অনলাইন ডেস্ক:
প্রায় ৯০ লাখ মানুষের দেশ পাপুয়া নিউ গিনিতে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৫০০ জন। এমন পরিস্থিতিতে করোনা মহামারি দেশটিকে ফেলেছে চরম সংকটে।

ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ এতো বেশি যে নতুন করে কাউকে ভর্তি করানো যাচ্ছে না। রোগীদের হাসপাতালের দরজা থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

আজ রোববার পাপুয়া নিউ গিনির করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সিএনএন।

অলাভজনক এনজিও কেয়ার ইন্টারন্যাশনালের অ্যাসিস্ট্যান্ট কান্ট্রি ডিরেক্টর অব প্রোগ্রাম সাপোর্ট রেভা লোউ রেভা সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘পরিস্থিতি খুবই ভয়ঙ্কর। খুব কম চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান খোলা আছে। তাছাড়া আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে খুব কম মানুষই সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন।’

গত এক বছরে দেশটিতে করোনার বড় ধরনের সংক্রমণ দেখা যায়নি। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ মাত্র এক হাজার ২৭৫ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু, এখন সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।

নিউজিল্যান্ড রেডিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটিতে এখন প্রায় চার হাজার ৬৬০ করোনা রোগী আছেন। দেশটির ৫৩ বছর বয়সী সংসদ সদস্য রিচার্ড মেনডানিসহ প্রায় ৩৯ জন এ রোগে প্রাণ হারিয়েছেন। গত শুক্রবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫৬০ জন নতুন করে সংক্রামিত হয়েছেন, যা একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ।

প্রধানমন্ত্রী জেমস মারাপে স্বীকার করেছেন যে, দেশে ‘অনিয়ন্ত্রিত কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ ঘটছে।

অন্যান্য দেশের তুলনায় পাপুয়া নিউ গিনিতে সংক্রমণের হার এখনো কম থাকলেও এটি সে দেশের অনুন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সজোরে আঘাত করছে। দেশটির সরকার জানিয়েছে যে, সে দেশের প্রায় ৯০ লাখ মানুষের জন্য রয়েছেন মাত্র ৫০০ ডাক্তার।

এনজিও কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমটিকে জানিয়েছেন, স্বাভাবিক অবস্থাতেই দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থা ভঙ্গুর, তার ওপর মহামারি ছড়িয়ে পড়লে তা পুরোপুরি ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে প্রয়োজনের তুলনায় সেখানে করোনা পরীক্ষার সংখ্যা এখনো অনেক কম। এ কারণে মহামারির প্রকৃত ভয়াবহতা সম্পর্কে সবাই ধারণা পাচ্ছেন না। তারা আরও জানিয়েছেন, ভুল তথ্যের কারণে অনেকেই করোনার ঝুঁকিকে পাত্তা দিচ্ছেন না।

পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করে বলেছেন, আগামী সপ্তাহে দেশটির বেশিরভাগ মানুষ ইস্টার উৎসব পালনের জন্য বাড়ি ফিরবে। এতে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক কেটি শুয়েৎজ এ মাসের শুরুর দিকে বলেছিলেন, ‘গত বছর থেকেই আমাদের আশঙ্কা ছিল যে, সংক্রমণের হার বাড়লে পাপুয়া নিউ গিনি মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকটে পড়বে। এখন দেশটির পরিস্থিতি সে পর্যায়েই আছে। দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও বসবাসের অনুপযুক্ত পরিবেশ— এই দুইয়ের সংমিশ্রণ দেশটির জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোকে সংক্রমণের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী করে রেখেছে।’

গত এক বছর পাপুয়া নিউ গিনি করোনা মহামারিকে ভালোভাবেই সামলে রেখেছিল।

গত বছরের ২০ মার্চ দেশটিতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর দুদিনের মধ্যে সেখানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। সব ধরনের ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। শুধু অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলো চালু ছিল।

বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী পাপুয়া নিউ গিনিতে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য ডাক্তার আছে মাত্র ০ দশমিক ৭ জন, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক কম। ২০১৭ সালে পৃথিবীতে গড়ে এক হাজার জনের জন্য সমগ্র বিশ্বে ১ দশমিক ৬ ও যুক্তরাষ্ট্রে ২ দশমিক ৬ জন করে ডাক্তার ছিল।

শুরুতে মনে হয়েছিল যে পাপুয়া নিউ গিনিতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক কম। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ছাড়ায়। সেসময় কেয়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর জাস্টিন ম্যাকমেহন বলেছিলেন, খুব সম্ভবত ভাইরাসটি নীরবে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই ভাইরাসটি এখানে আছে। যদিও মানুষ শুরুতে এ মহামারির ভয়াবহতা নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন তবুও এ মুহূর্তে সবার মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে।’

প্রায় এক বছর ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও হঠাৎ করে কিভাবে মহামারিটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল তা পরিষ্কার নয়। জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়াতে প্রায় ১৫ লাখ করোনা রোগীর হিসাব পাওয়া গেছে। দুই দেশের সীমান্ত বন্ধ কিন্তু কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মহামারির শুরু থেকেই অনেকে এই নিষেধাজ্ঞা মানছেন না।

মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হতে পারে এ মাসের শুরুর দিকে পাপুয়া নিউ গিনির প্রথম প্রধানমন্ত্রী মাইকেল সোমারের মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে বিপুল জনসমাগম। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৮৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

অস্ট্রেলিয়ার এবিসি জানিয়েছে, জাতীয়ভাবে আয়োজিত অন্ত্যষ্টিক্রিয়ায় কয়েক হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন এবং তাদের প্রায় কেউই মাস্ক পড়েননি। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর কফিনটি একটি গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় এর চারপাশে হাজারো মানুষের ভিড় ছিল। এ ছাড়াও, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে শোক সভার আয়োজন করা হয়েছিল।

ম্যাকমেহন বলেন, ‘আমি খুবই চিন্তিত। শোক প্রকাশের জন্য যত মানুষ একত্র হয়েছে তাতে অন্য দেশের মতো সংক্রমণের ধারা বজায় থাকলে এখানে অবশ্যই করোনার সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে।’

তিনি জানিয়েছেন, এক বছর আগে করোনা ঝুঁকির বিরুদ্ধে পাপুয়া নিউ গিনি শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। কিন্তু, এখন সংক্রমণের হার বাড়লেও জনগণ বিধিনিষেধ মানছেন না।

রয়টার্স জানিয়েছে, দেশটিতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক এবং বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মধ্যে যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এছাড়াও, গণজমায়েত নিষিদ্ধ, স্কুল বন্ধ ও কেবল গণকবরে কবর দেওয়ার অনুমতির মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।

পাপুয়া নিউ গিনির সরকারকে এই মারাত্মক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে কেয়ার ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য এনজিওগুলো সাধ্যমত চেষ্টা করছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় পানির ট্যাপ বসাচ্ছে যাতে মানুষ হাত ধুতে পারে।

তবে কেয়ারের অ্যাসিস্ট্যান্ট কান্ট্রি ডিরেক্টর রেভা জানিয়েছেন, তিনি দেশটিতে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষকে মাস্ক পরতে দেখেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্চের প্রথম সপ্তাহে পাপুয়া নিউ গিনির মোট পরীক্ষার ৩০ শতাংশ পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। মেডিসিন্স স্যানস ফ্রনটিয়ারসের (এমএসএফ) বিবৃতিতে জানা যায়, রাজধানীর রিটা ফ্লিন হাসপাতালের ৪০ শতাংশ পরীক্ষায় পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে।

এমএসএফ’র অস্থায়ী হেড অব মিশন গোলাম নবী সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি বড় অংশ করোনায় আক্রান্ত। তাদেরকে আইসোলশনে রাখা হয়েছে। তারা কাজে যেতে পারছেন না। এ কারণে স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিস্থতির আরও অবনতি হয়েছে।’

এমএসএফ’র চিকিৎসা ব্যবস্থাপক ফারাহ হোসেন বলেন, ‘এটি একটি বড় সমস্যা। কারণ দেশে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো মানুষের সংখ্যা খুবই কম।’

তিনি আরও জানিয়েছেন, পাপুয়া নিউ গিনিতে এমএসএফ’র যক্ষ্মা প্রকল্পে কর্মরত ৮৬ কর্মীর মধ্যে ৩০ জনই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন।

কেয়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর জাস্টিন ম্যাকমেহন জানিয়েছেন, দেশের কয়েকটি হাসপাতাল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েকটি হাসপাতালে শুধু মুমূর্ষু রোগী ও সন্তানসম্ভবা মায়েদের ভর্তি করানো হচ্ছে। বাকিদের দরজা থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি ও গুজবের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে বলে প্রতিবেদেন উল্লেখ করা হয়েছে।

ম্যাকমেহন পোর্ট মোর্সবিতে কয়েকজন ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তারা বলেন, ‘যেহেতু আমরা ভাইরাসটিকে চোখে দেখছি না তাই আমরা এর অস্তিত্ব স্বীকার করি না।’

পাপুয়া নিউ গিনির ৮৫ শতাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় দেশটির করোনা সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এরকম পরিস্থিতিতে লকডাউন দেওয়া ও মানুষকে তা মানতে বাধ্য করা বেশ কঠিন। অনেকেই ব্যস্ত বাজারগুলোতে তাদের উৎপাদিত ফসল, ফল ও সবজি বিক্রি করে থাকেন।

মারাপে জানিয়েছেন, সরকার চেষ্টা করছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্থবির না করে এই মহামারি মোকাবিলা করতে হবে।

তবে কেয়ারের অ্যাসিস্ট্যান্ট কান্ট্রি ডিরেক্টর অব প্রোগ্রাম রেভা জানিয়েছেন, লকডাউন ঘোষণা করা উচিত। এমএসএফ’র ফারাহ হোসেইন জানিয়েছেন, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি সচেতনতামূলক প্রচারণা ও ভ্যাকসিন কার্যক্রম খুবই জরুরি।

পাপুয়া নিউ গিনির পক্ষে এককভাবে এই মহামারির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব নয়। অন্যান্য বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলো এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী মারাপে জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়া অ্যাস্ট্রাজেনেকার আট হাজার ডোজ ভ্যাকসিন দিয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে তা দেওয়া শুরু হবে। এর আগে নিউজিল্যান্ডের প্রতিরক্ষা বাহিনী পাপুয়া নিউ গিনিকে চার হাজার ৪০০ কেজি পিপিই দিয়েছে। চীনও ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে পাপুয়া নিউ গিনি এখনো চীনের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন জানিয়েছেন, ‘পাপুয়া নিউ গিনিতে মহামারি ছড়িয়ে পড়লে অস্ট্রেলিয়াতেও ঝুঁকি বেড়ে যাবে।’

গত শুক্রবার নাইন নিউজ জানিয়েছে, ‘পাপুয়া নিউ গিনি থেকে আসা নতুন স্ট্রেইন কুইন্সল্যান্ডের ৬০ শতাংশ করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী।’

ম্যাকমেহন ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা করে বলেছেন, দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি চালানো, মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ নিতে উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদের মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করা ইত্যাদির পেছনে প্রচুর সময় দিতে হবে। এ মহামারির কারণে যক্ষ্মার মতো অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে নজর দেওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘যেহেতু ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে তাই একমাত্র উপায় হচ্ছে সবাইকে ভ্যাকসিন নিতে উৎসাহিত করা।’

এমএসএফ’র চিকিৎসা ব্যবস্থাপক ফারাহ হোসেন বলেন, ‘ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে, প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমণের হার। এখানে এক সমস্যার ওপর আরেক সমস্যা এসে দেখা দিয়েছে। পরীক্ষা বাড়ানো ও উপযুক্ত চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে ভাইরাসটিকে এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ভয়াবহ দূর্যোগ ঘটবে।’