কালেরকন্ঠ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের গবেষণা জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠছে। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।

ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) ও একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রে জাল-জালিয়াতির অনেক ঘটনা ধরা পড়ার পর এ নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে আরো উদ্বেগজনক চিত্র। সেটা হলো, পিএইচডি গবেষণা ও সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের বিদ্যমান আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একাধিক নির্দেশনায় দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের অনুমতি না থাকলেও সেটা উপেক্ষা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া অনুমোদনহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া পিএইচডি সনদও মিলছে। আইন উপেক্ষা করেই গড়ে উঠেছে স্টাডি সেন্টার। ভুয়া ও মানহীন সনদ নিয়ে চাকরি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু এসব সনদ দেওয়া বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট গবেষণায় জালিয়াতির শাস্তি হিসেবে কয়েকজন শিক্ষককে পদাবনতি দিয়েছে। এর মধ্যে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওমর ফারুককে সহকারী অধ্যাপক থেকে প্রভাষক পদে পদাবনতি দেওয়া হয়। এর আগে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৮ সালে এ শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি বাতিল করা হয়। আর অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মাহফুজুল হক মারজান শিক্ষা ছুটিতে আছেন। তিনি ছুটি শেষে বিভাগে যোগদান করার পর তাঁর পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু গবেষণায় জালিয়াতির শাস্তি হিসেবে তিনি যোগদান করার পর দুই বছর পর্যন্ত কোনো ধরনের পদোন্নতি পাবেন না। তাঁরা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে।

২০১৩ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপপরিচালক মো. হুমায়ন কবির আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ডিগ্রির সনদ জমা দেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। এই পিএইচডি সনদের ভিত্তিতে দুটি ইনক্রিমেন্ট পান তিনি। কিন্তু ২০১৭ সালে ইউজিসির তদন্তে তাঁর সনদ অবৈধ প্রমাণিত হয়। তদন্ত কমিটি তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি বাতিল, ইনক্রিমেন্ট বাবদ প্রদত্ত অর্থ ফেরত এবং নৈতিক স্খলনের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রচলিত বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে চিঠি দেয় ইউজিসি। ডিগ্রি বাতিল হলেও এখনো স্বপদে বহাল আছেন ওই কর্মকর্তা।

রাজধানীর মালিবাগ মোড়ে ৮০/এ/১ সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডে অবস্থিত লিংকন হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট। এই প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ও মাস্টার্স অব ফিলোসফি (এমফিল) ডিগ্রি দেওয়া হয়। আমেরিকান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ডিগ্রি তারা দিচ্ছে চার লাখ টাকায়। এ ছাড়া তারা মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব গ্রিন ওয়াইজ, লন্ডনের লিংকন ইউনিভার্সিটিসহ আরো একাধিক ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ডিগ্রি দেয়। তার জন্য আরো বেশি টাকা খরচ করতে হবে। ভর্তি হওয়ার প্রথম চার মাস প্রতি শুক্রবার বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ক্লাস। দুই বছরে পিএইচডি ডিগ্রির নিশ্চয়তা দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

শিক্ষার্থী সেজে প্রতিষ্ঠানটির এক্সিকিউটিভ মুক্তার কাছে পিএইচডি ডিগ্রির তথ্য জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার অনুমতি নেই। তবে আমরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছি। আমরা মূলত সাপোর্ট সেন্টার হিসেবে কাজ করছি। আমাদের এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাস নেন। অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনৈতিক নেতা আমাদের কাছ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন।’ আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে এলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. সেলিম ভূঁইয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থাও করে দেবেন বলে জানান তিনি।

২০১০ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের ৩৫ নম্বর ধারার (৩) ও (৪) উপধারায় বলা আছে, অনুমোদনপ্রাপ্ত নয়, এমন কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাদেশে কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা, ক্যাম্পাস, স্টাডি সেন্টার বা টিউটরিয়াল সেন্টার ইত্যাদিতে শিক্ষার্থী ভর্তি বা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। অর্থাৎ কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিদেশের কোনো স্টাডি সেন্টারের পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমনকি ইউজিসিও একাধিক নির্দেশনায় দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের অনুমতি নেই বলে জানিয়েছে।

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত অনুমোদিত কোনো স্টাডি সেন্টার নেই। ফলে তারা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি দিলেও তা বৈধ হবে না। আমরা তাদের পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করি না। সরকারের অন্যান্য সংস্থা এসব অবৈধ স্টাডি সেন্টার বন্ধের উদ্যোগ নিতে পারে।’

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ যাবৎ কত পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান ইউজিসির কাছে নেই। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন পাঁচ হাজার ৩৪৭ জন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তিন হাজার ২০৯ জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক রয়েছেন। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পিএইচডির জন্য নানা ধরনের তদবিরেরও প্রয়োজন হয়। এতে অনেক অযোগ্য ব্যক্তিও নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পেয়ে যাচ্ছেন।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে একাধিক গবেষণা, গবেষণামূলক প্রকাশনা থাকতে হয়, কিন্তু দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে দায়সারা গবেষণা কার্যক্রম। চলছে চৌর্যবৃত্তি। জালিয়াতির জন্য চাকরিচ্যুতি এবং তদন্তের ঘটনাও কম নয়, কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না এসব কর্মকাণ্ড।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে মোট গবেষণা ব্যয় ছিল ৫১৬ কোটি টাকা। আর প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫০১টি। ইউজিসি বলছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণায় প্লেজিয়ারিজম বা চৌর্যবৃত্তির ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। প্লেজিয়ারিজম নিয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় গবেষণাপত্রে চুরির বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। তাই প্লেজিয়ারিজমবিষয়ক সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা আবশ্যক। শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণাকর্মের মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

ভুয়া ও মানহীন পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ইউজিসি। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ইউনিভার্সিটি (আইসিইউ), মালয়েশিয়ার পার্দানা ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব হনলুলু, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি মেলবোর্ন, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল), দ্য সেন্ট্রাল বোর্ড অব হায়ার এডুকেশন (সিবিএইচই), ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ও আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি।

পিএইচডি থিসিসে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূর উদ্দিন আলোকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ ছাড়া সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠে। অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সময় একটি বই ও ছয়টি প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ এনে নিয়োগ কমিটির এক সদস্য ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে আরবি বিভাগের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় চুরির অভিযোগ এনে পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়েছিল।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাপত্র জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সিন্ডিকেট। ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি জালিয়াতির দায়ে একই বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলামের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধন ও গবেষণাপত্র বাতিল করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯ সালে অভিযোগটি করেছেন লোকপ্রশাসন বিভাগেরই একজন সহযোগী অধ্যাপক। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে তদন্ত চলমান।

গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ও সমমানের ডিগ্রি ইউজিসির আইন মেনে দেওয়া হচ্ছে কি না তা তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে ইউজিসি চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পিএইচডি জালিয়াতির অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নির্দেশ দেওয়া হয়। পিএইচডি ও সমমানের ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতি বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবীর করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।

গবেষণায় জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। এর পরও বেশির ভাগই ভালো শিক্ষক। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্বলতার কারণে যাঁরা যোগ্য নন অর্থাৎ যাঁদের একাডেমিক স্ট্যান্ডার্ড নেই, তাঁরাও ঢুকে পড়ছেন। এ ছাড়া কেউ কেউ আছেন যাঁদের চারিত্রিক গুণাবলি নেই, তাঁরাও নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন। পদোন্নতির জন্য যেহেতু গবেষণার প্রয়োজন হয়, তাই এই দুই ধরনের শিক্ষকরা পদোন্নতির জন্য রিসার্চ পেপারের (গবেষণাপত্রের) কিছু অংশ চুরি করে আর্টিকল প্রকাশ করেন। গবেষণায় জালিয়াতি বন্ধে প্রথমে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে।’