আরটিভি : গবেষণায় জালিয়াতির প্রমাণ মেলায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) একজনের পিএইচডি ডিগ্রি বাতিলসহ তিনজন শিক্ষকের পদাবনতি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মাসিক সিন্ডিকেট সভায় তিনজনের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অধ্যাপক সামিয়া রহমান। তিনি আরটিভি নিউজকে বলেন, সিন্ডিকেট সভার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করবেন। কারণ আদালত ডকুমেন্ট দেখবে, শিক্ষক রাজনীতির নোংরা খেলা খেলবে না আদালত।
জানা গেছে, গবেষণা নকল করার অভিযোগে প্রায় চার বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী ফোরাম ‘সিন্ডিকেট’। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের বিরুদ্ধে গবেষণায় লেখা চুরি বা প্লেজারিজমের অভিযোগ ওঠে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়াও একই অভিযোগে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুকের ডিগ্রি বাতিল করা হয়। তার শাস্তির ব্যাপারেও ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল।
অবশেষে ২৮ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার গবেষণায় জালিয়াতির দায়ে একজনের পিএইচডি ডিগ্রি বাতিলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) তিন শিক্ষকের পদাবনতি করা হয়। তথ্যটি নিশ্চিত করে সিন্ডিকেট সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. হাসানুজ্জামান বলেন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে থিসিসে জালিয়াতি করায় তার পিএইচডি ডিগ্রি বাতিলসহ তাকে লেকচারার পদে অবনমন করা হয়েছে। এছাড়া গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমানকে সহকারী অধ্যাপক পদে অবনমন করা হয়েছে এবং অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানকে আগামী দুই বছর কোনও পদোন্নতি দেয়া হবে না।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, গঠিত দুটি ট্রাইব্যুনালের সুপারিশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিন্ডিকেট।
সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, যাদের শাস্তি হয়েছে, তাদের আর ঢাবির সিন্ডিকেট সভায় আপিলের সুযোগ নাই। তারা চাইলে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করতে পারবে।
ঢাবির সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে অধ্যাপক সামিয়া রহমান আরটিভি নিউজকে আরও বলেন, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ স্যার বলেছিলেন আমার বিভাগে দুজন শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে শাস্তি চেয়েছে। তখনই আমি আমার থিসিস প্রত্যাহারের কথা বলেছিলাম। কিন্তু ফরিদ স্যার সেটি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন। ফরিদ স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারের সিন্ডিকেটে থিসিসের বিষয়টি উত্থাপন করেননি। কারণ আরেফিন স্যার জানেন আমার নামে যে থিসিস জমা দেওয়া হয়েছে, সেটিতে আমার কোনও স্বাক্ষর নেই। এজন্য থিসিসটি সিন্ডিকেট সভায় তোলার প্রয়োজন মনে করেননি। ট্রাইব্যুনালও গঠন করা হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল থিসিসের কোথাও আমার স্বাক্ষর খুঁজে পায়নি।
সামিয়া রহমান বলেন, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ফরিদ স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলেন- এবার থিসিসের বিষয়টি সিন্ডিকেট সভায় তুলবেন। কারণ এ প্রশাসন আমার (সামিয়া) বিরুদ্ধে। তারা আমাকে শাস্তি দেবেন। তখন আমি বললাম আমার বিরুদ্ধে কেন? তখন ফরিদ স্যার আমাকে বলেন- অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান তার (ফরিদ স্যার) বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। আরেফিন স্যারও ফরিদ স্যারের বিরুদ্ধে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সেজন্য তিনি (ফরিদ স্যার) আমার ওপর প্রতিশোধ নেবেন। ফরিদ স্যার জানেন আমি আরেফিন স্যারের অনুসারী। তখন আমি স্যারকে (ফরিদ) বললাম এখানে আমাকে জড়াচ্ছেন কেন। আমার বিভাগের দুজন শিক্ষকে দিয়ে ফরিদ স্যার ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে চিঠি পাঠান। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে যাতে আমার বিরুদ্ধে চিঠি দেয়। ২০১৭ সালের এক মাসের তদন্ত কাজ প্রায় চার বছর লাগানো হয়েছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত টেনে আনা হলো। তদন্ত কমিটির দীর্ঘসূত্রতা, আমি (সামিয়া) তদন্ত কমিটির সদস্য পরিবর্তনের জন্য ঢাবির ভিসি বরাবর চিঠি দিয়েছিলাম। ভিসি চিঠি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য পরিবর্তন করলেন না। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত আমার থিসিস জালিয়াতি কোনও দালিলিক প্রমাণ পায়নি। কারণ আমি কোথাও থিসিস জমা দেইনি।
তিনি আরও বলেন, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান নিজে তদন্ত কমিটির কাছে দায় স্বীকার করেছেন। সে থিসিসের কপি জমা দিয়েছেন। আর আমি মারজানকে ২০১৫ সালে মেইল পাঠিয়েছিলাম। শুধু মারজান নয়, আমি আমার অসংখ্য ছাত্রদের থিসিসের জন্য আইডিয়া দেই। মারজান থিসিস আমাকে না দেখিয়েই জমা দেয়। ২০১৬ সালে থিসিস জমা দেওয়ার আগমূহূর্তে খবর আসে যে আমার এক আত্মীয় দেশের বাইরে গুরুত্বর অসুস্থ হয়েছেন। তখন আমি দেশের বাইরে চলে যাই। দেশে ফিরে শুনি আমার আর মারজানের লেখা (থিসিস) ডিন অফিস থেকে হারিয়ে গেছে। আমি তখন প্রশ্ন করি, ডিন অফিস থেকে কিভাবে লেখা হারায়। এরপরও মারজানকে আমি ফোন দিলাম, মারজান তখন আমাকে বললো যে সে লেখা ডিন অফিসে জমা দিয়েছে এবং ডিন অফিস সেটি গ্রহণ করেছে। তখন মারজানের ওপর আমি রেগে যাই। এর আগেও মারজান আমার সঙ্গে বেয়াদুবি করেছিল। এজন্য মারজানের সঙ্গে আমার দূরত্বও বেড়েছে। আমি বিদেশে থাকা অবস্থায় লেখা ছাপানো হয়। পরে দেশে এসে লেখা প্রত্যাহারের জন্য ফরিদ স্যারকে বলি কিন্তু তিনি তা ধামাচাপা দিয়ে রাখেন।
সামিয়া রহমান বলেন, ট্রাইব্যুনাল সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে আমি থিসিস জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত না। এরপরও আমাকে ঢাবির সিন্ডিকেট দোষী সাব্যস্ত করেছে। আমার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ষড়যন্ত্র করেছে। তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তদন্ত শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রথম নারী ডিন ড. সাদেকা হালিম আমাকে বার বার (সামিয়া) দোষী সাব্যস্ত করেন। অথচ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে- আমার দোষ নেই। আমি দোষী হলে অ্যাডিটোরিয়াল বোর্ডকেও দোষী করতে হবে। মারজান তদন্ত কমিটির কাছে বারবার নিজের দোষ স্বীকার করে বলেছেন, সে অসাবধানতা ভুল করেছেন।
আমার বিরুদ্ধে অবশ্যই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত আমরা দোষী না, অন্যদিকে ঢাবির সিন্ডিকেট আমাদের দোষ প্রমাণ পেয়েছে। এখানে আমরা দোষী হলে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ পেত। সিন্ডিকেট ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত মেনে না নিলে কেন তাহলে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল? আরেফিন স্যার ভিসি থাকা অবস্থায় সিন্ডিকেটে থিসিস জালিয়াতির তথ্য কেন তোলা হলো না। আজকে কেন থিসিস জালিয়াতি সেই তথ্য সিন্ডিকেট সভায় তোলা হলো। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। মারজান অপরাধ করলেও আমি অপরাধ করিনি। এখানে আমাকে কেন শাস্তি দেওয়া হলো। ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত ও আমার কাছে থাকা তথ্যগুলো সিন্ডিকেট সভা উড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান অধ্যাপক সামিয়া রহমান।
গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অপরাধে ঢাবির সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ মোহাব্বত খান আরটিভি নিউজকে বলেন, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি সংজ্ঞা কাকে বলে। আর চৌর্যবৃত্তির সংজ্ঞা কারা তৈরি করেছেন। সেটি তো শিক্ষকদের আগে জানতে হবে। কারণ অধিকাংশ সময়ে সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল তাকেই সুসংহত দর্শনের রূপ দিয়ে তাদের চিন্তাভাবনাগুলো উন্মেষ ঘটানো হয়। এখানে নতুনত্ব বলতে কিছুই নেই। তাদের বক্তব্যগুলো সকলে ঘুরে ফিরে লেখছেন।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যিনি চৌর্যবৃত্তির বিচার করেন তিনি কি বিচারক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে। সবার আগে চৌর্যবৃত্তি সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। সকল শিক্ষককের সম্মতিতে চৌর্যবৃত্তির সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। আমাদের এখনও চৌর্যবৃত্তির সুনির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা নেই। গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি করলে সেখানে শাস্তি হোক এটি চাই কিন্তু গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি কাকে বলে সেটির আগে সংজ্ঞায়িত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সামিয়া রহমান ও মাহফুজুল হক মারজান যৌথভাবে একটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেন। ‘এ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার: এ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ শীর্ষক আট পৃষ্ঠার প্রবন্ধটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’ নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অভিযোগ ওঠে, গবেষণা প্রবন্ধটিতে ১৯৮২ সালের শিকাগো ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’তে প্রকাশিত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নিবন্ধ থেকে প্রায় পাঁচ পৃষ্ঠা হুবহু নকল করা হয়েছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এক লিখিত অভিযোগে নকলের কথা ঢাবিকে জানায় ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস। এ ছাড়া বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদের ‘কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম’ গ্রন্থের কয়েকটি পাতাও হুবহু নকল করেন তারা।
গবেষণা জালিয়াতির অপরাধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের সাজার বিষয়ে কথা বলতে চান না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।