জসিম উদ্দীন:
কক্সবাজারে শিশুর জন্ম নিবন্ধনে প্রয়োজন পড়ছে বাবা মায়ের জন্ম নিবন্ধন সনদ। আবার বাবা মায়ের জন্ম নিবন্ধন করতে হলে লাগছে তাদের বাবা মায়ের জন্ম নিবন্ধন সনদ। অর্থাৎ একজন ভর্তিচ্ছু শিশুর জন্য দাদা দাদির জন্ম নিবন্ধন সনদেরও প্রয়োজন পড়ছে। জন্ম নিবন্ধনের বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়ার কারণে এ বছর প্রায় দুই লাখ শিশুর স্কুল ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

ভর্তির ক্ষেত্রে শিশুদের অনলাইন জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করায় এই বিপত্তি শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩ বছর ধরে কক্সবাজার জেলার ৭১ টি ইউনিয়ন পরিষদ ও ৪টি পৌরসভায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সনদ কার্যক্রম বন্ধ ছিল।গত ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট থেকে পর্যায়ক্রমে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হলেও তা নিয়ে সন্তুষ্ট নন স্থানীয়রা। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া এখনও শুরুই হয়নি।

নতুন নিয়মে সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করতে প্রয়োজন বাবা ও মায়ের জন্ম নিবন্ধনের কাগজ। বাবা কিংবা মায়ের জন্ম নিবন্ধনের প্রয়োজন পড়ছে তাদের বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন। অর্থাৎ শিশুর জন্ম নিবন্ধনে দাদা-দাদীর জন্ম নিবন্ধনের কাগজের প্রয়োজন পড়ছে।

কক্সবাজার পৌরসভা এলাকার নাছরিন সুলতানা (২৫) বলেন,আমি জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে ৬ বছরের মেয়ে আমরিন নূরাইনকে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার শহরের এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে অবিরাম ছুটছি। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কোন স্কুলে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন ছাড়া মেয়েক ভর্তি করাতে রাজি হয়নি।

তিনি বলেন, আমাদের স্মার্ট কার্ড, স্থানীয় জন প্রতিনিধির প্রত্যায়ন, বাসা-বাড়ির বিদ্যুৎ বিল, জায়গা জমির খতিয়ানসহ পর্যাপ্ত দলিল দেওয়ার পরও শিশুর অনলাইন জন্ম নিবন্ধন ছাড়া ভর্তি নিচ্ছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ।

নাছরিন বলেন, জন্ম নিবন্ধন করতে গিয়ে দেখি অদ্ভুত কিছু শর্ত প্রয়োগ করা হয়েছে। যা অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে কারও পক্ষে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব না।

জন্ম নিবন্ধনের কারণে এখনও সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি কক্সবাজার পৌরসভার বাসিন্দা, ওয়াহিদুর রহমান রুবেল,আমিনুল ইসলাম, মো. আলমগীরসহ আরও অনেকেই।

আবার অনেকে নানা ভোগান্তি শেষে নতুন জন্ম নিবন্ধনের অবেদন করতে পারলেও এখনো পর্যন্ত জন্ম নিবন্ধন সনদ হাতে না পাওয়া সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন।

অভিভাবকরা বলেছেন, পিতা মাতার স্মার্ট কার্ড,স্থানীয় জনপ্রতিনিধির প্রত্যায়ন,বাসা বাড়ির বিদ্যুৎ বিল, জায়গা জমির খতিয়ানসহ পর্যাপ্ত দলিল দিয়েও শিশুর অনলাইন জন্ম নিবন্ধন ছাড়া ভর্তি নিচ্ছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ।

কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন,আমার ইউনিয়নে হাজারেরও অধিক জন্ম নিবন্ধনের আবেদন জমা পড়েছে।কিন্তুু কার্যক্রম চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র শতাধিক জন্মনিবন্ধন সনদ সম্পন্ন হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রত্যায়ন দিয়েই শিশুদের স্কুলে ভর্তির সুযোগ দেয়া উচিত। দীর্ঘদিন নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আরোপিত শর্তগুলো সম্পন্ন করে এত অল্প সময়ের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন সনদ পাওয়া সম্ভব না।

তিনি উল্লেখ করেন, সদরের ১১টি ইউনিয়ন একটি পৌরসভায় প্রতিদিন হাজার হাজার জন্ম নিবন্ধন আবেদন জমা পড়ছে। কিন্তু তা যাচাই বাছাই করতেও তো অনেক সময় লাগবে।

শিশুদের স্কুল ভর্তি নিয়ে এমন অবস্থার কথা উল্লেখ করে বিদ্যালয়ে শিশুদের ভর্তির কার্যক্রম সহজ করার দাবি জানান জেলার অন্যান্য চেয়ারম্যানরাও।

স্থানীয়দের অধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকা সংগঠন ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। সংগঠনটির সমন্বয়ক নাজিম উদ্দিন বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। সে কারণে বোধ হয় আমাদের এত হয়রানি। নিজেদের এলাকায় আজ নিজেরাই শরণার্থী হয়ে গেলাম।

তিনি বলেন, প্রতিনিয়তই নাগরিক সেবা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কক্সবাজারের বাসিন্দারা। এবার আর সহ্য করা হবে না। হঠাৎ স্কুল ভর্তিতে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করায় প্রায় দুই লাখ শিশু বাদ পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

একজন শিক্ষার্থীও যদি জন্মনিবন্ধন জটিলতায় স্কুলে ভর্তি হতে না পারে আমরা কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আসাদুজ্জামান চৌধুরীর বলেন, আমরা সমস্যাটিকে গুরুত্ব নিয়ে দেখছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানানো হবে।

বিষয়টি কক্সবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশিদকে অবগত করা হলে তিনি বলেন, কক্সবাজার জেলার জন্য আলাদা নিয়ম সেটি আমার জানা ছিল না। শিশুদের স্কুল ভর্তির বিষয়টি বিবেচনা করে দ্রুতই কোন ব্যবস্থা নেব।

উল্লেখ্য, কক্সবাজার জেলায় ৬৬৫টি টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর বাইরে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এসব বিদ্যালয়ের প্রতিবছর ৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে থাকে। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালেয় ভর্তি হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। জন্ম নিবন্ধন সনদের কারণেই এমন বিপত্তি।