেশটির প্রয়াত বাদশাহ হুসেইনের ছেলে এখন যেভাবে ভিডিও বার্তায় সরকারের সমালোচনা করছেন, তা অনেকটা দুবাইয়ের বন্দি প্রিন্সেস লতিফার বার্তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

গত শনিবার জর্ডানে আরও যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসেম আওয়াদাল্লাহ এবং রাজপরিবারের সদস্য শরিফ হাসান বিন জায়েদ।

কে এই প্রিন্স হামজা?

প্রিন্স হামজা প্রয়াত বাদশাহ হুসেইন ও তার প্রিয় স্ত্রী রানি নূরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি যুক্তরাজ্যের হ্যারো স্কুল ও স্যান্ডহার্স্টের মিলিটারি একাডেমির গ্রাজুয়েট এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করেছেন। কাজ করেছেন জর্ডানের সশস্ত্র বাহিনীতে।

বাদশাহ হুসেইনের প্রিয় সন্তান ছিলেন প্রিন্স হামজা। জনসমক্ষেও অনেকবার তা বলেছিলেন বাদশাহ। প্রিন্স হামজাকে ১৯৯৯ সালে জর্ডানের যুবরাজ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

কিন্তু বাদশাহ হুসেইনের মৃত্যুর পর প্রিন্স হামজাকে উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা না করে বলা হয়, তাঁর বয়স অনেক কম, তিনি অনভিজ্ঞ।

এরপর প্রিন্স হামজার পরিবর্তে তাঁর সৎ ভাই আবদুল্লাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। বাদশাহ আবদুল্লাহ ২০০৪ সালে প্রিন্স হামজার যুবরাজ খেতাব বাতিল করেন।

প্রিন্স হামজার মা রানি নূর পুত্রের বাদশাহ না হওয়ার ঘটনায় বড় আঘাত পান বলে ধারণা করা হয়, কারণ তিনি আশা করেছিলেন যে, তাঁর ছেলেই একদিন মসনদে আসীন হবে।