শাহীন মাহমুদ রাসেল:

কক্সবাজার সদর ও রামু উপজেলার কয়েক হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ পানির অভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাঁকখালী নদীর পানি নির্ভর এসব জমিতে পানি সেচ ও সংরক্ষণ পদ্ধতিতে কোনো তদারকি না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছ। কতিপয় দুস্কৃতিকারী কর্তৃক নদীর উপর অন্যায্য আচরণের ফলে পানি সংরক্ষণ এবং সেচ ব্যবস্থাপনায় বারবার বিঘ্ন ঘটছে। যার ফলে শুষ্ক মওসুমে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে কৃষকের কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি। আর অনাবাদি থাকার সুযোগে লুট হয়ে যাচ্ছে ওই মাটির উপরের অংশ (টপ সয়েল)। অন্যদিকে ফের জোড়াতালির বাঁধ নির্মাণ করে ৫হাজার চাষি পরিবারের স্বপ্ন ও ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে এলজিইডির টিকাদার ফারুক। কক্সবাজার সদরের বাঁকখালী নদীর চান্দেরপাড়া পয়েন্টে অবস্থিত রাবার ড্যামটি দুস্কৃতিকারী চক্র কর্তৃক ধ্বংস করে ফেলার প্রায় বছর খানেক পর এখন নতুন একটি বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে এই বাঁধ নির্মাণে কাল ক্ষেপন হওয়ায় পুরো একটি মৌসুম চাষাবাদ বঞ্চিত হয়েছে কৃষকরা। দীর্ঘ সময় পর এবার বাঁধ নির্মাণ কাজে হাত দিলেও কৃষকদের মাঝে নতুন করে সংশয় দেখা দিয়েছে এই বাঁধ নিয়ে। কৃষকরা বলছেন- এমনিতেই বাঁধ নির্মাণে অনেক দেরি করে ফেলেছে। তার উপর উক্ত বাঁধ নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ও পদ্ধতি ব্যবহার করায় নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে- বাঁকখালী নদীতে কৃষিকাজে সহায়তা মূলক বিকল্প অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে খুবই ধীরগতিতে। কৃষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী উক্ত বাঁধ নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ও কাজে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করার প্রমাণও পাওয়া গেছে। অন্যদিকে কাজটিতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতি মুনাফার সুযোগ খুঁজছে টিকাদার ও সংশ্লিষ্টরা। এমনকি অর্থের অভাবে যেকোনো মুহুর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে কাজটি। মাত্র ৩৫ শতাংশ কাজে বাজেটের সব টাকাই খরচ হয়ে গেছে এমনটি দাবী করেছেন টিকাদার ফারুক। অথচ কাজের সিডিউল অনুযায়ী সেখানে কোনো কিছুই সরবরাহ করা হয়নি। আর যেসব উপাদান সরবরাহ করা হয়েছে অধিকাংশই নি¤œমানের। প্রত্যেকটি সামগ্রীর দাম ধরা হয়েছে বাজার দরের চাইতে দশগুণ বেশি। এছাড়াও পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রমিক মোতায়েন না করায় কাজে অত্যন্ত ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। এরফলে নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ায় কৃষকরাও পড়েছেন বেকায়দায়। গত মৌসুমের মতো এই মওসুমেও চাষাবাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়- কক্সবাজার সদরের দুই ইউনিয়ন ঝিলংজা এবং পিএমখালীর ২হাজার হেক্টর জমি এবং রামু উপজেলার ৮হাজার হেক্টর জমির বোরো চাষাবাদ এই নদীর পানির উপর নির্ভরশীল। চাষীদের নিরাপদ সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে ১৯৯৫ অর্থবছরে কক্সবাজার স্থানীয় সরকার অধিদপ্তর (এলজিইডি)র অর্থায়নে প্রায় ৩/৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাঁকখালী নদীর চান্দেরপাড়া পয়েন্টে একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করেছিলো। কিন্তু এই রাবার ড্যামটি নির্মাণকালে নানা অনিয়মের কারণে ২০০১ সালে হঠাৎ করে ড্যামের একাধিক পয়েন্টের রাবার খুলে যায়। পরে মেরামত করার পরও ২০০৫ সালে চাষাবাদের মাঝামাঝি সময়ে আবারও রাবার ছিঁড়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে বিগত বছরগুলো। সর্বশেষ গত ২০২০ সালের বোরো মৌসুমেও একইভাবে দু’বার ওই রাবার ড্যামের রাবার ছিঁড়ে গেলে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে জোড়াতালি দিয়ে কোনো মতে বোরোর মৌসুম শেষ করা হয়।

বারবার রাবার ড্যামটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে জানতে চাওয়া হলে দক্ষিণ পাতলি এলাকার কৃষক কামরুল এহেসান প্রতিবেদককে জানান- কতিপয় প্রভাবশালী চক্র বাঁকখালী নদী থেকে বড় বড় ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে প্রচুর পরিমাণ বালি উত্তোলন করেছে। এরফলে ড্যামের নীচে স্থিতিশীল অংশটি ক্রমান্বয়ে দেবে গিয়েছে। আর যখনই পানির গতি স্রোত ড্যামটির উপর কার্যকর হতে থাকে তখনই ড্যামের উভয়পার্শ্বে ভেঙে যায়।

অপর দুই কৃষক আব্দুল হক ও নুরুল আমিন জানান- মূলত রাবার ড্যামটির রক্ষণাবেক্ষণকারী কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা, অব্যবস্থাপনা, চরম উদাসীনতা, নানা অনিয়ম দুর্নীতি এবং আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের কারণে আজ উপকারভোগী কৃষকরা চরম হতাশায় ভুগছেন। এছাড়াও প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুম এলে ইটভাটা মালিক সমিতির সাথে আঁতাত করে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে কালক্ষেপন করে রাবার ড্যামটি চালু করে। একারণে প্রতিবছর শত শত হেক্টর জমির আবাদ ব্যহত হয়। কিন্তু চলতি মওসুমে এসে একেবারেই অকেজো হয়ে যাওয়ায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে অত্র অঞ্চলের চাষাবাদ।

এবিষয়ে জানতে চাইলে টিকাদার ফারুক জানান- এটি মূলত চট্টগ্রামের মদিনা কনস্ট্রাকশনের কাজ। তারা লাভে কাজটি বিক্রি করে দিয়েছে। পরবর্তীতে এলজিইডি কর্মকর্তার অনুরোধে তিনি কাজটিতে হাত দিয়েছেন। কাজের মান ও অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি খুব চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেন। এছাড়াও ইতিপূর্বে খাল থেকে বিপুল পরিমাণ বালি উত্তোলণের ফলে গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় ধারণাতীত ব্যায় বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন। একারণেই মূলত কাজ শেষ হতে নির্দিষ্ট সময়ের চাইতে একটু বেশি সময় লাগছে। আর কোনো কারণ নেই।

অন্যদিকে এলজিইডি কর্মকর্তা (নির্বাহী প্রকৌশলী) আনিসুর রহমানও অনেকটাই টিকাদার ফারুকের সুরে কথা বলেন। তবে কাজে ধীরগতি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেন- টিকাদার হয়তো বেশি লাভ করতে গিয়ে এমনটি করে ফেলেছে। লাভ করাতো দোষের কিছু না।

উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালের আগে সবুজ বিপ্লবের আওতায় বাঁকখালী নদীতে প্রথম অস্থায়ী সেচবাঁধ নির্মাণ করে তৎকালীন সদরে শুষ্ক মৌসুমে ইরি-বোরো চাষের প্রবর্তন করা হয়।

সেই থেকে প্রতি বছর সরকারি বরাদ্দে বাঁকখালী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পৃথক অস্থায়ী সেচবাঁধ দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসা মিঠাপানি আটকে নদীর আওতায় প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে ইরি-বোরোর চাষ হয়ে আসছে। পরবর্তী সময় বাঁকখালী নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটের সৃষ্টি হয়। এতে পর্যায়ক্রমে চাষের জমির পরিমাণও কমে এসেছে। প্রায় সময় সঠিক সময়ে সরকারি বরাদ্দের অভাবে সেচবাঁধ নির্মাণ বিলম্বিত হতো, কোনো কোনো বছর সরকারি বরাদ্দ পাওয়াও যেত না। এভাবে বোরোর চাষাবাদে নানা সমস্যায় পড়ে কৃষকদের ফসল হানি ঘটত। এ সমস্যা হতে উত্তরণে কৃষকদের দাবি ছিল বাঁকখালী নদীতে একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করার।

কিন্তু বাঁকখালী নদীর সদরের চান্দেরপাড়া এলাকায় ১৯৯৫ সালে প্রায় ৩/৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করার পরও বোরোর চাষ নিয়ে কৃষকদের হতাশা কাটছে না বলে দাবী সংশ্লিষ্ট কৃষকদের।