✍️তৌহিদুল আরব

বর্তমান সমাজে অভিশপ্ত এক দীর্ঘ অধ্যায় হলো “বেকার “। যাদের নিয়ে লেখা হয় না কোন গল্প, কবিতা, নাটক কিংবা উপন্যাস! অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লিট করেও শিক্ষিত বেকার হয়ে সমাজে টিকে থাকা এক চরম অভিশাপ! প্রাপ্ত নম্বর আর সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে যখন সার্টিফিকেটের কাগজগুলোতে ময়লা পড়ে যায়, তখনও এই শিক্ষিত বেকার ছেলেরা নিদ্রাহীন রাত্রি কাটায়, চাপা কান্নায় বালিশ ভেজায়। শিক্ষিত বেকার ছেলেদের মুখ লুকোনোর জায়গার বড্ড অভাব। তারা চাইলেই ওপরে উঠতে পারে না, আবার নিচেও নামতে পারে না। এই অসহায় অবস্থায় চাপা আর্তনাদই তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
তাদের কান্না দেখার কেউ নেই, মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস দিয়ে বলার কেউ নেই ” আজ চাকরি পাস নি তো কি হয়েছে? হাল ছাড়িস না, নিশ্চয়ই চাকরি হবে। ” তাদের কেউ কখনো জিজ্ঞেস করেনা “কেমন আছিস? শরীর ঠিক আছে? “। তাদের শুধু একটা প্রশ্নই করা হয়
” কিরে, চাকরি টাকরি কিছু পেলি? নাকি এখনো ওই ইন্টারভিউই দিয়ে যাচ্ছিস?। ”

স্কুল, কলেজে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করা মাঝের সারির ছাত্রটা যখন চাকরি পায় না, তখন নয়টা – পাঁচটা অফিস করা বন্ধুরা আর বেকার ছেলেটাকে চিনতে পারে না।

বেকার ছেলেটা বাড়ি থেকে বের হয় সকালে আর ফেরে অনেক রাতে। বাড়ি ফিরতে তার ভয় হয়, লজ্জা লাগে। বিষণ্ণ মুখে দু’টো খাবার পাতে দেয়ার সময় পরিবারও চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ” তুই বেকার “।

যখন সংসারের হাল ধরেছে পাশের বাড়ির সমবয়সী ছেলেটা, তখন বাবার কাছে হাত পেতে দৈনিক পকেট খরচ নেয়াটা গলার কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। অপমানে মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে বেকার ছেলেটার।

বিভিন্ন চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বয়স যখন তিরিশ ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখন নিজেকে পৃথিবীর বস্তাবন্দি আবর্জনা মনে হয়। আধবুড়ো বেকার ছেলেটাকে দেখে মানুষ এমনভাবে তাকায় যেন তার বেঁচে থাকাটাই এক মস্ত পাপ!

একের পর এক বিয়ে ভাঙার যন্ত্রণা আর পরিবারের বাড়তি চাপে অসহায় প্রেমিকা যখন সব আকুলতা ঢেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে “আর কতদিন! ” তখন বেকার ছেলেটার বুক ফেটে কলিজাটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। কিছুই বলতে পারে না সে। লজ্জায়, ব্যর্থতায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে পাঁজর ভেদ করে। শেষমেশ একদিন কোনো সরকারি চাকুরে এসে তার রাজকন্যার পুরোটা জগৎ দখল করে নেয় , আর তাকে বুঝিয়ে দেয় ” বেকারদের ভালেবাসা পাওয়ার যোগ্যতা নেই!”

ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর সংসার চালাতে মা হাতের চুড়ি জোড়া বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তখন মা বলেছিলেন “আমার ছেলে আছে, বড় হয়ে কত ডজন চুড়ি গড়িয়ে দেবে আমায়! ” সেই মায়ের হাতদুটো আজও খালি। বেকার ছেলেটি পারেনি তার মা’কে দু’টো সোনার চুড়ি গড়িয়ে দিতে। শূন্য হাতে দুঃখী মা পৃথিবী ছেড়েই চলে গেলেন, তবুও বেকারত্বের অভিশাপ কাটে না ছেলেটার!

“টিউশনির মাস্টার” নামে পরিচিত বেকার ছেলেটা চক্ষুলজ্জা বিসর্জন দিয়ে ছাত্রের মায়ের কাছে চলতি মাসের বেতনটা এডভান্স চেয়ে বসে, বাবাকে ডাক্তার দেখাবে বলে। এডভান্স তো মেলেই না, উল্টো টিউশনিটা চলে যায়। দম বন্ধ হয়ে আসে ছেলেটার। এ অভিশাপ আর যে কুলোয় না!

চাকরি হয় না ঠিকই, তবু এক অফিস থেকে আরেক অফিসে প্রতিনিয়ত ছুটে চলে বেকার ছেলেটা। টানা সাড়ে তিন বছর ধরে ইন্টারভিউ দিয়ে যাওয়া ছেলেটা এখন সকাল ছয়টায় বের হয় মেস থেকে। হেঁটে হেঁটে অর্ধেক পথ যেয়ে, বাকিটা লোকাল বাসে পাড়ি দেয়। সিএনজি নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে পরবর্তী কয়েকটা দিন তাকে যে অনাহারে কাটাতে হবে!

পছন্দের মানুষটার জন্মদিনে বন্ধুদের দামি উপহারের মাঝে বেকার ছেলেটার ওই দু’শ টাকার চকলেট নিয়ে যেতে মাথাটা লজ্জায় নিচু হয়ে আসে। যেন পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে! অথচ এই দু’শ টাকা তার তিনবেলার খাবারের বিনিময়ে জমানো ক্ষুধা। টাকার অঙ্কটা সবার কাছে ছোট হলেও কষ্টটা শুধুই বেকার ছেলেটা বোঝে।

অনার্স শেষ করার পর থেকে একবেলাও বেকার ছেলেটা পেট ভরে দুপুরের খাবার খায়নি। একটা সিঙারা আর একটা ডালপুরি তার নিত্যদিনের মধ্যাহ্নভোজ। বেকার ছেলেদের বেশি ক্ষুধা তো থাকতে নেই।

বেকার ছেলেদের কোন পছন্দ অপছন্দ থাকে না। বাড়িতে কে কি খাবে সবার কাছে জিজ্ঞেস করা হলেও, বেকার ছেলেটি থাকে সেই প্রশ্নের বাইরে। ও তো বেকার! ওর আবার রুচি -অরুচি কিসের! অগোছালো চুল,গাল ভর্তি দাঁড়ি , ঘোলাটে পোশাক, এলোমেলো চালচলন, সেলাই করা জুতো, ভাঙা ফোন, চামড়া ওঠা মানিব্যাগ, রিপু করা শার্ট, পকেট ভর্তি খুচরো পয়সা,চোখের নিচে কালি আর বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসের নাম “বেকার”। পৃথিবীতে বেকার ছেলেদের সন্তান, ভাই, বন্ধু,স্বামী হওয়ার অধিকার নেই। তারা চাইলেও এ অধিকার খাটাতে পারে না। কারণ তারা তো বেকার!

পরিবার,আত্মীয়স্বজন, বন্ধু – বান্ধব সবার থেকে লুকিয়ে বাঁচতে চায় বেকার ছেলেরা। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতেও তারা জীবন্ত লাশ হয়ে থাকে। নিতান্ত তুচ্ছ, মূল্যহীন, পাতে দেয়ার অযোগ্য এক পদবির নাম
” বেকার “।
বেকারত্ব একটা কালো অধ্যায় মাত্র। রাত শেষে ভোর কিন্তু ঠিকই আসে। তাহলে বেকার ছেলেটাও একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে – এই কথাটা মানতে আমাদের এত আপত্তি কিসের? জীবনে একটি কালো অধ্যায় এলে তাকে সমাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। বেকারত্ব কি আজীবন থাকে? যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নামধারী বেকারে আজ ভর্তি দেশ। তাদের মনোবল আরো ভেঙে দিচ্ছে সমাজ, পরিবার এমনকি কাছের মানুষজন। বেকারত্ব কোন দূর্বলতা নয়, বেকারত্ব একটি সমস্যা যা নিরসন হওয়া সম্ভব। আমরা মানুষকে শুধু মানুষ বলে চিনতে শিখি। “বেকার” নামক কোন পদবী কারোর জন্য বরাদ্দ না থাকুক।