এম. এ আজিজ রাসেল :
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে “তলাবিহীন ঝুড়ির” দেশ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এ দিনটি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর বছরও।

এবার তাই উদযাপনেও যোগ হয়েছে ভিন্ন মাত্রা। এ প্রাপ্তি নিয়েই পর্যটন নগরী কক্সবাজারে বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপিত হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ২৬ মার্চ (শুক্রবার) ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবসের সূচনা হয়। সকাল ৭টায় বধ্যভূমি স্মৃতি স্তম্ভতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন জেলা প্রশাসন। পরে সার্কিট হাউজের সামনে অরুণোদয় স্কুল প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্প মাল্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানান জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সকাল ৮ টায় কক্সবাজার বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন।

এতে সালাম গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ ও পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান। সীমিত পরিসরে আয়োজিত কুচকাওয়াজে অংশ নেন জেলা পুলিশ, জেল পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, বিএনসিসি, নৌ রোভার স্কাউটস ও জেলা পুলিশের সুসজ্জিত বাদক দল। পরে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়া হয়।

দুপুরে বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সংবর্ধনা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক শ্রাবস্তী রায়, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়য়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী, নুরুল আবছার, আবদুস সোবহান ও জেলা জাসদ সভাপতি নঈমুল হক চৌধুরী টুটুল।

সন্ধ্যায় বাহারছড়া মুক্তিযোদ্ধা মাঠে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণ। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। সম্মানিত অতিথির বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক শ্রাবস্তী রায়, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়য়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য সচিব আবু জাফর রাশেদ।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, পঞ্চাশ বছরের এক গর্বিত পরিক্রমার নাম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ এই পরিক্রমার রক্তাক্ত ভিত্তিভূমি, বঙ্গবন্ধু এর মহান কান্ডারী। মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিকতার ফল নয় বরং ইতিহাসের এক অনিবার্য ধারাবাহিকতার নাম। হাজার বছরের বিদ্রোহী ও সংগ্রামী পরম্পরায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লগ্নে স্বাভাবিকভাবে আমাদের দৃষ্টিসীমায় ভেসে ওঠে পঞ্চাশ বছরের পথ-পরিক্রমণ। আমরা যারা ইতিহাসের সাক্ষী, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রক্তরঞ্জিত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রত্যক্ষদর্শী, তারা পঞ্চাশ বছরের পরিক্রমণের সঙ্গে দেখতে পাই রক্তসমুদ্র পেরিয়ে নতুন অভিযাত্রার সূচনা। ফলে কেবল পথরেখা নয়, রক্তরেখাও আমরা দেখি। এই রক্তদাগের সঙ্গে মেশে, স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের উপান্তে সপরিবার বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতির জনকের রক্ত মিশে যায় একাত্তরের রক্তধারার সঙ্গে। ফলে স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন আমাদের বিপুল মূল্য দিতে হয়েছিল তেমনি স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও অর্জনগুলো বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে জাতির শরীর।

বক্তারা আরও বলেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা সূচিত হয় তার ধারাবাহিকতাতেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ধনী-গরিব বৈষম্য, দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হলে আমরা অচিরেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ উপলক্ষে মসজিদ, মন্দির ও বিভিন্ন গীর্জায় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। এছাড়া এতিমখানা, জেলখানা, সরকারি শিশু পরিবার ও হাসপাতালে ব্যবস্থা করা হয় উন্নত মানের খাবারের।

জেলা আওয়ামী লীগঃ
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেন জেলা আওয়ামী লীগ। ২৬ মার্চ (শুক্রবার) সকালে দলীয় কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং বধ্যভূমি স্মৃতি স্তম্ভে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এসব কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন সিআইপি, সহ-সভাপতি অধ্যাপিকা এথিন রাখাইন, সহ সভাপতি রেজাউল করিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক মুকুল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এড. রনজিত দাশ, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আবছার চেয়ারম্যান, ইউনুছ বাঙালি, এটিএম জিয়া, কাজী মোস্তাক আহমদ শামীম, খোরশেদ আলম, এম,এ মনজুরসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে শহরব্যাপী বর্ণিল আলোকসজ্জা করেন জেলা আওয়ামী লীগ।

পৌর আওয়ামী লীগঃ
২৬ মার্চ বিকালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে পাবলিক লাইব্রেরীর শহীদ দৌলত ময়দানে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগ। পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নজিবুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল কর এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান। বক্তব্য রাখেন সহ-সভাপতি অধ্যাপিকা এথিন রাখাইন, সহ সভাপতি রেজাউল করিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক মুকুল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এড. রনজিত দাশসহ পৌর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
সভায় বক্তারা বলেন, আজকের দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের, গর্বের ও সম্মানের। কারণ ১৯৭১ সালে মার্চের এই দিনের প্রথম প্রহরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই স্বাধীনতা একদিনে বা হঠাৎ করে আসেনি। অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তাই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে অর্থাৎ স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সকলকে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, গৌরব ও ত্যাগের অনুপম বীরত্বগাথা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। আমরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জনকারী জাতি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে আমরা উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সুবর্ণ আলো দেখতে পাই। জাতির পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাব—মুজিব জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভক্ষণে এটাই হোক সকলের চাওয়া-পাওয়া।

কক্সবাজার প্রেস ক্লাব ও কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নঃ
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ উপলক্ষে সন্ধ্যায় আলোচনা সভা ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন কক্সবাজার প্রেস ক্লাব। সভায় বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে যারা কথিত ভারত বিরোধীতা নামে নাশকতা সৃষ্টি চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা স্বাধীনতার পরাজিত গোষ্ঠির প্রেতাত্মা। কেননা বাংলাদেশ স্বাধীনতার সময় ভারত একটি দেশে যারা নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। বাংলাদেশের কোটি বেশি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ, মুক্তিকামি মানুষকে প্রশিক্ষণ প্রদান অস্ত্র প্রদান করেছিলেন। একই সঙ্গে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভারতের সেনা সদস্যও অংশ নিয়েছিলেন। আজ এসে সেই
পরাজিত শক্তি ভারত বিরোধী করছে। মুলত স্বাধীনতার পরাজিত গোষ্ঠির প্রেতাত্মারা আবারো ষড়যন্ত্র করছে।
সভায় বক্তারা আগামী প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস

জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখার আহবান জানানো হয়।
কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়ন ও কক্সবাজার প্রেসক্লাব সভাপতি আবু তাহের এর সভাপতি সভায় বক্তব্য রাখেন, কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুল ইসলাম, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহেদ সরওয়ার সোহেল, অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ জুনাইদ, সাংগঠণিক সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল, সদস্য আহসান সুমন, সুজাউদ্দিন রুবেল, শহীদুল ইসলাম প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রেসক্লাবের ক্রিড়া সম্পাদক দীপক শর্মা দীপু।