সিবিএন ডেস্ক: দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সব রাজনৈতিক শক্তির বৃহত্তর ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আজকে দেশের একমাত্র প্রধান সংকট হচ্ছে, আমাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে—টু রেস্টোর ডেমোক্রেসি। আজকে আমাদের গণতন্ত্র হারিয়ে গেছে, স্বাধীনতার সব চেতনা লুণ্ঠন করে নিয়েছে। আজকে বিএনপিকে নেতৃত্ব দিতে হবে এই ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী সরকারকে সরিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবার জন্য।

মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব এই আহ্বান জানান।

মির্জা ফখরুল বলেন, এখানে আ স ম আবদুর রবের যে বক্তব্য, মাহমুদুর রহমান মান্নার যে বক্তব্য, নুরুল হক নুরের যে বক্তব্য—সেই বক্তব্যে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সব রাজনৈতিক শক্তি যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে; তাঁরা আজকে ঐক্যবদ্ধ হতে চায়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন সৃষ্টি করে তারা সরকারের পতন ঘটাতে চায় এবং সত্যিকার অর্থেই জনগণের একটা পার্লামেন্ট, জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আসুন আজকে আমরা সেই শপথ নিয়ে, সেই লক্ষ্যে আগামীর গন্য সংগঠিত হই।

আওয়ামী লীগ জাতিকে বিভক্ত করেছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গোটা জাতি বিভক্ত হয়ে গেছে। তারা শুধু তাদের নেতা এবং যেসব নেতৃবর্গ আছেন, তাঁদের ছাড়া আর কাউকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য, স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য স্বীকৃতি দিতে চায় না। স্বাধীনতা কোনো একজন বিশেষ ব্যক্তি বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা দলের কারণে আসেনি। স্বাধীনতা এসেছে দীর্ঘকাল ধরে এ দেশের মানুষের যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা—আমি যতটুকু দেখেছি যে, সেই ব্রিটিশ পিরিয়ড থেকে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা করে আসছিল। সেজন্য এখানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলন হয়েছে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে উঠে তার নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ।

দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি বলেন,  সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা জানাতে চাই যিনি যুদ্ধ ঘোষণা না করলে এ দেশের স্বাধীন হওয়া হতো না। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা না করলে সারা দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত না, তিনি যুদ্ধ ঘোষণা না করলে সত্যিকার অর্থেই যে চেতনার জন্য আমরা লড়াইটা করেছিলাম—একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, সেটা সম্ভব হতো না।

মির্জা ফখরুল আরো বলেন, দুর্ভাগ্য আমাদের—স্বাধীনতার পরে যারা ক্ষমতায় বসল, তাদের হাতে গণতন্ত্র হত্যা হলো, তারা সর্বপ্রথম পুরোনো কালাকানুন বিশেষ ক্ষমতা আইন, জরুরি অবস্থার আইন এবং সর্বোপরি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করল। তাদের যে রাজনৈতিক ক্যামেস্ট্রি, তাদের যে চিন্তা, দর্শন; সেখানে একটা একনায়কতান্ত্রিকতা, একটা স্বৈরাচারী মনোভাব ইনহেরেন্ট তাদের মধ্যে রয়ে গেছে। সেই কারণে এত দীর্ঘকাল পরে আবার ক্ষমতায় আসার পর তারা সেই ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করবার জন্য একই পথ বেছে নিয়েছে।

ফখরুল আরো বলেন,  আজকে সরকার গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করছে। আজকে সত্যিকার একটি স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণ করা, সত্যিকার অর্থে একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ করা, সত্যিকার অর্থে একটা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা—সেটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ১৯৭১ সালে আমরা কেন যুদ্ধ করেছিলাম? আমরা তো যুদ্ধে ছিলাম। কেন করেছিলাম যে, আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আজকে ইস্যু একটা, ক্রাইসিস একটা—গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, পত্রিকায় দেখলাম, পুলিশের আইজি সাহেব তিনি একটা প্রশ্ন রেখেছেন। সেটি হচ্ছে—পুলিশকে প্রতিপক্ষ বলা হচ্ছে কেন? আমারও একই প্রশ্ন। আপনি তো একজন শিক্ষিত মানুষ, ব্রাইট অফিসার, সুদর্শন। আপনি কি একবারও প্রশ্ন করেছেন নিজেকে? যে পুলিশকে কেন প্রতিপক্ষ ভাবছে জনগণ? কারা প্রতিপক্ষ ভাবছে? এই প্রশ্ন আপনি নিজেকে করে উত্তর খুঁজে বের করুন। তিনি আরো বলেন, আজকে যখন নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে পুলিশ গিয়ে ভোট দিয়ে দেয়। অন্য কাউকে দরকার হয় না। আজকে যখন একটা রাজনৈতিক ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো নিয়মতান্ত্রিভাবে গণতান্ত্রিকভাবে সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী প্রতিবাদ করতে যায়; তখন তাদের এই যে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন—কেন করা হয়? আজকে কেন বলা হয় থানায় থানায় যে দেশটা আমরা চালাই, আমরা সরকার তৈরি করেছি, আমরাই এসব ব্যবস্থা করব। সেই প্রশ্নটা নিজেদের করুন, জানার চেষ্টা করুন; তাহলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, আজকে দুর্ভাগ্য আমাদের রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান দলবাজ হয়ে পড়েছে, তাদের দলীয়করণ করা হয়েছে। আমাদের ১৯৭১ সালের সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধ আমরা করেছিলাম, যে স্বপ্ন দেখেছিলাম—সেই স্বপ্নগুলো ভেঙে চূরমার করেছে। এই ৫০ বছরে আওয়ামী লীগ দেশকে শুধু বিভক্ত করেছে, এই ৫০ বছর সব অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। উন্নয়নের কথা বলে, সিঙ্গাপুর বানানোর কথা বলে, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার কথা বলে আজকে আমাদের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লুটেরাদের হাতে এ দেশকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে প্রথম স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলনকারী জাতীয় সামাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির চেয়ারম্যান আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘একাত্তরের আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে একেবারে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়। এই ধরনের সংকীর্ণতা মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মানের শামিল। সমগ্র জাতির নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা লাভ করেছি আমাদের স্বাধীনতা।

সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আবদুর রব বলেন, ‘বাঁচতে হলে লড়তে হবে, লড়াই করে জিততে হবে। এই লড়াই বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততেই হবে। বাঁশের লাঠির পাল্টা উত্তর দিতে হবে। সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।

জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগের সমালোচনা করে আ স ম রব বলেন, এই উদ্যোগে সরকার ‘মুক্তিযুদ্ধের ভিলেন’ হিসেবে চিত্রিত হবে। রাষ্ট্রের যে বীরত্ব প্রদর্শন করা হয়েছে, সে বীরত্ব বাতিলের অধিকার কারো নেই। বীরত্ব কারো অনুগ্রহ নয়, এটা অর্জন। জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের অপচেষ্টা থেকে সরকারকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।

আলোচনা সভায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিও জানানো হয়।

জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বিএনপির স্বাধীনতা সূবর্ণজয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ঐতিহাসিক পতাকা উত্তোলন দিবস উপলক্ষে এই আলোচনা সভা হয়। আলোচনা সভার আগে মিলনায়তনের সামনে বিএনপির মহাসচিবকে নিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আ স ম আবদুর রব।

সরকার স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি করছে উল্লেখ করে সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় কমিটি আহ্বায়ক খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করছে। আমরা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের উদ্দেশে জনগণের কাছে, নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরব। সেজন্য আমরা ৩ মার্চ পালন করছি। ইতিমধ্যে কোনো দল সেটা করেনি।

ড. মোশাররফ বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তারাও কিন্তু এই দিবসটি স্মরণ করতে চায় না। কেন চায় না? কারণ এক দশক ধরে তারা বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরছে। কেননা যারা গায়ের জোরে ক্ষমতায় আছে, তারা স্বৈরাচার-ফ্যাসিস্ট ছিল এবং নতুন পদবি অর্জন করেছে আন্তর্জাতিকভাবে মাফিয়াতন্ত্র। এই যে তারা মাফিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তারা এই দেশের মানুষকে, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে চায় না। যদি প্রকৃত ইতিহাস দেওয়া হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের অবস্থান অনেক পেছনে পড়ে যায়।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন,  ছাত্রদল সেদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যেভাবে প্রতিরোধ করেছে, সেজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। আমি বলতে চাই, এই প্রতিরোধের দেয়াল আরো শক্ত করতে হবে। নিজেরা নিজেদের মনে সিদ্ধান্ত নেন, লড়াই এখন কেবল খণ্ড খণ্ড নয়, ছোট ছোট, খণ্ড খণ্ড লড়াই করতে করতে, সেই লড়াইকে সঙ্গে করে এক জায়গায় নিয়ে একবার সবাইকে রাস্তায় নেমে পড়তে হবে—তোকে চাই না।

মান্না বলেন, সবাই মিলে আমরা একটা সময় ঠিক করব এবং এই মঞ্চে যারা আছেন, তাঁদের জন্য বলি, এই মঞ্চে যাঁরা নেই তাদের বলি, যাঁরা আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে নেই, বাইরে আছেন সবাইকে বলি—চলেন সবাই মিলে এক সাথে বাঁচবার জন্য লড়াই করি। জীবনবাজি রেখে। আমাদের দাবি একটাই—এই অবৈধ সরকারকে চলে যেতে হবে। একবার যদি পথে নামি আর পথ থেকে আসব না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা চলে না যায়। আজকের দিনে এটাই আমাদের শপথ হোক। তাহলে আমি মনে করি, আমাদের ৫০ বছরপূর্তি সফল হবে।