ছোটন কান্তি নাথ :
কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম রংমহল। একসময়ের ঐতিহ্যভরা এই রংমহল গ্রামেই পাশেই বিদ্যমান প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা দেশের একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। পার্কের সীমানা দেওয়াল লাগোয়াই রয়েছে অন্তত ৫০০ একরের একটি বড় বিল। এই বিল ‘দাঙ্গার বিল’ হিসেবেও পরিচিত। এই বিলের মধ্যে রয়েছে টিলা শ্রেণীর পাহাড়ও। বিলের চারপাশে সংরক্ষিত বনভূমিতে সৃজন করা আছে সামাজিক বনায়ন।
অতিসম্প্রতি সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রংমহল গ্রামের রং-রূপ পাল্টে ফেলা হচ্ছে গত দুইমাস ধরে। এই দাঙ্গার বিলের টিলা ও সমতল শ্রেণীর জমির মাটি অসংখ্য এক্সকাভেটর দিয়ে কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত গাড়ি মাটি অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সাথে সম্পৃক্ত একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।
শুধু কি তাই, প্রথমে এক্সকাভেটর দিয়ে ২০ ফুটের বেশি গভীরে গিয়ে গর্ত করে বিলের বিভিন্নস্থানে বসানো হয়েছে শক্তিশালী ড্রেজারও। সেই ড্রেজারে ৫০-৬০ ফুট গভীর থেকে তোলা হচ্ছে বালুও। এতে ওই এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন শত শত গাড়িতে করে মাটি পরিবহনের কারণে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে ডুলাহাজারা-বগাইছড়ি সড়ক এবং পুরো রংমহল গ্রামের মানুষ ধুলোর যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে পড়েছেন। বসতবাড়ি ও দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছে।
আগামী বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ ভূমিধসের আশঙ্কায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পুরো রংমহল গ্রামের কয়েকশত বাসিন্দার মধ্যে। সীমানা দেওয়াল ধসে যেতে পারে আশঙ্কা সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের মধ্যেও। কিন্তু পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় নিরীহ বাসিন্দারা পরিবেশের বারোটা বাজানো ভয়াবহ এই কর্মকাণ্ড স্বচক্ষে অবলোকন করলেও মুখ খোলার সাহস কারোরই নেই। কারণ যারা পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে টিলা শ্রেণীর পাহাড় ও সমতল ভূমিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন তারা সরকার দল আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা। প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন স্থানীয় ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও।
সরজমিন আরো দেখা গেছে, রংমহল গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবহমান রয়েছে বগাইছড়ি ছড়া খাল। সেই ছড়ার ‘বউ ঘাটা’ পয়েন্টে দুটি ছোট সাইজের নাঁশি এবং সেই নাঁশির ওপর মাটি ফেলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পানির প্রবাহ। ছড়ার ওপর তৈরি করা মাটির বাঁধ কাম সড়কের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে প্রতিদিন শত শত ট্রাক মাটি এবং ড্রেজার বসিয়ে গভীর খাদ করে উত্তোলিত বালু।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় অসংখ্য ব্যক্তি জানান, পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ডুলাহাজারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাইফুল এহেছান চৌধুরী। তার পক্ষে পরিবেশ বিধ্বংসী এই কাজ সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন হামিদ রেজা সাগর। প্রায় দুইমাস ধরে চলা এই ভয়াবহতার চিত্র যাতে কোন গণমাধ্যম কর্মী ধারণ করতে না পারে সেজন্য সেখানে বসানো হয়েছে পাহারাও। ধ্বংসযজ্ঞের শুরুর দিকে স্থানীয়দের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের একটি দল সেখানে গিয়ে মাটি পরিবহনের সময় দুটি গাড়ি জব্দ করে। এর পরও থামেনি পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড। দিনরাত সমানে টিলা শ্রেণীর পাহাড় সাবাড় ও ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, রংমহলের দাঙ্গারবিলের টিলা শ্রেণীর বিপুল পরিমাণ সমতল ভূমির স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে স্থানীয় এনামুল হক গংয়ের দায়ের করা মামলায় উচ্চ আদালতের দেওয়া দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা বর্তমানে বলবৎ রয়েছে। এর পরও প্রভাবশালীরা সেই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কাও করছেনা জমির মালিকদের অভিযোগ। স্থানীয়রা আরো অভিযোগ করেছেন, ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আমিন প্রথমদিকে বগাইছড়ি ছড়াখালের ‘বউ ঘাটা’ পয়েন্টে মাটি ফেলে বাধ দিয়ে রাস্তা তৈরি করেন। এর পর তার সাথে যোগ দেয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোছাইনের ছেলে সজিব, চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের ভাইপো এমরানুল হকসহ একটি বড় সিন্ডিকেট।
তবে ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মো. নুরুল আমিন দাবি করেছেন, কোন পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তাহলে বগাইছড়ি ছড়া খালে মাটি ফেলে পানির প্রবাহ কে বন্ধ করেছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে, তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি। অভিযুক্ত অন্যরাও কোন অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত নন বলে দাবি করেছেন।
অপরদিকে রংমহল এলাকার যে জায়গা থেকে মাটি অপসারণ করা হচ্ছে তা তাদের পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত এবং সেখানে বনবিভাগের কোন জায়গা নেই দাবি করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল এহেছান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সেখানে মাছ চাষ করার জন্য বেশকিছু পুকুর খনন করা হবে। সেজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই মাটি অপসারণ করা হচ্ছে।’
চকরিয়ার ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের সহকারি তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘পার্ক লাগোয়া টিলা ও সমতল শ্রেণীর জমি থেকে গভীর খাদ করে মাটি অপসারণ করায় হুমকির মুখে রয়েছে পার্কের সীমানা দেওয়াল। আগামী বর্ষা মৌসুমে এই প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে এবং বিষয়টি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’
কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, ডুলাহাজারা বনবিটের রংমহল এলাকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের টিলা শ্রেণীর পাহাড় রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা জোরদার করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে বনবিভাগ একা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না।

ডুলাহাজারার রংমহল এলাকায় টিলা শ্রেণীর পাহাড় সাবাড় এবং সমতল জমির মাটি কেটে মৎস্য চাষের জন্য পুকুর খনন করার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরণের কোন তথ্য আমার কাছে নেই। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি হউক বা সরকারী বনভূমি বা ছড়া হউক যেখানে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলবে এসবের খোঁজ নিয়ে জরুরীভিত্তিতে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানিক দল কোথায় কী হচ্ছে তা তদন্ত করছে।’
ডুলাহাজারার রংমহল এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, ‘মাসখানেক আগে আমি নিজেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছি। তখন মাটি পরিবহনে নিয়োজিত দুটি গাড়িও জব্দ করেছি। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতে মোটা অংকের জরিমানা করে গাড়িগুলো ছাড়া হয়। এ সময় নির্দেশনা দেওয়া হয় পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড না চালাতে। কিন্তু এখন শুনতেছি, ফের ওখানে ধ্বংসযজ্ঞে মেতেছে চক্রটি। তাই এসি ল্যান্ডকে নির্দেশ দিয়েছি, সেখানে গিয়ে বড় ধরণের অভিযান পরিচালনা করতে। পরিবেশ অধিদপ্তরকেও বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।’