কয়েকদিন আগে যোগ দেওয়ায় গণবদলীতে নাম ছিল না তার। সেই সুবাদে পাঁচমাসে চকরিয়া থানার মহা ঘুঁষখোর কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার কর্মকান্ডে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন ঊর্ধতন কর্মকর্তারাও। মামলার তদন্ত বাণিজ্য করে হাতিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। বাদী-বিবাদী পক্ষের নারীদের নিয়ে হোটেলে উঠারও অভিযোগ। গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর আরো কাহিনী।

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া :

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকান্ডের পর কক্সবাজার জেলা পুলিশের সকল (ঊর্ধতন কর্মকর্তা থেকে সুইপার পর্যন্ত) সদস্যকে একযোগে বদলী করার পর নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তরা পুলিশী সেবা দিয়ে মানুষের মন জয় করে আসছিলেন। কিন্তু নুর-ই খোদা সিদ্দিকী নামের একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) একযোগে বদলীর মাত্র কয়েকদিন আগে কক্সবাজারে যোগ দেওয়ার কারণে তাকে গণবদলির শিকার হতে হয়নি।

অবশ্য কয়েকদিন আগে যোগদানের পরই মহা ঘুঁষখোর পুলিশ অফিসার নুর-ই খোদা সিদ্দিকী অনৈতিক উপায়ে টাকা হাতানোর সব কৌশল রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সব পথ-ঘাটও আয়ত্তে নিয়েছিলেন। কক্সবাজার জেলায় তার প্রথম কর্মস্থল হয়েছিল চকরিয়া থানায়। সেই হিসেবে কক্সবাজার জেলায় একমাত্র পুরোনো পুলিশ হিসেবে থেকে গিয়েছিলেন। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) কর্মরত ছিলেন তিনি।

নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোন ধরণের টাকার লেনদেন ছাড়াই যথাযথ পুলিশী সেবা দিয়ে আপমর মানুষের মন জয় করে আসছিলেন। কিন্তু পুরোনো চরিত্রই ধারণ করেছিলেন কক্সবাজার শহরের কুতুবদিয়া পাড়ায় বসতবাড়িতে ঢুকে রোজিনা খাতুন নামের এক নারীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তিন লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় আলোচিত হওয়া কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ির সবেমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এই নুর-ই খোদা সিদ্দিকী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে জেলার সবকটি সার্কেল এবং থানায় নতুন কর্মকর্তাসহ পুলিশ কনষ্টেবল এখানে যোগ দেওয়ার পর ইতোমধ্যে পাঁচমাস অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু কোন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এইসময়ে কোথাও কোন দুর্নাম শোনা না গেলেও সর্ববৃহৎ ইয়াবার চালান এবং বস্তাভর্তি টাকা জব্দ করে সারাদেশে পুলিশের ভাবমূর্তি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন বর্তমান জেলা পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। অব্যবহিত এই সময়ে পুলিশের সুনামও ছিল বেশ। কিন্তু গত পহেলা মার্চ কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুর-ই খোদা সিদ্দিকী, দুই কনষ্টেবল আমিনুল মোমিন ও মামুন মোল্লা টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় নিজেদের জড়িয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি ফের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

নানা অভিযোগ কানে যাওয়ার পর কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান চকরিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুর-ই খোদা সিদ্দিকীকে মাত্র একসপ্তাহ আগে চকরিয়া থানা থেকে কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়িতে বদলী করেন। সেখানে যোগ দিয়েই শুরু করে সেই পুরোনো অভ্যাস। গণমাধ্যমে বিষয়টি বেশ আলোচিত হওয়ার পর চকরিয়ার বিভিন্ন ভুক্তভোগীও মুখ খুলতে শুরু করেছেন মহা ঘুঁষখোর পুলিশ অফিসার এই নুর-ই খোদা সিদ্দিকীর ব্যাপারে।

চকরিয়ার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের আইয়ুব মো. ইকবাল অভিযোগ করেছেন, জায়গার বিরোধ নিয়ে এলাকায় তার ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর। হামলায় তার একটি দাঁত ঝরে পড়াসহ সর্বশরীরে রক্তাক্ত জখমও হয়। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে থানায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে এজাহার দেওয়ার পর তদন্তের দায়িত্ব পান এসআই নুর-ই খোদা সিদ্দিকী। এর পর সরজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলা রুজু করে দেওয়ার কথা বলে দুই দফায় ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। এমনকি আমার প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে উল্টো আমিসহ পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে সহায়তা দেন তিনি। এতে আমি নিজেসহ পরিবার সদস্যরা হয়রানির মুখে পড়ি।

ভুক্তভোগী আইয়ুব মো. ইকবাল আরো অভিযোগ করেছেন, পাল্টা মামলায় আসামী হয়ে যাওয়ার পর তিনি থানায় যেতে না পারার কারণে তাঁর স্ত্রী আশরাফুন্নেছা সরাসরি থানায় গিয়ে ওসির কাছে এসব বিষয় খুলে বলেন। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। এর পর থেকে নুর-ই খোদার হুমকি-ধামকিতে তটস্থ হয়ে পড়ি আমরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুটাখালীর এক যুবলীগ নেতা  বলেন, ‘আমার নিকটাত্মীয়ের একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার বিপরীতে এসআই নুর-ই খোদা সিদ্দিকী হাতিয়েছেন নগদ ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু টাকা নেওয়ার পরও সে মামলার প্রতিবেদন না দিয়ে বকাঝঁকা করতে থাকেন। শেষপর্যন্ত বিষয়টি সিনিয়র এক নেতার দৃষ্টিগোচর করলে চকরিয়া থেকে বদলী হওয়ার কয়েকদিন আগে সেই প্রতিবেদন দাখিল করেন।

ডুলাহাজারা ইউনিয়নের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি হচ্ছেন হামিদুল হক। তিনি অভিযোগ করেন, পারিবারিক বিরোধ এবং তার ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে আদালতে একটি মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে ওসি মহোদয় সেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেন এসআই নুর-ই খোদা সিদ্দিকীকে। তদন্তের দায়িত্বভার নেওয়ার পর থেকে নুর-ই খোদা সিদ্দিকী যাচ্ছেতাই খারাপ আচরণ শুরু করেন। দাবি করেন মোটা অংকের টাকা।

ভুক্তভোগী হামিদুল হক বলেন, ‘শেষপর্যন্ত এই নুর-ই খোদা সিদ্দিকী আমার কাছ থেকে টাকা না পেয়ে মামলার অভিযুক্তদের সাথে আঁতাত করেন। এমনকি অভিযুক্তদের কাছ থেকে নগদ তিন লাখ টাকা নিয়ে উল্টো আমার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিলের সবকিছুই সম্পন্ন করে ফেলেন। এই বিষয়টি জানার পর সরাসরি আমি থানার ওসি শাকের মোহাম্মদ যুবায়ের এর শরনাপন্ন হই। এ সময় বিষয়টি খুলে বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে ওসি মহোদয়কে কিছু কঠোর কথাবার্তা বলি। পরে ওসি মহোদয় বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তদন্ত কর্মকর্তা নুর-ই খোদা সিদ্দিকীর দেওয়ার প্রতিবেদন অগ্রবর্তী না করে চকরিয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারি পুলিশ সুপার মো. তফিকুল আলমের অনুমতি নিয়ে অভিযোগটি পুনঃ তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেন থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আশরাফ হোসেনকে।

ভুক্তভোগী হামিদুল হক পুলিশের চকরিয়া সার্কেলের কর্মকর্তা মো. তফিকুল আলম এবং থানার ওসি শাকের মোহাম্মদ যুবায়ের এর নেওয়া তাৎক্ষণিক এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘যদি আমার অজান্তে ওই মামলার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল হয়ে যেত, তাহলে আমার সহায়-সম্পদসহ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের বিরাট ক্ষতি হয়ে যেত। এজন্য আমি সার্কেল এবং ওসির প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কারণ তারা পুনঃ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়াতে এখন সত্য বিষয়টি তদন্তে উঠে আসবে বলে আমি মনে করি।’

আলোচিত নুর-ই খোদা সিদ্দিকী টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর চকরিয়ায় থাকাকালীন আরো বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য কালের কণ্ঠের হাতে এসেছে। তন্মধ্যে বেশি আলোচিত হচ্ছে নারীঘটিত বিষয়টি।

চকরিয়া পৌরশহরে রয়েছে বেশ কয়েকটি অভিজাত রেস্তোরা এবং আবাসিক হোটেল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসব অভিজাত রেস্তোরার একাধিক মালিক ও কর্মচারী  দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

তারা জানান, পুলিশ কর্মকর্তা নুর-ই খোদা সিদ্দিকী প্রতিনিয়ত নারী নিয়ে তাদের রেস্তোরায় যেতেন এবং তারা একান্তে সময় কাটাতেন। যেসব নারীকে নুর-ই খোদা সিদ্দিকী নিয়ে আসতেন, তারা এখানকারই নারী এবং বিভিন্ন মামলা ও অভিযোগের বাদী-বিবাদী। সেখানে তার কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না।

চকরিয়া থানা থেকে হঠাৎ নুর-ই খোদা সিদ্দিকীর বদলী কেন হলো? এমন প্রশ্নে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাকের মোহাম্মদ যুবায়ের  বলেন, ‘ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মোতাবেক পুলিশের সকল সদস্য চেইন অব কমান্ড মেনে দায়িত্ব পালন করছিলাম। কিন্তু জেলায় একমাত্র হিসেবে চকরিয়া থানায় নুর-ই খোদা সিদ্দিকীই পুরোনো পুলিশ (এসআই) হিসেবে রয়ে গিয়েছিলেন। কারণ জেলার সব পুলিশকে গণবদলীর মাত্র কয়েকদিন আগে নুর-ই খোদা সিদ্দিকী এখানে যোগ দেন। তাই গণবদলী থেকে বেঁচে যান নুর-ই খোদা সিদ্দিকী।’

ওসি শাকের মোহাম্মদ যুবায়ের আরো বলেন, ‘আমরা যারা নতুন যোগদান করেছি, তারা অনৈতিক লেনদেনে না জড়িয়ে পুলিশী সেবা প্রদানের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করে চলেছি। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার কাছে অনেকে মৌখিকভাবে নুর-ই খোদা সিদ্দিকীর ব্যাপারে নানা কথা বলার পর তা ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করি। পরবর্তীতে তাকে এখান থেকে বদলী করে জেলা সদরে নিয়ে যাওয়া হয়।

চকরিয়া থানার সদ্য সাবেক উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুর-ই খোদা সিদ্দিকীর বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের চকরিয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারি পুলিশ সুপার মো. তফিকুল আলম  বলেন, ‘নতুন বা পুরোনো হউক কোন পুলিশ সদস্য অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়ালে তাকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি পেতে হবে। যা ইতোমধ্যে নুর-ই খোদা সিদ্দিকীর বেলায় ঘটে গেছে। অতএব ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মোতাবেক কোন পুলিশ সদস্য অনিয়মে না জড়িয়ে সম্পূর্ণ পুলিশী সেবা দেওয়ার মাধ্যমে জনগণের মনে স্থান করে নিতে হবে। আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি।’