প্রথমআলো :

ফসলের সবুজ মাঠের বুকে ১০০ বিঘা আয়তনজুড়ে বিশাল ‘ক্যানভাস’। সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল প্রতিকৃতি। টানা ৩২ দিন ধরে চলছে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবে শিল্পীর রংতুলির আঁচড়ে নয়, ফসলের খেতে ধানের চারা লাগিয়ে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলার এই কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন অর্ধশতাধিক কিষান-কিষানি, যার নেতৃত্বে আছেন আটজন কৃষি প্রকৌশলী।

গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা পেতে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের বালেন্দা গ্রামসংলগ্ন আমিনপুর ও কেশবপুর মাঠে ১০০ বিঘা জমির ধানখেতে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতি তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ’। এটি বাস্তবায়ন করছে ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

গিনেস বুকের স্বীকৃতি পেতে ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। ২৬ মার্চের আগেই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলার সনদ মিলবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৬ মার্চ শেরপুরের আমিনপুর মাঠেই উদযাপন করা হবে আনন্দ উৎসব। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণও জানাবেন আয়োজকেরা।

সরেজমিনে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেল, ১০০ বিঘা জমিতে শোভা পাচ্ছে বেগুনি ও সবুজ জাতের ধানের খেত। শস্যচিত্রে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে এই প্রতিকৃতি, যা দেখতে ভিড় করছেন দূরদূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা। কেউ মুঠোফোনে, কেউ ক্যামেরায়, কেউ ড্রোন দিয়ে ছবি তুলছেন। শস্যখেতে যাতে কোনো প্রকার আগাছা গজিয়ে উঠতে না পারে, এ জন্য খেত নিড়ানি ও পরিচর্যার কাজ ব্যস্ত ৭০ জন কিষান-কিষানি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানালেন, ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০০ মিটার প্রস্থের ক্যানভাসে রংতুলির বদলে শোভা পাচ্ছে দুই রঙের ধানের চারা। এর মধ্যে সবুজ রঙের চারার ধানের নাম ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের হাইব্রিড ‘জনকরাজ’। সবুজের ভেতরে ভিন্ন রং ফুটিয়ে তুলতে চীন থেকে আনা হয়েছে বেগুনি রঙের হাইব্রিড জাতের এফ-১ ধান।

গত ১ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডজনখানেক কৃষি প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জন কিষান-কিষানি বিশাল ক্যানভাসে ধানের চারা লাগানোর কর্মযজ্ঞে অংশ নেন
গত ১ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডজনখানেক কৃষি প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জন কিষান-কিষানি বিশাল ক্যানভাসে ধানের চারা লাগানোর কর্মযজ্ঞে অংশ নেনছবি: প্রথম আলো
যেভাবে দৃশ্যমান হল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি
শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের সদস্যসচিব এবং ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন উদ্যোগের শুরুর গল্প। মাস ছয়েক আগে দুজন তরুণ ৫০০ বিঘা জমিতে ক্রপ আর্টে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি তৈরির মাধ্যমে গিনেস রেকর্ড গড়ার প্রস্তাব নিয়ে তাঁর কাছে আসেন। পরে কারিগরি দিক বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে শত বিঘায় ক্রপ ফিল্ড মোজাইক বা শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কৃষিমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরার পর আগ্রহ প্রকাশ করা হয়।

পরে প্রকল্প বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নেতৃত্বে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ’ নামে ৫১ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। এর উপদেষ্টা কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডজনখানেক কৃষি প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জন কিষান-কিষানি বিশাল ক্যানভাসে ধানের চারা লাগানোর এই কর্মযজ্ঞে অংশ নেন। চারা লাগানোর আগে কৃষি প্রকৌশলীদের সঙ্গে নকশা অনুযায়ী চারা লাগাতে আড়াই ফিট দৈর্ঘের খুঁটি স্থাপনসহ লে–আউটের (নকশা) কাজে অংশ নেয় বগুড়ার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ১০০ শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) সদস্যরা। শুকনা জমিতে তারা প্রায় ১ হাজার ২০০ খুঁটি পুঁতে প্রতিকৃতির লে-আউট করে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে কৃষি প্রকৌশলীদের নিয়ে গঠিত কারিগরি কমিটি এই নকশা তৈরি করে।

শত বিঘার এই জমির মধ্যে বালেন্দা গ্রামের কৃষক মুকুল হোসেনের জমিও আছে। তিনি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে এই শস্যচিত্রের জন্য জমি ইজারা দিয়েছেন। মুকুল হোসেন বলেন, ‘ধানের খ্যাতত বঙ্গবন্ধুর ফটো আঁকা হবি, ইংকা কতা পরথম বিশ্বাস করবার পারিনি। চিন্তা করনো ইরি আবাদ করেতো বিঘাত ৯ হাজার টেকা লাভ হবি না, তার চেয়ে তারগরকই লিজ (ইজারা) দেই। ধানের চারা বড় হওয়ার সাথে সাথে এখন সত্যি সত্যি খ্যাতের মধ্যে হামাকেরে জাতির পিতার ফটো দেকিচ্চি। লিজের চোখ বিশ্বাসই হবার চাচ্চে না।’

লেগেছে দর্শনার্থীদের ভিড়
শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির পাশেই বালেন্দা চারমাথা কড়িতোলা মোড়। সাত সকালেই শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখতে আসা দর্শনার্থীর ভিড় মোড়ের দুটি চায়ের দোকানেও।

প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী শস্যচিত্রে বিরল এই প্রতিকৃতি দেখতে ভিড় করছেন
প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী শস্যচিত্রে বিরল এই প্রতিকৃতি দেখতে ভিড় করছেনছবি: প্রথম আলো
চা–দোকানি বালেন্দা গ্রামের সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দুই মাস আগেও বালেন্দা ছিল অচেনা এক গ্রাম। এই প্রতিকৃতির সুবাদে রাতারাতি পরিচিতি বেড়েছে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এই প্রতিকৃতি দেখতে আসছেন, চা–নাশতা করছেন। বেচাবিক্রি কয়েক গুণ বেড়েছে। আগে সারা দিনে বেচাবিক্রি ছিল ৪০০-৫০০ টাকা। এখন গড়ে তিন হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।

সাইফুল ইসলাম জানালেন, শস্যখেতে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরা ১০০ বিঘার সিংহভাগই আমিনপুর মৌজার জমি। কিছু আছে কেশবপুর মৌজায়। তবে বালেন্দা গ্রামের কাছাকাছি হওয়ায় এই গ্রামই পরিচিতি বেশি পেয়েছে।

শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখতে আমিনপুর মাঠে এসেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আবু নাঈম। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দেখেই এখানে এসেছেন। নিজের চোখে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছেন। এটা বিরল দৃশ্য। নিশ্চিত গিনেস বুকে রেকর্ড গড়বে এটি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শেখ মো. মারুফও সাতসকালে বন্ধুদের সঙ্গে এসেছেন আমিনপুর মাঠে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখতে। তিনি বলেন, বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি অনেক দেখেছি। কিন্তু সবুজ ফসলের মাঠের ক্যানভাসে শস্যচিত্রে কারও প্রতিকৃতি প্রথম দেখলাম। এটা সত্যিই প্রশংসনীয় কাজ।
শুরু থেকেই মাঠে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করছেন শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী শস্যচিত্রে বিরল এই প্রতিকৃতি দেখতে ভিড় করছেন।

কিষান–কিষানির মুখেও খুশির ঝলক
শস্যখেত পরিচর্যার কাজ করছিলেন অর্ধশত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারী। তাঁদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায়। প্রতিদিন ভোরে তাঁরা বিভিন্ন বাহনে চড়ে এখানে কাজ করতে আসেন। চারা রোপণের ১৬ দিন তাঁরা প্রতিদিন ৩০০ টাকা মজুরি পেয়েছেন। এখন চলছে খেত নিরানির কাজ। এ কাজে তাঁরা দিনে ২৫০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন।

এত দিন দেখচি, বড় বড় শিল্পীরা তাঁর (বঙ্গবন্ধু) ছবি আঁকছে। কিন্তু খ্যাতের জমিনত হামাকেরে লাগানো ধানের চারা দিয়্যা বঙ্গবন্ধুর ছবি ফুটে উঠপি, সেডা চারা লাগানোর দিন বিশ্বাস করবার পারিনি।

রায়গঞ্জের বন্দীহার গ্রামের কিষানি স্বরস্বতী রায় (৩৫), শেফালী রানী রায় (৩৮), সন্ধ্যা মাহাতো (৩০), বিজলী রানী রায়দের (২৫) সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বছরজুড়ে কৃষকের খেতখামারে দিনমজুরির উপার্জনে তাঁদের সংসার চলে। তবে এখানে শুধু মজুরির জন্য তাঁরা কাজ করতে আসেননি। শস্যখেতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি গিনেস বুকে রেকর্ড গড়বে, ইতিহাসের অংশ হতেই তাঁরা কাজ করতে এত দূর এসেছেন।

রায়গঞ্জের মাধাইনগর ইউনিয়নের কৃষিশ্রমিক সুচিত্রা মাহতো বলেন, ‘এত দিন দেখচি, বড় বড় শিল্পীরা তাঁর (বঙ্গবন্ধু) ছবি আঁকছে। কিন্তু খ্যাতের জমিনত হামাকেরে লাগানো ধানের চারা দিয়্যা বঙ্গবন্ধুর ছবি ফুটে উঠপি, সেডা চারা লাগানোর দিন বিশ্বাস করবার পারিনি। এখন শেখের ছবি দেকে বুকটা ভরে ওঠে। শিল্পীর বদলে হামরাই আঁকচি এই ছবি, বিশ্বাস করবার পারি না।’

চলছে উৎসবের প্রস্তুতি
ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের হয়ে এই প্রকল্পের তদারক করছেন প্রকল্প কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে জানালেন, ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ার সিডস প্রকল্পে শেরপুরের এই মাঠে ১২০ একর জমি ইজারা নেওয়া আছে। এই জমি থেকে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি আঁকার জন্য ১০০ বিঘা জমি আলাদা করা হয়। এরপর ২৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি তৈরির কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। ১ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চারা রোপণের কাজ চলে। এখন চলছে পরিচর্যার কাজ। গিনিস বুকে রেকর্ড গড়ার মূল উৎসব হবে ২৬ মার্চ। তারও আগে ১৪ মার্চ কৃষিমন্ত্রী প্রকল্প পরিদর্শন করবেন।

গিনেস বুকের স্বীকৃতি পেতে ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। ২৬ মার্চের আগেই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলার সনদ মিলবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা
গিনেস বুকের স্বীকৃতি পেতে ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। ২৬ মার্চের আগেই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলার সনদ মিলবে বলে আশা করছেন

ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন কৃষকের নেতা। অর্থনৈতিক মুক্তি ও শোষণহীন সমাজ গঠনে অবদান রেখেছেন। শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রথমবারের মতো গিনেস বুকে রেকর্ড গড়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। সারা বিশ্বে শস্য দিয়ে তৈরি কোনো ব্যক্তির এটিই সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি। তাই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে ২৬ মার্চের আগেই বিশ্ব রেকর্ডের সনদ মিলবে। গিনেস বুকে রেকর্ড গড়ার মূল উৎসব হবে ২৬ মার্চ। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে। দুই–এক দিনের মধ্যে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে এসব চূড়ান্ত হবে।