মাহদী হাসান রিয়াদ

এই নশ্বর পৃথিবী পরিবর্তনশীল। কালের আবর্তনে কিছুনা কিছুর পরিবর্তন হয়ে থাকে রোজদিন। কখনও মানুষের পরিবর্তন, কখনও আবার মনের পরিবর্তন। সময় নামক ওই বাহনে চড়ে কখনও মানুষের জীবনে সুখ আসে; কখনও আবার অথই সাগরের মাঝে অসহায়ের বেশে সুখ ভাসে৷ ফের দুখ আসে, দুখ হাসে।
মানুষের জীবন বড়ো অদ্ভুত! বিবিধ রহস্যে ঘেরা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ‘জীবন এক জটিল কঠিন অঙ্কের নাম; যার সুত্র কারোরই জানা নেই।’

আজ আমাদের তৃতীয় বিচ্ছেদ বার্ষিকী! তিন বছর আগে ঠিক আজকের দিনে আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছিল। দুইজন দুই দ্বারে- দুই প্রান্তে চলে গিয়েছিলাম! সেদিন আমার শান্তিপুরে আগুন লেগে সুখ-শান্তির অকাল মৃত্যুর হয়েছিল। আর আমি নিঃস্ব হয়ে অশান্তিপুরে হিজরত করে ছিলাম।

মাঝেমধ্যে শান্তিপুরের কথা খুব মনে পড়ে; মনে পড়ে ওই গ্রামের মালিক আদিবা জান্নাতের (আমার প্রাক্তন স্ত্রীর) কথাও। তখন বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। মনের আকাশে মেঘ জমে। অতঃপর মনখারাপরা লোনাজল হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। শান্তিপুরে যখন মন খারাপ হত, শয্যায় বসে আমি চাঁদ দেখতাম। চাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। চাঁদ তখন চোখ খুলত; অবাক বিস্ময় তাকিয়ে মৃদ হেসে বুকে জড়িয়ে নিত। আমার মনখারাপরা মুহূর্তেই পগারপার হয়ে যেত। এখন অবশ্য সেই দিন আর নেই! কালের আবর্তনে দিন পরিবর্তন হয়েছে। দুইজন দুই শহরের বাসিন্দা আজ, দুই শহরে বাসস্থান। শত চেষ্টা আর প্রবল ইচ্ছেশক্তি থাকা সত্বেও যে তার কাছে যাওয়া সম্ভব নয়! (এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক) এই তিন শব্দ আমাদের মাঝে বিস্তর ফারাক সৃষ্টি করে দিয়েছে। একে অপরকে দূরে ঠেলে দিয়েছে৷ অনেকটা দূরে। কাছে যাওয়ার, পাশাপাশি হওয়ার সম্ভাবনা জিরো পার্সেন্ট বললেই চলে৷
তারপরও মন খারাপের মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে ফোন দিই। ফোন দিয়ে বিরক্তি করি। মুঠোফোনের কল্যাণে একটু-আধটু কথা হয়। অবশ্য আজও হয়েছে…

—হ্যালো, কে- আদিবা বলছো?
—আস্সালামু আলাইকুম। জি, আদিবা বলছি।
— ওয়ালাইকুম আস্সালাম৷
— কী অবস্থা? কেমন আছেন?
—আগে কেমন ছিলাম জানি না! এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। বেশ ভালোই আছি৷ তুমি কেমন আছো?
—হুঁ, ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। রাতের ভোজন সেরেছেন?
—হুম, সেরেছি। দুইটা রুটি আর আধা সেদ্ধ তিতকরলা ভাজি।
— ভাত না খেয়ে রুটি খাচ্ছেন কেন? ইদানীং মোটা হয়ে যাচ্ছেন বোধহয়? ডায়েটকন্ট্রোল করছেননা তো?
— তোমার কথা শুনে খুব হাসতে ইচ্ছে করতেছে। যা ভাবতেছো, তেমন কিছু নয়। ডায়বেটিস বেড়ে গেছে। নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয়। ভাতের দ্বারে-কাছে যাওয়া বিলকুল হারাম করে দিয়েছেন ডাক্তার মশাই।
—ওহ্, আপনার তো ডায়বেটিস ছিল!
—জি, ছিল। এখনও আছে, যায়নি তো!
—হঠাৎ ফোন দিলেন যে? বিশেষ কোনো প্রয়োজন?
— না! আয়োজন ছাড়া প্রয়োজন অর্থহীন। যার জন্য কোনো আয়োজন করা হয় না, তার কোনো প্রয়োজন পড়ে না৷ ছোটখাটো একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ফোন দিছি৷ কেন ফোন দিছি সত্যিই কী তুমি জানো না?
—না, জানি না! আপনি না জানালে কীভাবে জানবো? আমি কী গায়েব জানি?
— আজ আমাদের তৃতীয় বিচ্ছেদ বার্ষিকী! এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?
— ভুলি নিই। এতটা আলাভোলা নই আমি। মনে আছে; দিবালোকের ন্যায় সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে। তবে, তা নিয়ে ভাবতে চাই না। ভাবার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছাও নেই।
—এসব ছাড়ো তো, এবার বলো— নতুন মানুষের সাথে দিনকাল কেমন কাটাচ্ছ? ওনি কী আমার মতো ঝগড়াটে? অল্পতে রেগে যায়? নাকি খুব সহজে সবকিছু মেনে নেয়?
— হাউ ফানি! প্রতিবারই আপনার এই হযবরল প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। এসব ভুল তথ্য কে পাচার করে আপনাকে?
— কে পাচার করবে আবার? তথ্য পাচার করার মতো কেউ আছে নাকি আমার? হুদাই আন্দাজে বললাম।
— ওহ্, সেটা বলবেন তো। নতুন বলতে এখন আমার কাছে কিছু নেই। সবকিছু পুরোনো। পরনের শাড়িটা পর্যন্ত সাড়ে তিনছবর আগের কেনা। এভাবে দিব্যি চলছে দিনকাল। বাকি জীবনও পুরোনো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে, বুকে লালন করে বাঁচতে চাই।

নতুন মানুষকে নিয়ে আপনি কেমন আছেন সেটা বলেন, একটু শুনি?
যা মনে হচ্ছে, ওনি নিশ্চয়ই আমার চেয়ে অনেক বেশি কেয়ারিং, তাই না?
—খুব তো বলছিলা— কেউ একজন ভুল ইনফরমেশন পাচার করে আমাকে! এখন বলো— এই উদ্ভট ইনফরমেশন কে পাচার করলো তোমাকে?
—কেউ না। আপনার মতো হুদাই বলে দিলাম।
—আমার জীবনেও নতুন কেউ আসে নি। হয়তো আসবেও না। আসতে দেবও না! কী প্রয়োজন- শুধুশুধু নতুন কাউকে এনে কষ্ট দেয়ার? আমি যে এখনও মনেপ্রাণে একজনকে ভালোবাসি। প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসি। হৃদয়ের ক্যানভাসে স্রেফ তারই বিচরণ। তাকে নিশ্চিত পাব না জেনেও এমন করাটা অবশ্য বোকামি৷ বাড়াবাড়িও বটে! তারপরও মনকে বলি— কাছে নাহয় না-ই বা গেলাম, ক্ষতি কিসের? বরঞ্চ দূর থেকেই ভালোবাসি; এভাবেই তো ভালো আছি…

তবে, তোমাকে ছাড়া এখন অবসর সময় কাটে না। হুটহাট চোখের কোণে জল চলে আসে। একাকিত্ব নিয়ম করে রোজ দুই বেলা আমাকে কাঁদায়। মাত্রাতিরিক্ত পীড়া দেয়! নিয়তির নির্মম অত্যাচারে আজ অতিষ্ঠ প্রায় আমি। তবুও নীরবে-নিভৃতে সহ্য করে যাচ্ছি। এ ছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই। বাস্তবতা এখন আমাকে সুদেআসলে বুঝিয়ে দিচ্ছে— আমার জীবনে তোমার প্রয়োজনতা কতটুকুন ছিল।

মাঝেমধ্যে মনে হয়— এমন এক অদ্ভুত জগতে বাস করতেছি আমি; যেখানে কেউ নেই; কেউ থাকে না। আমি একাই আছি— একাই থাকি। চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ, নিগূঢ় আবছা আলোয় আচ্ছাদিত। কোনোখানে আলো নেই৷ এই জগতে রাত থাকলেও চাঁদও নেই; নেই নক্ষত্রও।

আদিবা! আমার অনুপস্থিতিতে তুমিও কি এমন ভয়ানক জগতে পাড়ি জমাও? এক পাহাড় মন খারাপ এসে তোমার মাথায় ভর করে? চোখগুলো কি ঝর্ণার রূপ নেই? সাগরের ঢেউয়ের মতো আবেগও ওঠা-নামা করে? ভূমিকম্পের ন্যায় মনোকম্প হয়? তখন কি দেড় ইঞ্চি কলিজাটা তরতর করে কেঁপে ওঠে? গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়?

হ্যালো, হ্যালো, হ্যালললললো! কথা বলছো না কেন?
আদিবা, এই আদিবা?
সম্ভবত মেয়েটা বলনশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। স্পষ্ট কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। বেচারি আর কিছুই বলতে পারে নি। ট্রুট, ট্রুট! অতঃপর সংযোগ বিচ্ছিন্ন!

প্রিয় বিবাহিত ভাই-বোনদের উদ্দেশ্য করে একটা কথায় বলতে চাই—হারিয়ে যাওয়ার পরই হারানো জিনিসের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়। আমিতো উপলব্ধি করছি এখন! তাই করজোড়ে অনুরোধ করে বলছি— না হারানোর আগেই গুরত্ব দিন, যত্ন নিন। হ্যাঁ, মানছি; মেয়ে মানুষের আকলের পরিধি একটু কমই হয়ে থাকে৷ অস্বাভাবিক কিছু নয়। কী আর করার, স্রষ্টা তো তাদেরকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তাই ছোটখাটো অনেক কিছু মেনে নিতে হবে। মানিয়ে চলতে হবে। অবশ্য একটু কষ্ট হবে, তারপরও চিরস্থায়ী কষ্টের তুলনায় এ কষ্ট তো সামান্য কিছু। একদমই সামান্য। বলতে গেলে— বর্তমানে আমার একমিনিট একাকীত্বের সামনে এ কষ্ট কিচ্ছু না। আল্লাহ সবাইকে সহীহ্ বুঝ দান করুন। জীবন চলার পথে ধৈর্য ধারণ করার তাওফিক দান করুক৷ আমীন, আমীন, ছুম্মা আমীন। পরিশেষে সকালের দাম্পত্য জীবনের সুখ কামনা করছি, পৃথিবীর সব মানুষ সুখী হোক। সুখ সাগরে সাঁতরে বেড়াক।