বিপদাপন্নের ঝুঁকিতে থাকা এশিয়াটিক কালো ভালুক প্রজননে আবারও সফলতা

ছোটন কান্তি নাথ :
আবদ্ধ অবস্থায় সচরাচর বাচ্চা প্রসব করতে পারেনা এশিয়াটিক ব্ল্যাক বিয়ার তথা কালো ভালুক। তবে আবদ্ধ অবস্থার মধ্যেও আবাসস্থল যদি মাটির সংস্পর্শে থাকে তাহলে সেখানে গর্ত কুঁড়ে বাচ্চা প্রসব করতে পারে স্ত্রী ভালুক। আর সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের স্ত্রী ভালুক ‘জরিনা’।
বেষ্টনীতে থাকা চার পুরুষ ভালুকের সঙ্গি হিসেবে সংষ্পর্শে রাখা হয় স্ত্রী ভালুক জরিনা এবং কারিনাকে। তন্মধ্যে সম্প্রতি দুটি বাচ্চা প্রসব করেছে জরিনা। যা সাফারি পার্কের ইতিহাসে এশিয়াটিক কালো ভালুক প্রজননে বড় ধরণের সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ এই প্রজাতির ভালুক এশিয়ার মধ্যে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে তথা বিপদাপন্নের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। জরিনার ঘরে আসা নতুন দুই অতিথি বাচ্চার চোখ ফুটলেও এখনো লিঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। লিঙ্গ শনাক্তের জন্য অন্তত দুইমাস সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন পার্ক কর্তৃপক্ষ।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৮ সালের শুরুর দিকে পার্কের আরেক বেষ্টনীর পুরুষ ভালুক জ্যাকবনের দুই স্ত্রী মৌসুমি ও পূর্ণিমার সংসারে তিনটি ভালুক বাচ্চা জন্ম নেয়। যা সাফারি পার্ক তথা দেশি-বিদেশি পর্যটক-দর্শনার্থীদের জন্য সুখবর এবং বিরল ঘটনা ছিল। এবার জরিনার ঘরে জন্ম নেওয়া দুই বাচ্চাকে ঘিরে তাদের লালন-পালনে পার্ক কর্তৃপক্ষের বেশ তোড়জোড় চলছে।
স্ত্রী ভালুক জরিনার বেষ্টনীর কাছে গিয়ে দেখা গেছে, বেষ্টনীতে থাকা স্ত্রী ভালুক কারিনা এবং পুরুষ ভালুকগুলোর কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে দুই বাচ্চাসহ মা জরিনাকে। কিছুক্ষণ পর পর গর্তের ভেতর ঢুকে গিয়ে দুই বাচ্চাকে বুকে আগলে রেখে দুধ খাওয়াচ্ছে মা জরিনা। স্বচক্ষে দেখা না গেলেও গর্তের ভেতর থেকে একটু একটু শব্দ বেরুচ্ছে দুধ খাওয়ানোর। এ সময় মানুষের গন্ধ পেয়ে দুই বাচ্চাকে গর্তের ভেতর রেখে একবার বেরুচ্ছে আবার ঢুকে পড়ছে। তবে কৌশলে ছবি সংগ্রহ করা হয় ভালুকের দুই বাচ্চার।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং বাংলাদেশ বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সাবেক প্রধান কর্মকর্তা বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ ড. তপন কুমার দে জানান, এশিয়াটিক ব্ল্যাক বিয়ার তথা কালো ভালুক বর্তমানে বিপদাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এরা নিশাচর ও একাকী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। মূলত জঙ্গলাকীর্ণ খাঁড়া পাহাড়ই এদের অন্যতম আবাসস্থল।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি বনাঞ্চলে মাঝে-মধ্যে এদের দেখা মেলে। এরা দেখতে কুচকুচে কালো বর্ণের এবং দেহের বুকের অংশে ভি আকৃতির দাগ রয়েছে। উচ্চতায় চার থেকে ছয় দশমিক পাচ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর ওজন ৬ মাস পরবর্তী সর্বনিন্ম ৫০ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ২৮০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। খাদ্যাভ্যাসে এই প্রজাতির ভালুক সর্বভূক। যোগ করেন ড. তপন কুমার দে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভেটেরিনারী সার্জন (বন্যপ্রাণি চিকিৎসক) মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পার্কের বেষ্টনীতে প্রসবকৃত দুই বাচ্চাকে নিয়ে মা জরিনা বেশ ফুরফুরে মেঁজাজে রয়েছে। প্রায় ১৫দিন আগে জন্ম নেওয়া বাচ্চা দুটিও বেশ সুস্থ ও সবল রয়েছে। জন্মের সময় একেকটি বাচ্চা ৫০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
পার্কের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিপদাপন্ন প্রাণির তালিকাভুক্ত এশিয়াটিক ব্ল্যাক বিয়ারের আবদ্ধ অবস্থায় প্রজনন সাফারি পার্কের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। কেননা আবদ্ধ অবস্থায় থাকার কারণে ঢাকা চিড়িয়াখানায় ভালুকের প্রজনন হয়না। সেখানে এই সাফারি পার্কের ভালুক বেষ্টনীর কাছে মাটির সংস্পর্শে থাকায় এনিয়ে পর পর তিনবার প্রজননে সফলতা এসেছে।
মাজহারুল আরো জানান, একটি প্রাপ্ত বয়স্ক ভালুক প্রতিদিন আড়াই কেজি করে খাবার খেয়ে থাকে। তন্মধ্যে মধু, পাউরুটি, শসা, ডিম, কলা, মিষ্টি লাউ, গাজর অন্যতম। তিনি বলেন, ‘এনিয়ে পার্কে তিনবার এই প্রজাতির ভালুকের প্রজনন হয়েছে।’
চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা এবং বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক আবু নাছের মো. ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, ‘দিন দিন এই পার্কটি বন্যপ্রাণি সমৃদ্ধ পার্কে পরিণত হতে চলেছে। শুধু তাই নয় আগেও এই পার্কটি সিংহ, বাঘ, ওয়াইল্ডবিষ্ট, জলহস্তি, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণির যথেষ্ট প্রজনন হয়েছে। এবার দুটিসহ তিনদফায় ভালুকের প্রজনন হয়েছে বিপদাপন্নের ঝুঁকিতে থাকা বেশ কয়েকটি এশিয়াটিক ব্ল্যাক বিয়ার। যা আবদ্ধ অবস্থায় প্রজজন সাফারি পার্কের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।’
এই কর্মকর্তা আরো জানান, পার্কে ভালুক আবদ্ধ অবস্থায় থাকলেও যখন সন্তান প্রসব করার সময় আসে তখন নিজেরাই খাঁচার কাছে বেষ্টনীর ভেতর টিলা শ্রেণির মাটির নিচে এক ধরণের ডেন (উঊঘ) তথা গর্ত কুঁড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। আর সেখানেই বাচ্চা প্রসব করে এবং তীক্ষè দৃষ্টিতে রাখে বাচ্চাদের। যাতে কোন মানবের নজর না পড়ে।