সিবিএন ডেস্ক:টেকনাফে ঘরে ঘরে ইয়াবা ব্যবসায়ীর যে হারে জন্ম হয়েছিল প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযানে তা কিছুটা কমে আসলেও এবার চট্টগ্রাম নগরের প্রাণ কেন্দ্রেই একটি এলাকায় ঘরে ঘরে ইয়াবা বিক্রেতার সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। অবস্থা এমন যে স্বামী পাইকারি ইয়াবা কিনে আনলে স্ত্রী খুচরা বিক্রি করছে। ভাই-ভাই, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বন্ধু, বাপ-পুত—সিন্ডিকেট করে করছে ইয়াবার ব্যবসা। বছর তিনেক আগে ওই এলাকাটিকে মানুষ হাজী ইসলামের বাড়ি হিসেবে চিনলেও ওই গলির নতুন নাম এখন ‘নিউ টেকনাফ গলি।’ এ গলির ১০ জনের সিন্ডিকেট থেকে পাইকারি দরে ইয়াবা কিনে তা খুচরা বিক্রির জন্য কিনে নিয়ে যায় পাশের দাম্মা পুকুর পাড়ের ১৪ জনের আরেকটি সিন্ডিকেট। সেখান থেকে পুরো এলাকায় দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা। একদিনে হাজারের বেশি ইয়াবার বিকিকিনি হয় ওই নিউ টেকনাফ গলি ঘিরে।

রবিবার রাতভর চলা অভিযানে গ্রেপ্তার চার মাদক কারবারিকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার ওই চারজন পুলিশকে জানিয়েছেন, কীভাবে ডবলমুরিং থানার পাঠানটুলি এলাকার হাজী ইসলামের বাড়ির নাম এখন লোকেমুখে ‘নিউ টেকনাফ গলি’ হয়েছে। এ ব্যবসায় জড়িত ওই গলির ১০ পাইকারি বিক্রেতা ও পাশের দাম্মা পুকুর পাড়ের ১৪ খুচরা বিক্রেতার নাম ঠিকানাও পেয়েছে পুলিশ। এসব তথ্য পেয়ে ডবলমুরিং থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীনের নেতৃত্ব ইতোমধ্যে ওই এলাকায় সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে পুলিশ। পাশাপাশি মাদকমুক্ত এলাকা করতে কমিউনিটি পুলিশিং জোরদার, মাইকিং ও সচেতনামূলক সভা করছে পুলিশ।

ডবলমুরিং থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘টেকনাফে ঘরে ঘরে ইয়াবা বিক্রির কথা আমরা শুনে এসেছি। কিন্তু নগরের প্রাণকেন্দ্র পাঠানটুলি এলাকার একটি গলিতে ঘরে ঘরে ইয়াবার পাইকারি ও খুচরা বেচাকেনা হয় অবিশ্বাস্য। অবস্থা এমন যে ওই গলির নামই এখন লোকেমুখে হয়ে গেছে নিউ টেকনাফ গলি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা সেখান থেকে রবিবার রাতে ইয়াবাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছি। এরআগে আরও ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। এছাড়া টেকনাফ গলি ও দাম্মা পুকুর পাড় এলাকার মোট ২৪ ইয়াবা বিক্রেতার নাম পেয়েছি। তাদের সাবধান করে দিতে চাই। হয় তাদের এলাকা ছাড়তে হবে, না হয় আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সঠিক পথে ফিরিয়ে আসতে হবে। মাদক বিরোধী লড়াইয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

এদিকে রোববার রাতভার অভিযান চালিয়ে স্বামী স্ত্রীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এসময় তাদের কাছ থেকে ১শ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।

গ্রেপ্তার চারজন হলেন—মো. খোকন (৩৫) ও তার স্ত্রী কোহিনূর আক্তার মুন্নি (২৭), ফরিদা বেগম (৩২) ও সাইফুল ইসলাম (৩৪)। তাদের মধ্যে প্রথম তিনজন বিক্রেতা হলেও সাইফুল ইয়াবা কিনতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।

পুলিশ জানিয়েছে, বছর তিনেক আগেও ডবলমুরিং থানার পাঠানটুলি এলাকার হাজী ইসলামের বাড়িতে এতো বেশি পাকা দালান ছিলনা। কিন্তু এই গলির অনেক বাসিন্দাই ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িয়ে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যায়। তাদের অনেকে রাজনৈতিক নেতার লেবাসে ইয়াবা বেচা কেনায় জড়িত থাকায় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। তবে এই এলাকায় বেশিরভাগই প্রকাশ্যে ইয়াবা বেচাকেনায় জড়িত রয়েছে। লোকেমুখে বিশেষ করে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে ‘নিউ টেকনাফ’হিসেবে পরিচিত। এ গলিতে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পাইকারি দরে ইয়াবা কিনে আনেন ১০ জন। তারা ১২০ টাকা দামে সেটা পাশের দাম্মা পুকুর পাড়ের ১৪ জনের খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করেন। তারা আবার মাদকসেবীদের কাছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা করে খুচরা বিক্রি করেন। এভাবে দিনে কমপক্ষে হাজারের বেশি ইয়াবা বেচাকেনা হয় এই টেকনাফ গলিকে ঘিরে। বিশেষ করে বাবু নামের এক মাদক ব্যবসায়ীর শ্বশুর বাড়ি টেকনাফ হওয়ায় সেখান থেকে পাইকারি ইয়াবা এনে থাকেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

ডবলমুরিং থানা পুলিশের করা নিউ টেকনাফ গলিতে পাইকারি ইয়াবা বিক্রি করে এমন দশজনের তালিকায় রয়েছেন—বাবু, মোরশেদ, রোকেয়া, অভি, তৌকির, জিতু, রহিম, জোবেল ও  ফরিদা। এদের মধ্যে মোরশেদের স্ত্রী ফরিদাকে পুলিশ রবিবার রাতে গ্রেপ্তার করলেও তার স্বামী মোরশেদ পালিয়ে গেছেন।

অন্যদিকে টেকনাফ গলি থেকে পাইকারি কিনে মাদকসেবীদের কাছে খুচরা বিক্রি করেন দাম্মা পুকুর পাড়ে খুচরা ইয়াবা করে এরকম ১৪ ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে পুলিশ। তারা হলেন—পিংকু, রবিন, সামশু, ইকবাল, জাহিদ, রিপন, সালমা ওরফে টুনটুনি, জিসান, আনোয়ার, ইদু, শুভ, ওয়াসিম, পারভীন, খোকন ও মুন্নী। এদের মধ্যে খোকন ও মুন্নী রবিবার রাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সোমবার বিকেলে ডবলমুরিং থানায় গ্রেপ্তার পাইকারি বিক্রেতা ফরিদা বেগম বলেন, ‘আমরা আগে এসব করতাম না। আমাদের এলাকার কিছু মানুষ এসব কাজে জড়িয়েছে। এখন যেহেতু মান সম্মান সব চলে গেছে। আমি জেল থেকে বের হয়ে আমার স্বামীসহ থানায় এসে সুপথে ফিরে আসব এবং এলাকাকে মাদকমুক্ত করতে কাজ করব।’এসময় পাইকারি ইয়াবা ক্রয়-বিক্রয়ের কথা স্বীকারও করেন তিনি।

পাশে থাকা খুচরা বিক্রেতা মুন্নী বলেন, ‘আমি ফরিদা আপা, বাবুসহ অনেকের কাছ থেকে ১২০ টাকা করে দিনে একশ পিস কিনতাম । প্রতি পিস ১৮০ থেকে ২০০ টাকা করে বিক্রি করতাম। প্রায় সময়ে সব ইয়াবা বিক্রি হয়ে যেত। তবে আমার লাভের টাকা বেশির ভাগতো আমার স্বামী খোকনের জন্যই খরচ হয়ে যেত। তাকে দিনে কমপক্ষে ২০টা ট্যাবলেট দিতে হতো।’ স্ত্রীর পাশে থাকা খোকনও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘এবার জেল থেকে বের হয়ে ভালো হয়ে যাব। আর এই অপমানের জীবন ভালো লাগছে না।’

এসময় ডবলমুরিং থানার ওসি মহসীন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা সুপথে ফিরে আসতে চাইলে আমরা সহযোগিতা করব। কিন্তু টেকনাফ গলি বলো আর যাই বলো এলাকাকে মাদকমুক্ত করা হবে যে কোনও মূল্যে। ডবলমুরিংয়ে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ওই এলাকা থেকেই শুরু হয়েছে। তা নির্মূল করা হবে।’ -সিভয়েস