এম.আর মাহমুদ 

আমি মাতামুহুরী নদী করুনভাবে আর্তনাদ করে বলছি ‘আমাকে বাঁচান’। আমি হয়তো আর বেশিদিন বাঁচব না। আমি সারাজীবন ৪টি উপজেলার অন্তত ১৫ লাখ মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মানবসভ্যতার এ যুগে আমার অবস্থা মরণাপন্ন। আমার উপর চলছে নানা অত্যাচারের স্টিমরোলার। মানবকূলের প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত আমাকে ব্যবহার করেছে। আমার উপর নির্ভরশীল ছিল হাজার হাজার মানুষ। যাদের জীবন-জীবিকা চলত আমার প্রবাহমান পানির উপর। আজ আমি বড় অসহায়। আমার বুক জুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে ধুধু বালুচর। এ চরেও বান্দরবান জেলার আলীকদম, লামা ও চকরিয়ার হাজারো কৃষক বাদাম, পেলন, আলু, লাউ ও পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষসহ হরেক রকম সবজি চাষ করে আসছে। তাতেও আমার দুঃখ নেই। অথচ আমার বুকে এক সময় এত বালুচর ছিল না। বর্তমানে মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকান্ডের কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। এসব কারণে আমি মাতামুহুরী এ করুণ অবস্থা। এক সময় চকরিয়া থেকে নৌকা যোগে সব ধরণের পণ্য লামা ও আলীকদমে সব ধরণের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন করা হতো। কালের আবর্তে এসব নৌকা এখন নেই বললেই চলে। তবে এখনও মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানি দিয়ে চার উপজেলার হাজার হাজার একর জমি চাষাবাদ হয়ে আসছে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে আমার পানি আগের মত ব্যবহার করতে পারছে না মানবকূল। মূলতঃ আমার জন্মস্থান মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কুরুকপাতা ইউনিয়নের পাহাড়ী অঞ্চল হলেও প্রবাহমান হয়েছি আলীকদম, লামা, কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া হয়ে কুতুবদিয়া ও মহেশখালী চ্যানেলের সংযুক্ত হয়েছি। এক সময় আমার দু’কূল জুড়ে ছিল বিশাল বনাঞ্চল। যেখানে ছিল হরেক প্রজাতির বৃক্ষ ও বাঁশবন। এখন মানবসভ্যতা ও কিছু লোভী মানুষের কারণে বনের গাছ-পালা বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। আছে শুধু ন্যাড়া পাহাড়। বর্ষায় বৃষ্টি হলে পাহাড়ী ঢলের সাথে পাহাড়ের মাটি নদীর তলদেশে পলি আকারে ভেসে আসে। যে কারণেই আমার নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। মাতামুহুরীর জন্মের পর থেকে আলীকদম হয়ে চকরিয়া পর্যন্ত অর্ধশতাধিক চি‎িহ্নত কুম (গভীর পানি) থাকলেও এখন সেসব গভীর কুম দিয়ে পাঁয়ে হেঁটে নদী পার হওয়া যায়। নদী প্রতিনিয়ত মানব ও বন্যপ্রাণীদের তৃষ্ণা মিটালেও নিজে কভু নদীর পানি পান করেননি।

মাতামুহুরী নদীর যৌবনে প্রবল বন্যার সময় পানিতে ভেসে আসত মূল্যবান গাছ, বাঁশ ও লাকড়ী। যা সংগ্রহ করে নদীর দু’পাড়ের মানুষ সারা বছরে জ্বালানির চাহিদা মেটাত। অথচ এখন বন্যার পানি আছে সাথে ভেসে আসে সাদা ফেনা। তবে আগের মত গাছ, বাঁশ, লাকড়ী ভেসে আসে না। নদীর দু’পাড়ে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট বনের মূল্যবান পাথরগুলো পাহাড় খনন করে আহরণজনিত কারণে প্রতি বছরই প্রাকৃতিক বিপর্যয় হচ্ছে। ফলে পাহাড়ের মাটিগুলো নদীতে গড়িয়ে এসে আমার এ করুণ অবস্থা। মাতামুহুরী নদীতে শত শত জেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। সে জেলে গুলো এখন চোখে পড়ে না। গ্রামের দুরন্ত কিশোরেরা এখনও নদীতে মাছ ধরে। তবে প্রকৃত জেলেরা নদীতে আর মাছ ধরতে যায় না। কারণ এ নদীর পানিতে আগের মত মৎস্য প্রজনন হচ্ছে না বলা চলে। বর্ষা শেষ হতে না হতেই নদীতে এক শ্রেণির দূর্বৃত্ত বিষ প্রয়োগ করে সব প্রজাতির মাছ নিধনের উৎসবে মেতে উঠে। এসব দেখেও কেউ প্রতিকারে এগিয়ে আসছে না। মাতামুহুরী নদী হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে। তখন ৪ উপজেলার মানুষের ভাগ্যে কি নেমে আসে তা সৃষ্টিকর্তাই জানে। মাতামুহুরী নদীতে এখন চলছে বালু লুটের উৎসব। যা দেখার কেউ নেই। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা ‘কানে দিয়েছে তুলা, পিঠে দিয়েছে কূলা’। অনেক ক্ষেত্রে এসব কু-কর্মে জড়িয়ে পড়েছে জনপ্রতিনিধিরা। আক্ষেপ করে বলতে হয় মাতবরের পাঁয়ে কাদা বিচার দেবে কারে। পরিবেশ অধিদপ্তর নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের কর্মকান্ড দেখে মনে হয় না মাতামুহুরী নদীর পরিবেশ রক্ষায় তারা কোন কার্যকর পদক্ষেপ রাখবে। পুরনো একটি প্রবাদ বলেই মাতামুহুরী নদীর আর্তনাদ লেখাটি ইতি টানতে হচ্ছে। রোম সাম্রাজ্য যখন পুড়ছিল সে সময়ের শাসক নিরু রাসপ্রাসাদে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিল।