তোফায়েল আহমদ

অঞ্জলী কেবল হাঁটছেনই হাঁটছেন। তার পায়ের স্যান্ডেল জোড়ারও একদম শেষ অবস্থা। তাই হাতে নেওয়ার দরকার নেই বলে মনে করে এক স্থানে রেখে দিয়েছেন। কারো দিকে চোখ নেই তার। এক মনে হাঁটছেন। মাঝে মধ্যে হাঁটার গতিও বাড়ান, হাত-পা ঝাড়েন। তাই বুঝতে কষ্ট হয়নি-তিনি ডায়াবেটিস রোগী। এক সময় হাঁটতে যেতেন সাগর পাড়ে। এখন নিয়মিত হাঁটার সুযোগ পেয়েছেন গোলদিঘীর পাড়ে।

তিনি বললেন- ‘দাদা এটাই গোলদিঘী। গোলদিঘীর গোলাকার ঠিকই আছে। কেবল পরিবর্তন এসেছে সৌন্দর্যের। গোলদিঘী ছড়িয়েছে তার বহুবিধ রূপ। তবে আগে হাঁটার সুযোগ ছিল না। কেবল ছিল ডুব দিয়ে গোসল করার। এখন গোসলের সুযোগ নেই। তবে আছে হাঁটা-বসার এবং আড্ডা দেওয়ার বড় সুযোগ।’

অঞ্জলী বলেন, যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের জন্য দোরগোড়ায় এসে গেছে হাঁটার সুযোগটি। আগে রাস্তার ময়লাসহ পানি গড়িয়ে পড়ত গোলদিঘীতে। সেই পানিতে গোসল সারতে হয়েছে। এখন ময়লা আবর্জনামুক্ত হয়ে বেড়েছে গোলদিঘীর সৌন্দর্য। পরিবর্তনের কারণেই অন্তত গোলদিঘীর পাড়ে সৃষ্টি হয়েছে হাঁটা-বসার একটুখানি জায়গার।

দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারকে পরিকল্পিতভাবে সাঁজানোর জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিগন্ত প্রসারিত অবদান-কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। কক্সবাজারে ২০১৬ সালে কউক প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে নান্দনিক দৃশ্যমান প্রকল্পটি হচ্ছে শহরের গোলদিঘী।

এক সঙ্গে শহরের তিনটি পুকুর তথা দিঘী যথাক্রমে গোলদিঘী, লালদিঘী এবং বাজারঘাটার পুকুর সংষ্কার ও সৌন্দর্য বর্ধণের কাজ শুরু করে কউক। গোলদিঘীর কাজ আগে শেষ হয়ে যাওয়ায় সবার দৃষ্টি পড়ছে এখানে। অপরদিকে লালদিঘী ও বাজারঘাটা পুকুরের কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

কক্সবাজার উন্নয়ন প্রকল্পের (কউক) চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ এ বিষয়ে বলেন-‘কউক স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব প্রকল্পগুলো কেবল আমি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে আমার অবদান নগণ্য।
কক্সবাজার এবং কক্সবাজারবাসীর জন্য যা করে চলেছেন তার সব অবদানই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রী চান-কক্সবাজার হয়ে উঠুক একটি অপরূপ সৌন্দর্যের পর্যটন শহর।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, গোলদিঘীর পূর্ব-পশ্চিম দিকে নির্মিত গ্যালারিতে শেষ বিকাল থেকেই লোকজনের জমায়েত শুরু হয়ে গেছে। সন্ধ্যা নাগাদ হয়ে পড়ে লোকে লোকারণ্য। কেউ হাঁটছেন, কেউ গ্যালারিতে বসে আছেন। তরুণ-তরুণীর দলকে দেখা গেছে, জমজমাট আড্ডায় বসে যেতে। কি মুসলিম, কি হিন্দু-বৌদ্ধ এবং রাখাইনদের যেন একটি বড় মিলন মেলার নিরাপদ স্থান ঐতিহ্যবাহী গোলদিঘীর পাড়।

এমনিতেই গোলদিঘীর পার্শ্ববর্তী এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী হচ্ছে হিন্দু। মুসলিমতো রয়েছেই। সেই সঙ্গে রাখাইনসহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও রয়েছে বসবাস। এ কারণেই গোলদিঘীটি এ শহরেরই যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক মিলন স্থান। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই গোলদিঘীর পানির ফোয়ারা ছড়িয়ে দেয় হাঁসির ঝিলিক। বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে এ আরেক চমৎকার দৃশ্য।

গোলদিঘী পাড়ের বাসিন্দা উখিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর অজিত দাশ বলেন- ‘গোলদিঘীর সংষ্কার ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সর্বাগ্রে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতেই হয়। আমরা এ শহরের সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকার বাসিন্দা। আমাদের কোথাও বসার জায়গাও ছিল না। ছিল না নিঃশ্বাস ফেলার মতো স্থান পর্যন্ত। এখন অন্তত বৈকালিক বা সান্ধ্যকালীন সময়ে বসার সুযোগ হয়েছে।’

গোলদিঘী পাড়ের বাসিন্দা এবং স্থানীয় সমাজ কমিটির সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক বদিউল আলম বলেন-‘গোলদিঘীর পানি ব্যবহারকারি জনগোষ্টির সংখ্যা বরাবরই বেশি ছিল। এক সময় গোলদিঘী ছিল এ শহরের সৌখিন বড়শি দিয়ে মাছ ধরা ব্যক্তিবর্গেরও আকর্ষণীয় স্থান। তবে সেই সময় গোলদিঘী ছিল ময়লা-আবর্জনায় ভরা।’ কউক এটি সংষ্কার করার কারণে এখন পরিবেশটাই ভিন্ন রকমের রূপ নিয়েছে। গোলদিঘী সংষ্কারের কারণে এলাকার পুরো চেহারাটাই বদলে গেছে।

এলাকার বাসিন্দা এবং বিশিষ্ট চাল ব্যবসায়ী কাজল পাল বলেন- ‘এখনকার গোলদিঘী এবং তখনকার গোলদিঘীর মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। শৈশবে আমরা সেই দিঘীতেই সাঁতরিয়েছি। আজ সাঁতারের সুযোগ বন্ধ হয়েছে বটে-কিন্তু বসারতো একটা পরিবেশ বান্ধব স্থান তৈরি হয়েছে। এটা অনেক বেশি পাওনা।’

গোলদিঘী নিয়ে একটা বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এলাকার বাসিন্দা এবং বাহারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মন্দিরা পাল। তিনি গোলদিঘীর বর্তমান অবস্থান নিয়ে বেশ খুশি। তবে তার চাওয়াটা হচ্ছে অনেকটা ধর্মীয় বিষয়। শিক্ষক মন্দিরা পাল বলেন-‘পুকুরের পানিতে আমাদের পিন্ড দানের একটি রেওয়াজ রয়েছে। আমাদের কারো মা-বাবা দেহত্যাগ করলে পুত্র সন্তানদের পিন্ড দান দিতে হয়। এতকাল সেটা আমরা দিয়ে আসছিলাম গোলদিঘীর পানিতে। কিন্তু এখন তা আমাদের পিন্ড দান করার জন্য যেতে হয় সাগর পাড়ে।’ মন্দিরা বলেন, এ বিষয়টি ব্যতীত এলাকার মানুষ ভীষণ খুশি গোলদিঘীর বর্তমান সংষ্কার নিয়ে।

রাখাইন নারী মা টিন টিন এর ভাষায়- গোলদিঘী এ শহরের আরেকটি চমৎকার দর্শনীয় এলাকা হয়ে উঠেছে। আগে রাখাইন নারীরা চেরাংঘরে বৈকালিক বা সান্ধ্যকালীন আড্ডায় বসতেন। এখন গোলদিঘীর গ্যালারিতে বসেই আমরা আড্ডায় বসার স্থান পেয়েছি। টিনটিনও মন্দিরার মতো একটি বিষয় নিয়ে মুখ খুলেছেন, সেটি হচ্ছে- রাখাইনদের কারো মৃত্যু হলে শ্মশানের কার্য সম্পাদনের পর পুকুরের পানিতে ডুব দিয়ে গোসল করেই ঘরে ঢুকার নিয়ম চালু রয়েছে।

এতদিন গোলদিঘীর পানিতেই তারা এ নিয়মটি মেনে আসছিলেন কিন্তু এখন সেটা নিয়ে তারা একটু বিব্রত অবস্থায় রয়েছেন। টিনটিন বলেন-বিশাল পাওনার জন্য ক্ষুদ্র বিষয় ছাড় দিতে হয়-সেটাই করছি আমরাও।

-কালেরকন্ঠ