• মুহম্মদ নূরুল ইসলাম

সকল প্রশংসা সেই সত্তার যার হাতের মুঠোতে আমার জীবন-মৃত্যু। সকল প্রশংসা তাঁরই যিনি আমাকে অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন, শুকরিয়া প্রকাশ করছি রাব্বুল আলামিনের যিনি আমার কলমকে সচল রেখেছেন। সে রবের কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া যিনি আমাকে মুসলিম বা মুসলমান সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য সাহায্য করেছেন, দিয়েছেন জ্ঞান।

অসংখ্য দরুদ ও সালাম বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত, মহান শিক্ষক সাইয়্যিদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি, যিনি আল্লাহ্র দীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে এক ঘোরতর জাহেলিয়াতের যুগে আবির্ভূত হয়ে ইসলামের দাওয়াতের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের পংকিলতায় নিমজ্জিত জাতিকে তাওহিদি চেতনায় উদ্ভাসিত ও আলোকিত করেছেন।

প্রত্যেক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সচেতন মানুষ নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানার ব্যাপারে আগ্রহী। আগ্রহী বললে কম বলা হবে, বরঞ্চ বলতে হবে প্রচ- আগ্রহী। তাও যদি নিজেদের ধর্মীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য হয় তাহলেও তো কথাই নেই। আগ্রহ আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। তেমনিভাবে প্রত্যেক সচেতন মুসলিম ইসলামের ইতিহাসের সূচনালগ্নের ইতিহাসসমূহ জানতে ও ইসলামের ইতিহাসের ঐতিহাসিক স্থান-স্থাপনাসমূহ সম্পর্কে জানতে, দেখতে আগ্রহী। তেমিনভাবে এসব সম্পর্কে জানতে ও স্বচক্ষে দেখতে প্রচ- একটি আগ্রহ আমার ভেতরে দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে, ইসলামের ইতিহাসের তিনটি যুদ্ধক্ষেত্র যেমন, বদর, ওহুদ ও খদ্দক বা পরিখার যুদ্ধক্ষেত্র, তায়েফ, আল্লাহ্ রাসুল সা. শিশুকালে যেখানে বেড়ে উঠেছিলেন সেই মা হালিমার ঘর তথা এলাকা বনি সাদ, জবলে নূর, জবলে সুর, সেবে আবু তালিবসহ অন্যান্য স্থান-স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখার একটি দুর্নিবার আগ্রহ ছিলো।

২০১২ সালে রাব্বুল আলামিন প্রথম বার পবিত্র ওমরাহ হজ্জ পালনের জন্য আমাকে কবুল করেন। ফলে সে সময় পবিত্র ওমরাহ হজ্জ পালনের পাশাপাশি ইসলামের ইতিহাসের ঐতিহাসিক স্থান-স্থাপনাসমূহ দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়। পবিত্র ওমরাহ হজ্জ পালনের পরে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞার আওতায় কৌশলে তায়েফসহ উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান, স্থাপনাসমূহ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত তিনটি যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে ওহুদ ও খদ্দক বা পরিখার যুদ্ধক্ষেত্র দেখার সৌভাগ্য হাতছাড়া করিনি। কিন্তু দূরত্বের কারণে আর সৌদি আরব সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে গাযওয়ায়ে বদর বা বদরের যুদ্ধক্ষেত্র দেখার সুযোগ হয় নি। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ও অসম যুদ্ধক্ষেত্রটি দেখার আগ্রহ কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছিলো না। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা ২০১৯ সালে সেই সুযোগও হাতের মুঠোয় এনে দিলেন। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পবিত্র ওমরাহ হজ্জ পালনের জন্য সৌদি আরব গমন করি।

আমরা ২০১৯ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরব যাওয়ার আগেই সৌদি আরব সরকার বদরপ্রান্তরসহ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা, নিদর্শন ও পর্যটন কেন্দ্র গুলোর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে আমারও বদরপ্রান্তর দেখার সুযোগ এসে গেলো।

আল মদিনা আল মুনাওয়ারা জিয়ারত শেষে ৭ এপ্রিল বদরপ্রান্তরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার ছেলে ইকবাল হোসেন গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। মসজিদে নববীর উত্তর পাশের বাঙালি বাজার থেকেই আমাকে পর্যটক বহনকারী গাড়ি আমাকে তুলে নেবে, ৬ এপ্রিল রাতে এরকমই সিদ্ধান্ত। লিলি ও প্রিয়ম গেলো না। আমি একাই যাত্রী হলাম।

৭ এপ্রিল সকালে নাস্তা সেরে গাড়ির জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষ করতে হয়নি। সাড়ে ৮টার দিকে গাড়িতে উঠে বসলাম। তখন গাড়িতে যাত্রী মাত্র চারজন। মনে মনে ভাবতে লাগলাম স্বল্প সংখ্যক যাত্রী নিয়ে এতো দূরের ভ্রমণে গাড়ি যাবে তো? গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট থেকে যাত্রী নেওয়া শুরু হলো। এর মধ্যে সময় গড়িয়ে গেলো প্রায় দেড় ঘন্টা। তখন ঘাড়ির কাটা ১০টার ঘরে। আর এদিকে গাড়ির সব আসনও পূর্ণ হয়ে গেছে। বলেই রাখি গাড়ির চালক পাকিস্তানি। গাড়ির সহকারী কাম টুরিস্ট গাইড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছের যিনি তিনিও পাকিস্তানি। তার নাম আমির হামজা।

গাড়ি যখন যাত্রী নিয়ে ভর্তি তখন গাযওয়ায়ে বদর তথা বদর প্রান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। গাড়িতে আমিসহ নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর নিয়ে ৫০ জন যাত্রী। আমি ছাড়া সবাই পাকিস্তানি। আল মদিনা আল মুনাওয়ারার পল্লী ছেড়ে আসতেই গাড়ির সহকারী কাম গাইড আমির হামজা মহাসড়কের দুই পার্শ্বের বর্ণনা দেওয়া শুরু করলো ঊর্দুতে।

মহাসড়ক হয়ে আল মদিনা আল মুনাওয়ারা থেকে যাওয়া যাবে মক্কা মুয়াজ্জামা, বন্দর নগরী জেদ্দা, লোহিত সাগরের উপকূলীয় এলাকা ইয়ানবু ও রাবিগসহ অন্যান্য স্থানে।

গাড়ি ছুটে চলছে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গতিতে। গাড়ি ছুটছে তো ছুটছে। মহাসড়কের দুই পাশেই উট, ঘোড়ার পাল দেখা যাচ্ছে। উট ও ঘোড়ার পাল ঘাস খাচ্ছে। কোথাও কোথাও গাছের নিচে আরম করছে। প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে গাড়ির গাইড আমির হামজা ঘোষণা করলো সামনে গাড়ি থামবে। সে ঘোষণাতেই বললো, সামনে পানির একটি কুয়া আছে যার নাম বীরে আররুওয়াহ (Ber Arrowha)। এই কুয়া থেকেই বদরপ্রান্তে যাত্রা কালে রাসূল সা.-ও পানি পান করেছিলেন। অবশ্য সে সময় ওখানে পাতকুয়া ছিলো না। পরবর্তীতে সেই পাহাড়ি সুপেয় পানির উৎসকে ধরে রাখার লক্ষ্যে পাতকুয়া নির্মাণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাতকুয়ার পানি উত্তোলনের জন্য বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আর পানি তুলে রিজার্ভারে ধারণ করা হচ্ছে। সৌদি আরব সরকার একই সাথে পানির রিজার্ভারের দেয়ালে টেপ লাগিয়ে পানি নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাড়ি থামার সাথে সাথে পাকিস্তানি পর্যটকরা পানি নেওয়ার জন্য খালি জার, বোতল নিয়ে নেমে পড়লো। আমিও নামলাম। নেমে আমি পাকিস্তানিদের পানি নেওয়ার দৃশ্য ধারণ করলাম ও ওখানে কিছু হালকা খেয়ে নিলাম।

প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষার পরে গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। মহাসড়কের দুই পাশে ধু ধু বালির চর, মাঝে মাঝে বালির টিলা ও পাহাড়। যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই বালুর টিলা, বালুর পাহাড় ও ধু ধু বালুর চরে চোখ আটকে যায়। সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটে চলছে তো চলছে। আরো প্রায় ৩০-৪০ মিনিট পরে গাড়ির গাইড আমির হামজা ঘোষণা করলো সামনে গাড়ি থামবে। আমির হামজা বললো সামনে রয়েছে একটি মিষ্টি পানির উৎস, যার নাম বিরে শিফা (Ber Shifa)।

গাড়ি থামলো। আমরা সবাই নেমে পড়লাম। পাকিস্তানিরা যথারীতি পানি নেওয়ার জন্য জার, কন্টেইনার, বোতল যা খালি ছিলো তা নিয়ে নেমে পড়লো। অনেকেই বোতল নিয়ে পানি পান করছে। বালতি ফেলেই পাতকুঁয়া থেকে পানি তুলতে হয়। অবশ্যি এখানে বিরে আররুওয়াহ (Ber Arrowha)-র মতো বাঁধানো ঘর বা কোনো পানির রিজার্ভার বা পানির টেপ নেই। খোলা আকাশের নিচে পাতকুয়া। পাতকুয়ার উপরে ছোট ছোট রড দিয়ে নেট তৈরি করা হয়েছে। তার উপরে আরো একটি নেট দেয়া রয়েছে যাতে বাইর থেকে ময়লা-আবর্জনা না পড়ে বা কেউ ফেলতে না পারে। পানি নেওয়া শেষে আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো।

গাড়ি বালিময় দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলছে। গাইড আমির হামজা ঘোষণা করছে, ‘আমরা এখন আবু জার গাফফার উপত্যকা (Abu Zar Ghafar Valley) অতিক্রম করছি। সে আরো বললো আল্লাহ্র রাসুল সা.-এর নেতৃত্বে আল মদিনা আল মুনাওয়ারা থেকে আগম মুসলিম বাহিনী এখানে এসেই প্রথমে এই পাহাড়ের উঁচুতেই উঠেই অবস্থান নেন। উঁচুতে উঠে অবস্থান নেওয়ার সুবিধাটা উপর থেকে নিচের সবকিছু দেখা যায়। লোকজনের গতিবিধি লক্ষ করা যায়। এর পরে ক্রমে বদর উপত্যকার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরে প্রথমে মালাইকা পাহাড়ে (Jable Malayaka) পৌঁছে। মালাইকা পাহাড়ের পাশ দিয়ে গাড়ি মহাসড়ক হয়ে এগিয়ে চলছে। মহাসড়কের দুই পাশে দেখা যাচ্ছে আধুনিক দালান। আরো একটু এগিয়ে যেতেই সামনে হাতের বাম পাশের একটি বড় শ্বেত পাথর দেখিয়ে আমির হামজা বললো, বদর যুদ্ধে যারা শহিদ হয়েছিলেন তাদের নামের তালিকা এখানে খোঁদাই করে রাখা হয়েছে। দেখা গেলো তালিকায় ১৪ জনের নাম রয়েছে। অনেকেই গাড়ির ভেতর থেকে ছবি তুললেন। যেখানে শহিদদের নামের তালিকার পাথর রয়েছে তার উল্টে দিকটা বদরযুদ্ধ ক্ষেত্র। ওটাকে বাউন্ডারি দিয়ে রাখা হয়েছে। ওখানে রয়েছে সেই বিখ্যাত কুয়া। যে কুয়া থেকে মুসলিম বাহিনী পানি সংগ্রহ করার জন্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলো। সেই কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করতে এসেই প্রথম একজন মুশরিক নিহত হয়।

ঐতিহাসিক জঙ্গে বদরের মসজিদে আরিসা- (Masjid AL Areesh)

গাড়ি এগিয়ে ডান দিকে ঘুরে একটু সামনে গিয়ে একটি দালানের সামনে থেমে গেলো। আমির হামজা বলেই দিলো আমরা সেই ঐতিহাসিক জঙ্গে বদরের মসজিদে আরিসা-এ (Masjid AL Areesh) পৌঁছে গেছি। তখন বেলা প্রায় একটা। আমির হামজা আরো বললো আমরা জোহরের নামাজ শেষে এখান থেকে আবার আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় ফিরে যাবো। এখানে জোহরের নামাজ হবে সোয়া একটায়।

সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। আমিও নামলাম। নেমেই কিছু ছবি তুলে নিলাম। মসজিদের পশ্চিমে লাগোয়া বদরের যুদ্ধ ক্ষেত্র। বদরের যুদ্ধ ময়দানে এখনো মনে হচ্ছে সেই ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের কাঠামোই রয়ে গেছে। মাঠের সর্বত্র রয়েছে খেজুর গাছ। কিছু কিছু গাছ মরে গেছে। কিছু কিছু মরতে বসেছে। এখনো কিছু তরতাজা রয়েছে তবে কোনো গাছেই ফল নেই। মাঠের মাঝখানে রয়েছে ভঙ্গুর পাতকুয়া। দেখলেই মনে হতে পারে আগুনের লেলিহান শিখায় ঝলসে যাওয়া একটি সবুজপ্রান্তর। একসময় মাঠে ছিলো বিপুল সবুজের সমাহার। কিন্তু এখন সব পরিত্যক্ত। অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রটির পরিদর্শনে ব্যস্ত। কিন্তু পুরো মাঠ পরদির্শন করতে গেলে জোহরের নামাজের জামাত পাওয়া যাবে না।

পরে মসজিদের ভেতরে গিয়ে ওয়াসরুম ব্যবহার করে নিলাম নামাজ আদায় করার জন্য অজু করে নিলাম। ওয়াসরুমে গিয়ে দেখা এক বাঙালি খাদেমের সাথে। তার চেহারা দেখেই তাকে বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করতে অসুবিধা হয় নি। তিনি জানালেন মসজিদে আরিসে তারা দুইজন বাঙালি খাদেম হিসেবে কর্মরত। তাদের দুইজনের বাড়ি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায়। তাদেরকে পেয়ে প্রাণ খুলে বাঙলা কথা বললাম। মসজিদে প্রবেশ করে আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিলাম। এর মধ্যে জোহরের নামাজের একামত দিচ্ছে। জামাতে নামাজ শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে আবার সেই বাঙালি ভাইয়ের সাথে কথা শুরু করলাম। তিনি জানালেন বদর সিটিতে প্রায় ৩০জনের মতো বাঙালি কর্মরত আছেন। কেউ কেউ এখান ব্যবসা করেন। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্য কারো সাথে দেখা করা বা কথা বলার সময় হয় নি। এদিকে গাইড আমির হামজা ঘোষণা দিচ্ছে গাড়ি এখন ছেড়ে যাবে আপনারা চলে আসুন।

তখন বেলা দেড়টা থেকে একটু বেশি হবে। সবাই গাড়িতে আরোহণের পরে গাড়ি আবার আল মদিনা আল মুনাওয়ারার পথে যাত্রা শুরু করলো। বদরপ্রান্তর ত্যাগ করার পূর্বে আবার প্রাণ ভরে দিখে নিলাম পুরো এলাকা। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে এই বদরপ্রান্তে মুসলিম বাহিনীর প্রথম যুদ্ধ হয় তখন ওখানে মরু অঞ্চলের সেই খেজুর গাছ ও কিছু কাঁটযুক্ত কেকটাস জাতীয় গাছ, পাথর ও ধু ধু বালির প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই ছিলে না। কিন্তু বর্তমানে সেই বদরপ্রান্ত একটি উপশহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। বদরপ্রান্তর এখন একটি পর্যটন কেন্দ্র। দীর্ঘশ^াস ছেড়ে আমরা ফিরে চললাম আল মদিনা আল মুনাওয়ারার পথে। নিজেকে শান্তনা দিলাম এই ভেবে যে, ইসলামের প্রথম যুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও অন্তত সেই ঐতিহাসিক প্রান্তরটা দেখা হলো। সেদিন যারা ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত রাখতে দুনিয়াতে মুসলিমদের মাথা উঁচু করতে শহিদ হয়েছিলো রাব্বুল আলামিন তাদেরকে জান্নাতুল ফেরদাউসের সর্বোচ্চ মোকামে স্থান দিয়ে দিয়েছেন। আল কুরআন করিমের রাব্বুল আলামিন স্বয়ং সেই কথাই ঘোষণা করেছেন।

বিকেল ৪টায় আমাদের গাড়ি আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় পৌঁছলো।

৬২৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান বদরপ্রান্তরে কি ঘটেছিলো? এব্যাপারে ইসলামের ইতিহাস ও আল কুরআন করিম থেকে আমরা যা জানতে পারি তা নিম্নরুপ :-

সূচনা

বদর বর্তমানে একটি উপশহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। যার অবস্থান আল মদিনা আল মুনাওয়ারা প্রদেশের অধীন লোহিত সাগরের অদূরে। ইসলামের সূচনা লগ্নে এটি ছিলো বালুকাময় পাহাড় ও টিলাময় মরু অঞ্চল। এই বালুর পাহাড় ও এর ঢালুর মধ্যেই সংঘঠিত হয়েছিলো ইসলামের প্রথম ধর্মযুদ্ধ। যে যুদ্ধের উপর নির্ভরশীল ছিলো ইসলামর অগ্রগতি। এখান থেকেই ইসলামের বিজয় পতাকা পৎ পৎ করে উড়তে শুরু করেছিলো।

মক্কা থেকে আল মদিনা আল মুনাওয়ারা যাওয়ার পুরোনো রাস্তায় গেলে বদরের প্রান্তর পড়ে। মক্কা থেকে ১২০ মাইল ও মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরে মধ্যবর্তী স্থানে এর অবস্থান। তবে সড়ক পথে দূরত্ব আরো বেশি। সেখানে সড়কের পাশে রয়েছে বড় একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যাতে লেখা রয়েছে বদরের যুদ্ধে শহিদদের নাম।

বদর প্রান্তর আল মদিনা আল মুনাওয়ারা প্রদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এটি ২৩ক্ক৪৬′৪৮″ উত্তর অক্ষাংশ ৩৮ক্ক৪৭′২৬″ দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত।

বদরের যুদ্ধ যাকে আরবিতে গাযওয়ায়ে বদর (আরবি : غزوة بدر‎‎) বলা হয়। বদর যুদ্ধ ২ হিজরির ১৭ রমজান (১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) আল মদিনা আল মুনাওয়ারার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত হয়। বদর যুদ্ধের পূর্বে ৬২৩ থেকে ৬২৪ সালের মধ্যে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে বেশ কিছু খ-যুদ্ধ হয়। বদর যুদ্ধ ছিল দুই বাহিনীর মধ্যে প্রথম বড় আকারের যুদ্ধ। যুদ্ধে সুসংগঠিত মুসলিমরা মক্কার সৈনিকদের সারি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে মুসলিমদের প্রধান প্রতিপক্ষ আমর ইবনে হিসাম প্রকাশ আবু জাহেল নিহত হয়। মুসলিমদের বিজয়ে অন্যদের কাছে বার্তা পৌঁছায় যে মুসলিমরা আরবে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই যুদ্ধ মক্কার কুরাইশদেরকে একটি বড় ধরনের ধাক্কা দিতে সক্ষম হয় আর তার উল্টো দিকে ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত করে ও গতি পরিবর্তন করে দেয়।

বদরের যুদ্ধ সে সময় সুদূরপ্রসারি প্রভাব বিস্তার করে। আল মদিনা আল মুনাওয়ারার অন্য আরব গোত্রগুলো মুসলিমদেরকে নতুন শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। যুদ্ধ জয়ের ফলে নেতা হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কর্তৃত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বদরের বন্দিদের প্রতি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেন। এসব বন্দিকে পরে তিনি সহজ শর্তে মুক্তি দেন। অনেকেই তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।,

পটভূমি

ইসলাম প্রচার শুরু করার পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার কুরাইশদের পক্ষ থেকে প্রচ- বিরোধিতার সম্মুখীন হন। মুসলিমদের উপর নির্যাতনের কারণে মুসলিমরা আল মদিনা আল মোনাওয়ারায় (পূর্বের নাম ইয়াসরিব) হিজরত করে। এর আগে কিছু মুসলিম লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে হাবশায় হিজরত করে। আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এক পর্যায়ে আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় হিজরত করেন। হিজরতের পরে অবতীর্ণ আল কুরআন করিমের আয়াতে মুসলিমদেরকে অস্ত্রধারণের অনুমতি দেয়া হয়। আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় আসার পর আল্লাহ্র রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি প্রধান সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। প্রথমত, আল মদিনা আল মুনাওয়ারার গোত্রগুলির সাথে শান্তিচুক্তি স্থাপন করা হয়; দ্বিতীয়ত, কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করা হয়; তৃতীয়ত, আল মদিনা আল মোনাওয়ারার পাশ দিয়ে সিরিয়াগামী মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় অভিযান চালানো হয়। এরপর সিরিয়ার পথে যাতায়াত করা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাগুলির উপর বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করা হয়।

৬২৩ সালের নভেম্বর বা ডিসেম্বরে আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিরিয়া অভিমুখী মক্কার একটি বড় বাণিজ্যিক কাফেলার বিরুদ্ধে অভিযানে নেতৃত্ব দেন। এই কাফেলায় কুুরাইশদের অনেক মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ছিল। মুসলিম বাহিনীর সদস্য ছিল ১৫০ থেকে ২০০ জন এবং আরোহণের উট ছিল ৩০টি। আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নিয়ে যুুল উশাইরাহ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিমরা পৌঁছানোর কয়েকদিন পূর্বে কুরাইশরা সে পথ অতিক্রম করে চলে যাওয়ার কারণে মুসলিমরা তাদের পথরোধ করতে পারে নি। এই অভিযানটি ‘গাযওয়ায়ে উশাইরা’ নামে পরিচিত। সিরাতকার ইবনে ইসহাকের মতে এই অভিযানের জন্য আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২ হিজরির জুমাদিউল আওয়াল মাসের শেষে বের হয়ে জামাদিউল আখির মাসের শুরুতে ফিরে এসেছিলেন।

৬২৪ সালের জানুয়ারিতে (২ হিজরির রজব মাস) আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১২ জন মুহাজিরকে অভিযানে পাঠান। বাহিনীর প্রতি দুইজনের আরোহণের জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাহিনীর নেতা আবদুল্লাহ ইবনে জাহশকে একটি চিঠি দিয়ে বলেন যাতে দুই দিনের পথ অতিক্রম করার পর এই চিঠি পড়া হয়। নির্দেশ মোতাবেক দুইদিনের পথ অতিক্রম করার পর আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ চিঠি পড়েন। এতে নির্দেশ দেয়া হয় যে, ‘চিঠি পড়ার পর যাতে তারা অগ্রসর হয়ে মক্কা ও তাইফের মধ্যবর্তী নাখলায় পৌঁছায়। এরপর কুরাইশ কাফেলার আগমনের অপেক্ষা করে এবং তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় অবহিত করা হয়।’ চিঠির নির্দেশ পড়ার পর তারা অগ্রসর হন। তবে পথিমধ্যে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাজওয়ানের উট হারিয়ে যায় ফলে তারা পিছিয়ে পড়েন।

আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ তার বাহিনীকে নিয়ে নাখলা পৌঁছে একটি কুরাইশ কাফেলা দেখতে পান। এতে আবদুল্লাহ ইবনে মুগিরার দুই ছেলে উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও নওফল ইবনে আবদুল্লাহ এবং মুগিরার মুক্তিপ্রাপ্ত দাস আমর ইবনে হাদরামি ও হাকিম ইবনে কাইসান ছিলেন। এই দিনটি ছিল রজব মাসের শেষ দিন। রজব যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস ছিল তাই আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে মাস শেষ হওয়ার সময় দিলে কাফেলাটি মক্কার হারাম সীমানায় প্রবেশ করবে ফলে তাদের উপর আর আক্রমণ করা সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম বাহিনীটি কাফেলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। আক্রমণের শুরুতে তীরের আঘাতে আমর ইবনে হাদরামি নিহত হন। মুসলিমরা উসমান ইবনে আবদুল্লাহ এবং হাকিম ইবনে কাইসানকে গ্রেপ্তার করে। নওফল ইবনে আবদুল্লাহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

রজব মাসে আক্রমণ করার কারণে মুসলিম দলটি ফিরে আসার পর রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন যে তিনি তাদের হারাম মাসে যুদ্ধের অনুমতি দেন নি। তিনি কাফেলা থেকে অর্জিত সম্পদ এবং বন্দিদের গ্রহণে অসম্মতি জানান। অন্যদিকে রজব মাসে আক্রমণের কারণে কুরাইশরাও মুসলিমদের কটুক্তি করতে শুরু করে। এরপর আল কুরআন করিমে অবতীর্ণ আয়াতে বলা হয় যে পবিত্র মাস লঙ্ঘন করার চেয়ে মক্কার লোকদের অত্যাচার আরো বেশি নিকৃষ্ট। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেলা ও বন্দিদেরকে গ্রহণ করেন। উসমান ও হাকিমের মুক্তি চেয়ে কুরাইশরা বার্তা পাঠায় এবং বিনিময় হিসেবে পণ্য প্রদানের কথা বলে। কিন্তু ইতিপূর্বে নিখোঁজ হওয়া সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাজওয়ান তখনও ফিরে আসেন নি। কুরাইশদের হাতে তাদের জীবনের আশঙ্কা থাকায় তিনি সেসময় প্রস্তাবে রাজি হন নি। এরপর তারা দুইজন ফিরে আসেন এবং পণ্য গ্রহণ করে বন্দিদের মুক্তি দেয়া হয়। বন্দিদের মধ্যে হাকিম ইবনে কাইসান ইসলাম গ্রহণ করে আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় থেকে যান। পরবর্তীতে বিরে মাউনায় তিনি নিহত হয়েছিলেন। উসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কা চলে যান।

ইতোপূর্বে গাযওয়ায়ে উশাইরা থেকে বেঁচে যাওয়া কুরাইশ কাফেলাটি সিরিয়া থেকে মক্কা ফেরার সময় আল্লাহ্র রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ ও সাইদ ইবনে জাইদকে উত্তরে প্রেরণ করেন। তারা হাওরা নামক স্থানে পৌঁছে কুরাইশ কাফেলার অপেক্ষায় থাকেন এবং কাফেলা এই স্থান অতিক্রমের সময় তারা আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় ফিরে ঘটনা অবহিত করেন। কাফেলায় একহাজার উট এবং এসব উটে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা মূল্যের মালামাল ছিল। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাফেলায় রক্ষী ছিল ৪০জন।

এই কাফেলায় আক্রমণের জন্য আল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানান। তবে পরবর্তীতে বৃহদাকার কুরাইশ বাহিনীর সম্মুখীন হতে হবে এমন আশঙ্কা তখনও ছিল না তাই তিনি এতে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি বলে উল্লেখ করেন নি। ফলে অনেক মুসলিম আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় থেকে যায়। ঘোষণার পর আল্লাহ্র রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর প্রান্তের দিকে যাত্রা করেন।

বদর প্রান্তের ভয়াবহ ও অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবার সংকল্প করেই আল্লাহ্র রাসূল সা. আনসার ও মুহাজিরদের একত্র করলেন। তাদের সামনে পরিস্থিতি পরিষ্কার করে তুলে ধরলেন। বিশেষ করে এই যুদ্ধে পরাজিত হলে আল মদিনা আল মুনাওয়ারার ইহুদি, মুনাফিক ও মুশরিকরা প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় মুসলিমদের জীবনধারণ করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। মুসলিমদের কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকবে না। ফলে তাদের ধন-প্রাণ-ইজ্জত-আবরুর ওপর আত্রমণ চালাতে কেউ একটুও ইতস্তত করবে না। এ কারণেই নবী সা. দৃঢ় সংকল্প নিলেন যে, বর্তমানে যতটুকু শক্তি-সামর্থ আমাদের আছে তাই নিয়েই আমরা বের হয়ে পড়বো। দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকার ও টিকে থাকার ক্ষমতা ও টিকে থাকার ক্ষমতা কার আছে এবং কার নেই ময়দানেই তার ফায়সালা হয়ে যাবে।

তাদের সামনে পরিস্থিতি পরিষ্কার করে তুলে ধরলেন। একদিকে উত্তরে বাণিজ্য কাফেলা এবং অন্যদিকে দক্ষিণে এগিয়ে আসছে কুরাইশদের সেনাদল। আল্লাহর ওয়াদা, এ দুটির মধ্য থেকে কোনো একটি তোমরা পেয়ে যাবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : বলো, এর মধ্য থেকে কার মুকাবিলায় তোমরা এগিয়ে যেতে চাও? জবাবে বিপুল সংখ্যক সাহাবি মত প্রকাশ করলেন, কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানো হোক। কিন্তু নবী সা.-এর সামনে ছিল অন্য কিছুর অভিপ্রায়। তাই তিনি নিজের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। একথায় মুহাজিরদের মধ্য থেকে মিকদাদ ইবনে আমর রা. উঠে বললেন :

“হে আল্লাহর রাসূল! আপনার রব আপনাকে যেদিকে যাবার হুকুম দিচ্ছেন সেদিকে চলুন। আপনি যেদিকে যাবেন আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা বনি ইসরাঈলের মতো একথা বলবো না : যাও, তুমি ও তোমার আল্লাহ দুজনে লড়াই করো, আমরা তো এখানেই বসে রইলাম। বরং আমরা বলছি : চলুন আপনি ও আপনার আল্লাহ দুজনে লড়–ন আর আমরাও আপনাদের সাথে জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করবো। যতক্ষণ আমাদের একটি চোখের তারাও নড়াচড়া করতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত।”

কিন্তু আনসারদের মতামত না জেনে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল না। কারণ এ পর্যন্ত যেসব সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো তাতে তাদের সাহায্য গ্রহণ করা হয়নি এবং প্রথম দিন তারা ইসলামকে সমর্থন করার যে শপথ নিয়েছিলো তাকে কার্যকর করতে তারা কতটুকু প্রস্তুত তা পরীক্ষা করার এটি ছিল প্রথম সুযোগ। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সা. সরাসরি তাদেরকে সম্বোধন না করে নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। একথায় সা’দ ইবনে মু’আয উঠে বললেন, সম্ভবত আপনি আমাদের সম্ভোধন করে বলেছেন? জবাব দিলেন : হাঁ। একথা শুনে সা’দ বললেন :

“আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আপনি যা কিছু এনেছেন তাকে সত্য বলে ঘোষণা করেছি। আপনার কথা শোনার ও আপনার আনুগত্য করার দৃঢ় শপথ নিয়েছি। কাজেই হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি যা সংকল্প করেছেন তা করে ফেলুন। সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তাহলে আমরাও আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পিছনে পড়ে থাকবে না। আপনি কালই আমাদের দুশমনের সাথে যুদ্ধ শুরু করুন। এটা আমাদের কাছে মোটেই অপছন্দনীয় নয়। আমরা যুদ্ধে অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকবো। মুকাবিলায় আমরা সত্যিকার প্রাণ উৎসর্গিতার প্রমাণ দেবো। সম্ভবত আল্লাহ আমাদের থেকে আপনাকে এমন কিছু কৃতিত্ব দেখিয়ে দেবেন, যাতে আপনার চোখ শীতল হবে। কাজেই আল্লাহর বরকতের ভরসায় আপনি আমাদের নিয়ে চলুন।”

এ আলোচনা ও বক্তৃতার পরে সিদ্ধান্ত হলো, বাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে কুরাইশ সেনা দলের মুকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু এটা কোনো যেততেন সিদ্ধান্ত ছিলো না। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে ৩১৩জন প্রাণ উৎসর্গীকৃত মুসলিম নিয়ে যুদ্ধের যাত্রা শুরু হলো।

বদর প্রান্তে যাত্রা

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে মুসলিম বাহিনীতে ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা., হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা., হযরত আলি ইবনে আবু তালিব রা., হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব রা., হযরত মুসআব ইবনে উমাইর রা., হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা., হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. ও হযরত আবু যার আল-গিফারী রা.। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. যুদ্ধে যেতে পারেন নি। হযরত সালমান ফারসি রা. এসময় অন্যের দাস ছিলেন তাই তিনিও যুদ্ধে অংশ নেন নি। মুসলিম বাহিনীতে সৈনিক সংখ্যা ছিল ৩১৩জন। এর মধ্যে মুহাজির ছিলেন ৮২জন এবং আনসারদের মধ্যে আওস গোত্রের ছিলেন ৬১জন ও খাজরাজ গোত্রের ১৭০জন। মুসলিমদের সাথে ৭০টি উট ও দুইটি ঘোড়া ছিল। ফলে তাদের সামনে পায়ে হেঁটে যাওয়া বা প্রতি দুই বা তিনজনের জন্য একটি উট ব্যবহার ছাড়া উপায় ছিল না। একটি উটে পালা করে দুই বা তিনজন আরোহণ করতেন। এই ব্যবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আলি ইবনে আবু তালিব রা. ও হযরত মারসাদ ইবনে আবি মারসাদ রা.-এর জন্য একটি উট বরাদ্দ হয়েছিল।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সার্বিক নেতৃত্বের জন্য হযরত মুসআব ইবনে উমাইর রা.-কে একটি সাদা পতাকা প্রদান করেন। মুহাজির ও আনসারদের জন্য একটি করে কালো পতাকা যথাক্রমে হযরত আলি ইবনে আবু তালিব রা. এবং হযরত সাদ ইবনে মুয়াজ রা.-কে প্রদান করা হয়। বাহিনীর ডান ও বাম অংশের প্রধান হিসেবে যথাক্রমে হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. ও হযরত মিকদাদ ইবনে আমর রা.-কে নিযুক্ত করা হয়। মুসলিম বাহিনীতে থাকা দুইটি ঘোড়ায় তারা আরোহণ করেছিলেন। পেছনের অংশের প্রধান হিসেবে হযরত কাইস ইবনে আবি রা.-কে নিয়োগ দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।

কুরাইশ কাফেলা

২য় হিজরির শাবান মাস (৬২৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাস) কুরাইশদের একটি বিরাট বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার পথে অগ্রসর হয়ে এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল যে জায়গাটি ছিল মদিনাবাসীদের আওতার মধ্যে। এ কাফেলার সাথে ছিলো প্রায় ৫০ হাজার আশরাফির সামগ্রী। তাদের সাথে ৩০ থেকে ৪০ জনের বেশি রক্ষী ছিল না। যেহেতু পণ্য সামগ্রী ছিল বেশি এবং রক্ষীর সংখ্যা ছিল কম আর আগের অবস্থার কারণে মুসলিমদের কোনো শক্তিশালী দল তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করার আশংকা ছিল অত্যন্ত প্রবল। আক্রমণের আশঙ্কায় কুরাইশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান যাত্রাপথে সাক্ষাত লাভ করা বিভিন্ন কাফেলাগুলির কাছ থেকে মুসলিম বাহিনীর সম্ভাব্য অভিযানের ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছিলেন। ফলে তিনি মুসলিমদের উপস্থিতির খবর পান। তাই সাহায্য চেয়ে জমজম ইবনে আমর গিফারিকে বার্তা বাহক হিসেবে মক্কা পাঠানো হয়। সে দ্রুত মক্কা পৌঁছায় এবং তৎকালীন আরব রীতি অনুযায়ী নিজের উটের কান কেটে ফেললো, তার নাক চিরে দিলো, উটের পিঠের আসন উল্টে দিলো এবং নিজের জামা সামনের দিকে ও পিছনের দিকে ছিঁড়ে ফেলে চিৎকার করে ঘোষণা করলো যে মক্কার কাফেলা মুসলিমদের হাতে পড়তে পারে।

মক্কার বাহিনী

মক্কায় পৌঁছানোর পর এটা ছিলো জমজম ইবনে আমর গিফারির আহ্বান।

“হে কুরাইশরা! তোমাদের বাণিজ্য কাফেলার খবর শুনো। আবু সুফিয়ানের সাথে তোমাদের যে সম্পদ রয়েছে, তার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীরা এগিয়ে আসছে। তাই আমার মনে হয় না যে তোমরা তা পাবে। তাই সাহায্যের জন্য এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো।”

এই খবর শোনার পর মক্কায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গেলো। কুরাইশদের বড় বড় সরদারেরা সবাই যুদ্ধের জন্য তৈরি হলো। দ্রুত ১,৩০০ সৈনিকের এক বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং আবু জাহেল বাহিনীর প্রধান হন। এই বাহিনীতে অসংখ্য উট, ১০০ ঘোড়া ও ৬০০ লৌহবর্ম‌ ছিল। নয়জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ রসদ সরবরাহের দায়িত্ব নেন। বাহিনীর জন্য দৈনিক কখনো ৯টি এবং কখনো ১০টি উট জবাই করা হত।

আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিজাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারিস ইবনে আমির, তুয়াইমা ইবনে আদি, নাদার ইবনে হারিস, জামআ ইবনে আসওয়াদ ও উমাইয়া ইবনে খালাফসহ মক্কার অনেক অভিজাত ব্যক্তি মক্কার বাহিনীতে যোগ দেন। এর কয়েকটি কারণ ছিল। কেউ কাফেলায় নিজেদের সম্পদ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, অন্যরা ইবনে আল-হাদরামির মৃত্যুর বদলা নিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহজে জয়ী হওয়া যাবে এই বিশ্বাসেও কেউ কেউ যোগ দেয়। আবু লাহাব নিজে যুদ্ধে অংশ না নিয়ে তার কাছে ৪,০০০ দিরহাম ঋণগ্রস্থ আসি ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে ঋণের বিনিময়ে পাঠায়। উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রথমে যুদ্ধে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তাকে নারী হিসেবে সম্বোধন করে। এর ফলে উমাইয়া ইবনে খালাফ লজ্জিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। তবে কুরাইশদের মধ্যে বনু আদি গোত্রের কেউ এই যুদ্ধে অংশ নেয় নি।

অন্যদিকে আবু সুফিয়ান ক্রমাগত খবরাখবর সংগ্রহ করছিলেন। বদরের নিকটে পৌঁছার পর মাজদি ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাত হয়। তাকে তিনি আল মদিনা আল মুনাওয়ারার বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মাজদি স্পষ্ট কিছু বলতে পারে নি। তবে জানান যে দুইজন উষ্ট্রারোহীকে তিনি টিলার পাশে উট বসিয়ে মশকে পানি পূর্ণ করতে দেখেছেন। তাই আবু সুফিয়ান সতর্কতা হিসেবে সেখানে যান এবং উটের গোবর ভেঙে দেখেন। গোবর থেকে প্রাপ্ত খেজুরের বিচি দেখে বুঝতে পারেন এগুলি আল মদিনা আল মুনাওয়ারার খেজুর। ফলে মুসলিমদের আগমনের ব্যাপারে তিনি সন্দেহমুক্ত হন। এরপর তিনি কাফেলাকে নিয়ে সমুদ্র উপকূলের দিকে ইয়ানবুতে চলে যান। মক্কার বাহিনী জুহফা নামক স্থানে পৌঁছার পর আবু সুফিয়ানের প্রেরিত বার্তা বাহক এসে জানায় যে কাফেলা নিরাপদ আছে তাই আর অগ্রসর না হয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।

এই খবর পাওয়ার পর মক্কার বাহিনীর অধিকাংশ ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু বাহিনীর প্রধান আবু জাহেল যুদ্ধ না করে ফিরে যেতে অসম্মতি জানান। এরপর বনু জোহরা গোত্রের মিত্র ও গোত্রটির সেনাপ্রধান আখনাস ইবনে শারিক ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অধিকাংশ তার পক্ষে সায় না দেয়ায় তিনি বনু জোহরা গোত্রের ৩০০ সদস্য নিয়ে মক্কা ফিরে আসেন। এর ফলে মক্কার বাহিনীতে সেনাসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১,০০০। পরবর্তীতে বনু জোহরা গোত্রের সদস্যরা আখনাসের এই সিদ্ধান্তের কারণে আনন্দ প্রকাশ করেছিল।

একইভাবে বনু হাশিমও মক্কায় ফিরে যেতে চায়। কিন্তু আবু জাহেলের জেদের কারণে তারা যুদ্ধে অংশ নেয়। মক্কার বাহিনী অগ্রসর হয়ে বদর উপত্যকার একটি টিলার পেছনে আশ্রয় নেয়।

মুসলিম পরিকল্পনা

বদর যুদ্ধ উপলক্ষে রাব্বুল আলামিন আল কুরআন করিমে এরশাদ করেন এভাবে, “আর স্মরণ করো, সেই সময়ের কথা, যখন আল্লাহ্ তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন, দুটি দলের মধ্য থেকে একটি তোমরা পেয়ে যাবে। তোমরা চাচ্ছিলে, তোমরা দুর্বল দলটি লাভ করবে। কিন্তু আল্লাহ্র ইচ্ছা ছিল, নিজের বাণীসমূহের সাহায্যে তিনি সত্যকে সত্যরূপে প্রকাশিত করে দেখিয়ে দেবেন এবং অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করে দেবেন।” (সূরা আল-আনফাল, আয়াত : ৭)

মুসলিমরা মক্কার কুরাইশ বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর পায়। মুসলিম বাহিনীটি মূলত কাফেলা আক্রমণের জন্য গঠিত হয়েছিল, ব্যাপক যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। মুসলিমরা এসময় কুরাইশদের মুখোমুখি না হয়ে ফিরে যেতে পারত কিন্তু এর ফলে কুরাইশদের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেত এবং তারা অগ্রসর হয়ে আল মদিনা আল মুনাওয়ারা আক্রমণ করতে পারত। অন্যদিকে বাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আল মদিনা আল মুনাওয়ারার আনসারেরা আকাবার বাইয়াত অনুযায়ী আল মদিনা আল মুনাওয়ারার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য ছিল না এবং অভিযানের ব্যয়ভার তাদের উপর বেশি ছিল। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধসভার আহ্বান করেন। সভায় মুহাজির, আনসার সকলেই কুরাইশদের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে মত দেয়। এরপর মুসলিমরা অগ্রসর হয়ে বদরের নিকটে পৌঁছায়।

বদরের পথে বীরে শিফা পাতকুয়া। যে কুয়া থেকে আমাদের রাসুল সা. মদিনা থেকে বদর প্রান্তে যাওয়ার সময় পানি পানি করেছিলেন।

এখানে পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. প্রতিপক্ষের খবর সংগ্রহের জন্য বের হন। এসময় এক বৃদ্ধ লোককে তারা দেখতে পান। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মুসলিম ও কুরাইশ উভয় বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। ঐ ব্যক্তি দুই বাহিনী সম্পর্কেই সঠিক তথ্য দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় হযরত আলি ইবনে আবু তালিব রা., হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. ও হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.-কে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করা হয়। তারা বদরের কূয়া থেকে পানি সংগ্রহরত দুইব্যক্তিকে বন্দী করেন। জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা জানায় যে তারা মক্কার বাহিনীর সদস্য এবং বাহিনীর জন্য পানি সংগ্রহ করছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসময় নামাজরত ছিলেন। উপস্থিত মুসলিমরা তার কথার সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিল। তাই তারা তাদের মারধর করে পুনরায় একই প্রশ্ন করে। এরপর তারা জবাব দেয় যে তারা কুরাইশ বাহিনীর নয় বরং আবু সুফিয়ানের কাফেলার লোক।

একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন যে, তারা সত্যই বলছিল অথচ এরপরও তাদের মারধর করা হয়েছে। এরপর তিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা উপত্যকার শেষ প্রান্তর টিলা দেখিয়ে বলে যে কুরাইশরা তার পেছনে অবস্থান করছে এবং প্রতিদিন নয় বা দশটি উট তাদের জন্য জবাই করা হয়। একথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে, তাদের সংখ্যা ৯০০ থেকে ১,০০০ হবে। এরপর বন্দিরা বাহিনীতে আগত সম্ভ্রান্ত কুরাইশ নেতাদের নাম বলে।

মক্কার নেতাদের নাম শোনার পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মন্তব্য করেন “মক্কা তার কলিজার টুকরোগুলোকে তোমাদের পাশে এনে নিক্ষেপ করেছে।”

মক্কার কুরাইশ বাহিনী বদর উপত্যকায় পৌঁছানোর পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে দ্রুত বদরের দিকে যাত্রা করার নির্দেশ দেন। তাঁর লক্ষ ছিল যাতে কুরাইশরা কূয়ার দখল নিতে না পারে। রাতে মুসলিমরা বদরের নিকট থামে। এসময় হযরত হুবাব ইবনে মুনজির রা. বলেন যে এটি যদি আল্লাহ্র নির্দেশ হয় তবে তা যেন বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু যদি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কৌশল হিসেবে এখানে থেমে থাকেন তবে তার মত হল যাতে এখানে অবস্থান না করে কুরাইশদের সবচেয়ে নিকটের কূয়ার কাছে অবস্থান নিয়ে বাকি সব কূপ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং নিজেদের কূয়ার উপর চৌবাচ্চা তৈরি করে তাতে পানি জমা করা হয়। এর ফলে মুসলিমরা পানি পেলেও কুরাইশরা পানি থেকে বঞ্চিত হবে। একথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরামর্শ মেনে নিয়ে নির্দেশ দেন যাতে রাত অর্ধেক পার হওয়ার পূর্বেই কুরাইশদের সবচেয়ে নিকটের কূয়ার কাছে গিয়ে শিবির স্থাপন করা হয়। এরপর সেখানে পৌঁছে চৌবাচ্চা তৈরি করে অবশিষ্ট সব কূপ বন্ধ করে দেয়া হয়।

মুসলিমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কূয়া দখল করার পর হযরত সাদ ইবনে মুয়াজ রা.-এর পরামর্শক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্বের টিলার উপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য একটি তাবু নির্মিত হয়। এখান থেকে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে একই সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়।

যুদ্ধ শুরুর পূর্ব রাত্রে মুসলিম বাহিনী পাহাড়ের উপর অবস্থান মজবুত করার পরে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা আর কুরআন করিমের সূরা আল আনফালের ১১ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে,

“আর সেই সময়, যখন আল্লাহ্ নিজের পক্ষ থেকে তন্দ্রার আকারে তোমাদের জন্য নিশ্চিন্ততা ও নির্ভীকতার পরিবেশ সৃষ্টি করছিলেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের ওপর পানি বর্ষণ করছিলেন, যাতে তোমাদের পাক-পবিত্র করা যায়, শয়তান তোমাদের ওপর যে নাপাকি ফেলে দিয়েছিল তা তোমাদের থেকে দূর করা যায়, তোমাদের সাহস যোগানো যায় এবং তার মাধ্যমে তোমাদেরকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।” (সূরা আল আনফাল : আয়াত নম্বর-১১)

আল কুরআন করিমের আয়াতে যা বলা হয়েছে, ‘যে রাতটি পোহাবার পরের দিন সকালে বদরের যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল, এটি ছিলো সেই রাতের ঘটনা। এ বৃষ্টির সুফল ছিলো তিনটি। এক. মুসলমানেরা বিপুল পরিমাণ পানি পেয়ে গিয়েছিলো। তারা সাথে সাথেই জলাধার তৈরি করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। দুই. মুসলমানেরা উপত্যকার উপরের দিকে অবস্থান করছিলো। কাজেই বৃষ্টির ফলে বালি জমাট বেঁধে যথেষ্ট শক্ত হয়ে গিয়েছেলো। তার ওপর দিয়ে মুসলমানদের বলিষ্ঠভাবে চলাফেরা করা সহজ হয়ে গিয়েছিলো। তিন. কাফেরদের সেনাদল ছিলো নিচের দিকে। বৃষ্টির পানি সেখানে জমে গিয়ে কাদা হয়ে গিয়েছিলো। ফলে সেখানে হাঁটতে গেলেই পা দেবে যাচ্ছিলো।

আর মুসলমানদের মধ্যে প্রথম দিকে যে ভীতির অবস্থা বিরাজমান ছিলো তাকেই শয়তানের ছুঁড়ে দেওয়া নাপাকি বলা হচ্ছে।

যেভাবে শুরু হল যুদ্ধ

১৭ রমজান, ২য় হিজরি, ১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ, মঙ্গলবার। বদরের প্রান্তে উভয় পক্ষের মোকাবিলা হলো। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন, তিনজন কাফেরের মোকাবিলায় একজন মুসলমান দাঁড়িয়েছে এবং তাও আবার তারা পুরোপুরি অস্ত্র সজ্জিত অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র সামনে দোয়া করার জন্য দুইহাত বাড়িয়ে দিলেন। অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে ও কান্না জড়িত স্বরে তিনে দোয়া করতে লাগলেন ।

“হে আল্লাহ! এই যে কুরাইশরা এসেছে, তাদের সকল ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা নিয়ে তোমার রসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে। হে আল্লাহ্! এখন তোমার সেই সাহায্য এসে যাওয়া দরকার, যার ওয়াদা তুমি করেছিলে আমার সাথে। হে আল্লাহ্! যদি আজ এ মুষ্টিমেয় দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীতে আর কোথাও তোমার ইবাদাত করার মতো কেউ থাকবে না।”

যুদ্ধের দিন কুরাইশরা শিবির ভেঙে বদরের দিকে রওয়ানা হয়। বদরে পৌঁছে তারা উমাইর ইবনে ওয়াহাবকে মুসলিমদের খবর সংগ্রহের জন্য পাঠায়। উমাইর এসে জানান যে, মুসলিম বাহিনী ছোট এবং সাহায্যের জন্য নতুন সেনাদল আসার সম্ভাবনাও নেই। তবে তিনি একইসাথে বলেন, তারা সুবিন্যস্তভাবে যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে আছে এবং তারা কুরাইশদের বিশেষ লোকদেরকে হত্যা করে ফেলতে পারে। এভাবে তিনি কুরাইশদের পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করেন। আরব যুদ্ধে হতাহতের পরিমাণ বেশি হত না তাই একথা শোনার ফলে কুরাইশদের মনোবল হ্রাস পায়। তারা পুনরায় তর্কে জড়িয়ে পড়ে।

কুরাইশদের অন্যতম নেতা হাকিম ইবনে হিসাম আরেক নেতা উতবা ইবনে রাবিয়াকে ফিরে যেতে অনুরোধ জানায়। জবাবে উতবা বলেন যে, তিনি ফিরে যেতে রাজি আছেন এবং নাখলায় নিহত আমর ইবনে হাদরামির রক্তপণ পরিশোধ করতেও তিনি রাজি। কিন্তু আবু জাহেল রাজি নয় বলে তিনি হাকিমকে বলেন যাতে তাকে রাজি করানো হয়। এরপর উতবা উপস্থিত কুরাইশদের উদ্দেশ্য বলেন যে, এই যুদ্ধে তাদের হাতে হয়ত নিজেদের ভাইয়েরাই নিহত হবে তাই যুদ্ধে বিজয়ী হলেও নিহতদের লাশ দেখতে তারা পছন্দ করবে না এবং তারা আত্মীয় হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত হবে। তাই তার পরামর্শ ছিল যাতে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায় এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অন্য আরব গোত্রসমূহের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়। যদি তারা তাকে হত্যা করে তবে কুরাইশদের উদ্দেশ্যও সফল হবে এবং এর ফলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে তারা নির্দোষ থাকবে।

হাকিম ইবনে হিসাম এসময় আবু জাহেলের কাছে গিয়ে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আবু জাহেল কঠোরভাবে বলেন যে, যুদ্ধ না করে তিনি ফিরে যাবেন না। সে সাথে উতবার ফিরে যাওয়ার পরামর্শকে ধিক্কার দিয়ে অভিযোগ করেন যে উতবার ছেলে মুসলিমদের দলে রয়েছে বলে উতবা ছেলেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ না করার পরামর্শ দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, উতবার ছেলে আবু হুজাইফা ইবনে উতবা ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক যুগে মুসলিম হয়েছিলেন। হাকিমের কাছে এ কথা জানতে পেরে উতবা বিব্রত হন এবং বলেন যে তিনি কাপুরুষ নন এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে চূড়ান্ত বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাবেন না ঘোষণা করেন। অন্যদিকে আবু জাহেল নাখলায় নিহত আমরের ভাই আমির ইবনে হাদরামির কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন যে উতবা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যেতে চায় তাই তার ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নেয়া সম্ভব হবে না। একথা শোনার পর আমির সারা শরীরে ধূলো মেখে কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে নিহত ভাইয়ের জন্য মাতম করতে থাকে। এসবের ফলে যুদ্ধ বন্ধের জন্য হাকিমের সব তৎপরতা ব্যর্থ হয়।

যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে কুরাইশদের আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখজুমি এগিয়ে এসে মুসলিমদের পানির জলাধার দখল করে নেবে, না হয় এজন্য জীবন দেবে বলে ঘোষণা দেয়। এরপর হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব অগ্রসর হয়ে তার সাথে লড়াই করেন। লড়াইয়ে আসওয়াদের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আহত অবস্থা আসওয়াদ চৌবাচ্চার দিকে এগিয়ে যায় এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য চৌবাচ্চার সীমানার ভেতর ঢুকে পড়ে। এরপর হামজা তাকে হত্যা করেন। এটি ছিল বদরের প্রথম মৃত্যু।

এরপর তৎকালীন রীতি অনুযায়ী দ্ব›দ্ধযুদ্ধের মাধ্যমে লড়াই শুরু হয়। কুরাইশদের মধ্য থেকে উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া ও ওয়ালিদ ইবনে উতবা লড়াইয়ের জন্য অগ্রসর হন। তাদের লড়াইয়ের আহ্বান শুনে আনসারদের মধ্য থেকে আওফ ইবনে হারিস, মুয়াব্বিজ ইবনে হারিস ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এগিয়ে আসেন। কিন্তু কুরাইশ যোদ্ধারা তাদেরকে কটাক্ষ করে বলেন যে, তারা তাদের যোগ্য না এবং যেন কুরাইশদের সমশ্রেণির কাউকে লড়াইয়ের জন্য পাঠানো হয়। এরপর তাদের বদলে হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব রা., হযরত উবাইদা ইবনে হারিস রা. ও হযরত আলি ইবনে আবু তালিব রা.-কে পাঠানো হয়। হযরত হামজার সাথে শাইবা, হযরত আলীর সাথে ওয়ালিদ ও হযরত উবাইদার সাথে উতবা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। কুরাইশ পক্ষের তিনজনই লড়াইয়ে নিহত হয়। লড়াইয়ে উবাইদা আহত হন তাই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। যুদ্ধের কয়েকদিন পর তার মৃত্যু হয়। তিনজন নেতৃস্থানীয় যোদ্ধার মৃত্যুর ফলে কুরাইশদের মনোবলে ফাটল ধরে।

দ্ব›দ্ধযুদ্ধের পর কুরাইশরা মুসলিমদের উপর আক্রমণ শুরু করে। যুদ্ধের পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দেন শত্রুরা বেশি সংখ্যায় কাছে এলেই যাতে তীর চালানো হয়। মুসলিমরা “ইয়া মানসুর আমিত” শ্লোগান দিয়ে প্রতিপক্ষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে মক্কার কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুয়াজ ইবনে আমর ও মুয়াজ ইবনে আফরা কুরাইশ পক্ষের সর্বাধিনায়ক আবু জাহেলকে হত্যা করেন। বিল্লালের হাতে তার সাবেক মনিব উমাইয়া ইবনে খালাফ নিহত হয়। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. তার মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে হত্যা করেন। বিকেলের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। আল কুরআন করিমে উল্লেখ রয়েছে যে, এই যুদ্ধে হাজারো ফেরেশতা মুসলিমদের সহায়তার জন্য এসেছিল।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৪ মুসলিম শহিদকে যুদ্ধক্ষেত্রে দাফন করা হয়। ১৪ মুসলিম শহিদদের মধ্যে মুহাজির ছিলো ৬জন। আর অবশিষ্ট ৮জন ছিলো আনসরা। ৮জন আনসারদের মধ্যে ৬জন খাজরাজ ও ২ জন আওস গোত্রের সদস্য। নিহত কুরাইশদের লাশ ময়দানের একটি কূয়ায় নিক্ষেপ করা হয়। এসময় চব্বিশজন প্রধান কুরাইশ নেতার লাশ কূয়ায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আরবের রীতি অনুযায়ী মুসলিমরা তিনদিন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করার পর আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় ফিরে আসে। এই যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি ছিলো নবীজি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রধান শত্রু আবু জাহেলের নিহত হওয়ার ঘটনা।

যুদ্ধে যে ১৪ মুসলিম যোদ্ধা শহিদ হয়েছিলেন তারা হচ্ছে –

Muslims casualties at Badr
Haritha bin Suraqa al-Khazraji حريثة بن سراقة الخزرجي
Zish Shamalain bin ‘Abdi ‘Amr al-Muhajiri ذو الشمالين بن عبد عمر المهاجري
Rafi’ bin al-Mu’alla al-Khazraji رافع بن المعلاء الخزرجي
Sa’d bin Khaythama al-Awsi سعد بن خيثمة الأوسي
Safwan bin Wahb al-Muhajiri صفوان بن وهب المهاجري
Aaqil bin al-Bukayr al-Muhajiri عاقل بن البكير المهاجري
Ubayda bin al-Harith al-Muhajiri عبيدة بن الحارث المهاجري
Umayr bin al-Humam al-Khazraji عمير بن الحمام الخزرجي
Umayr bin Abu Waqqas al-Muhajiri عمير بن أبو وقاس المهاجري
Awf bin al-Harith al-Khazraji عوف بن الحارث الخزرجي
Mubashir bin ‘Abdul Mundhir al-Awsi مبشر بن عبدالمنذر الأوسي
Mu’awwidh bin al-Harith al-Khazraji معوذ بن الحارث الخزرجي
Mihja’ bin Salih al-Muhajiri مهجاء بن صالح المهاجري
Yazid bin al-Harith bin Fushum al-Khazraji يزيد بن الحارث بن فصحم الجزرجي

দুই কিশোরের অসীম বীরত্বের গল্প

এ প্রসঙ্গে দুই কিশোরের অসীম সাহসিকতা নিয়ে একটি বীরত্বের গল্প প্রচলিত আছে। তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে।

চারদিকে শত্রুকে খুঁজছে সবাই। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. এক জায়গায় দাঁড়িয়ে লক্ষৈ করেছিলেন, শত্রুকে কীভাবে ঘায়েল করা যায়। তাঁর দুপাশে এসে দাঁড়াল দুটি বালক। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা.কে তারা বলল, চাচা, আপনি আবু জাহেলকে চেনেন? আমাদেরকে দেখিয়ে দিন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. আবু জাহেলকে দূর থেকে দেখিয়ে দিলেন। ছুটতে ছুটতে গিয়ে আবু জাহেলের সামনে হাজির হলো সেই দুই বালক। আবু জাহেল ঘোড়ায় চড়ে ছুটছিলেন। বালক দুজনের পক্ষে ঘোড়ায় চড়ে থাকা আবু জাহেলের শরীরে সরাসরি আঘাত করা সম্ভব ছিল না। একজন আক্রমণ করল আবু জাহেলের ঘোড়ায়। আরেকজন আবু জাহেলের পায়ে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করল। মুহূর্তের মধ্যেই আবু জাহেল মাটিতে গড়িয়ে পড়লেন। মাটিতে পড়েই ছটফট করতে লাগলেন তিনি। বালক দুজন সমানতালে তাঁকে আঘাত করে চলল। তারা আবু জাহেলের শরীরের ওপর চড়ে বসল। তখনো আবু জাহেল মারা যায় নি। দূর থেকে বালকদের অভাবনীয় আক্রমণে আবু জাহেলের এই মরণ দশা দেখে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. এগিয়ে আসেন এবং আবু জাহেলের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। সাহসী কিশোর দুজনের একজনের নাম মাআজ। অপরজনের নাম মুআ ওয়াজ।

পরবর্তী অবস্থা : যুদ্ধবন্দী

যুদ্ধের পর মুসলিমরা আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় ফিরে আসেন। এতে কয়েকজন কুরাইশ নেতাসহ ৭০জন বন্দি হয়। বন্দিদের সাথে সদ্বব্যবহার করা হয়েছিল। মুসলিমরা নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দিদের রুটি খেতে দেয়।

বন্দিদের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করেন। সভায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. মত দেন যে বন্দিদের সবাই মুসলিমদেরই ভাই, একই বংশের সদস্য অথবা আত্মীয়। তাই তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া উচিত যাতে মুসলিমদের তহবিলে অর্থ সঞ্চিত হয় এবং বন্দিরা ভবিষ্যতে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ পায়। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর মত ছিল বন্দিদের প্রতি কোনো প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শন না করে মুসলিমদের প্রত্যেকে বন্দিদের মধ্যে নিজ নিজ আত্মীয়কে হত্যা করে যাতে এটা প্রমাণ হয় যে, মুশরিকদের ব্যাপারে মুসলিমদের মনে কোনো দুর্বলতা নেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দিকের মত মেনে নিয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত মুক্তিপণ নির্ধারিত হয়। পাশাপাশি মুত্তালিব ইবনে হানতাব, সাইফি ইবনে আবি রিফায়া ও আবু ইজজা জুমাহিসহ কয়েকজন বন্দিকে মুক্তিপণ ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। শেষোক্ত দুইজন পরবর্তী উহুদের যুদ্ধে নিহত হয়। এছাড়া যারা পড়ালেখা জানত তারা ১০জন নিরক্ষর মুসলিমদেরকে শিক্ষা দিলে তা মুক্তিপণ হিসেবে গৃহীত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। বন্দিদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মেয়ে জয়নব বিনতে মুহাম্মাদের স্বামী আবুল আসও ছিল। জয়নবকে আল মদিনা আল মুনাওয়ারায় আসতে বাঁধা দেবে না এই শর্তে আবুল আসকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। বন্দিদের মধ্যে মক্কার সুবক্তা সুহাইল ইবনে আমরও ছিলেন। উমর সুহাইলের সামনের দুইটি দাঁত ভেঙে দেয়ার প্রস্তাব দেন যাতে তিনি আর মুসলিমদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা নিতে না পারেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন নি। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় সুহাইল মক্কার পক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন। আরও পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

মৃত্যুদন্ড

দুইজন যুদ্ধবন্দিকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল। এরা হলেন নাদার ইবনে হারিস ও উকবা ইবনে আবু মুয়াইত। বদর থেকে ফেরার সময় সাফরা উপত্যকায় নাদার ইবনুল হারিস এবং ইরকুজ জুবয়া নামক স্থানে উকবা ইবনে আবু মুয়াইতকে হত্যা করা হয়।

মক্কায় প্রতিক্রিয়া

কুরাইশদের পরাজয়ের খবর হাইসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কায় নিয়ে আসে। নিহতদের শোকে মক্কায় মাতম শুরু হয়। কিন্তু এরপর তারা সংযত হয় যাতে তাদের মাতমে মুসলিমরা আনন্দিত না হয়। তাছাড়া মুক্তিপণ নিয়ে তাড়াহুড়া না করতে বলা হয়। কুরাইশরা বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরের বছর দুই বাহিনী উহুদের যুদ্ধে পুনরায় মুখোমুখি হয়।

প্রভাব

বদরের যুদ্ধ সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধ জয়ের ফলে নেতা হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কর্তৃত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে অন্য আরব গোত্রগুলি মুসলিমদেরকে নতুন শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। আল মদিনা আল মুনওয়ারায় অনেকে এসময় ইসলাম গ্রহণ করে। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদেরকে খুবই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়। এসব যোদ্ধাদেরকে ইসলামের পরিভাষায় ‘বদরি সাহাবি’ বলা হয়।

অন্যদিকে যুদ্ধে আবু জাহেলসহ মক্কার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির মৃত্যুর ফলে আবু সুফিয়ান নতুন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তিনি কুরাইশদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলিম হওয়ার পর আবু সুফিয়ান মুসলিম সা¤্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে হুনাইয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তার ছেলে মুয়াবিয়া উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন।

সূরা আল আনফালে বদর যুদ্ধ

আল্লাহ্ তা’আলা আল কুরআন করিমের সূরা আল আনফালে বদর যুদ্ধের বিষয়ে একাধিক আয়াতে এরশাদ করেছেন। এসংক্রান্ত আয়াতগুলো নি¤েœ প্রদান করা হলো।

আয়াত নং- ৫. “(এ গনিমতের মালের ব্যাপারে ঠিক তেমনি অবস্থা দেখা দিচ্ছে যেমন অবস্থা সে সময় দেখা দিয়েছিল যখন) তোমার রব তোমাকে সত্য সহকারে ঘর থেকে বের করে এনেছিলেন এবং মুমিনদের একটি দলের কাছে এটা ছিল বড়ই অসহনীয়।”

আয়াত নং- ৬. “তারা এ সত্যের ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়া করছিলো অথচ তা একেবারে পরিষ্কার হয়ে ভেসে উছেঠিলো। তাদের অবস্থা এমন ছিল, যেন তারা দেখছিলো তাদেরকে মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”

আয়াত নং- ৭. “আর স্মরণ করো, সেই সময়ের কথা যখন আল্লাহ্ তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন, দুটি দলের মধ্য থেকে একটি তোমরা পেয়ে যাবে। তোমরা চাচ্ছিলে, তোমরা দুর্বল দলটি লাভ করবে। কিন্তু আল্লাহ্ ইচ্ছা ছিল, নিজের বাণীসমূহের সাহায্যে তিনি সত্যকে সত্যরূপে প্রকাশিত করে দেখিয়ে দেবেন এবং অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করে দেবেন।”

আয়াত নং- ৮. “যাতে সত্য সত্য রূপে এবং বাতিল বাতিল হিসেবে প্রমাণিত হয়ে যায়, অপরাধীদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক না কেনো।”

আয়াত নং- ৯. “আর সেই সময়ের কথাও স্মরণ করো, যখন তোমরা তোমাদের রবের কাছে ফরিয়াদ করছিলে। জবাবে তিনি বললেন, তোমাদের সাহায্য করার জন্য আমি একের পর এক, এক হাজার ফেরেশতা পাঠাচ্ছি।”

আয়াত নং- ১০. “একথা আল্লাহ্ তোমাদের শুধুমাত্র এজন্য জানিয়ে দিলেন যাতে তোমরা সুখবর পাও এবং তোমাদের হৃদয়ে নিশ্চিন্ততা অনুভব করে। নয়তো সাহায্য যখনই আসে আল্ল্াহর পক্ষ থেকে আসে। অবশ্যই আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।”

আয়াত নং- ১১. “আর সেই সময়, যখন আল্লাহ্ নিজের পক্ষ থেকে তন্দ্রার আকারে তোমাদের জন্য নিশ্চিন্ততা ও নির্ভীকতার পরিবেশ সৃষ্টি করছিলেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের ওপর পানি বর্ষণ করছিলেন, যাতে তোমাদের পাক-পবিত্র করা যায়, শয়তান তোমাদের ওপর যে নাপাকি ফেলে দিয়েছিল তা তোমাদের থেকে দূর করা যায়, তোমাদের সাহস যোগানো যায় এবং তার মাধ্যমে তোমাদেরকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।”

আয়াত নং- ১২. “আর সেই সময়, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে ইংগিত করছিলেন এই বলে : “আমি তোমাদের সাথে আছি, তোমরা ঈমানদারদেরকে অবিচল রাখো, আমি এখনই এ কাফেরদের মনে আতংক সৃষ্টি করে দিচ্ছি। কাজেই তোমরা তাদের ঘাড়ে আঘাত করো এবং প্রতিটি জোড়ায় ও গ্রন্থি-সন্ধিতে ঘা মারো।”

আয়াত নং- ১৩. “এটা করার কারণ, তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিদ্রোহ পোষণ করেছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিদ্রোহ করে আল্লাহ্ তার জন্য কঠির শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আর আল্লাহ্র পাকড়াও বড়ই কঠিন।”

আয়াত নং- ১৭. “কাজেই সত্য বলতে কি, তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন। আর তোমরা নিক্ষেপ কর নি বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছেন। (আর এ কাজে মুমিনদের হাত ব্যবহার করা হয়েছিল) এজন্য যে, আল্লাহ মুমিনদেরকে একটি চমৎকার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সফলতার সাথে পার করে দেবেন। অবশ্যি আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।”

বদরের শিক্ষা

বদরের যুদ্ধ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক নিদর্শন ও অনুপ্রেরণা লাভের অন্যতম শিক্ষা। এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় এটা প্রমাণ করে যে সত্যনিষ্ঠ কাজে বিজয়ের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ়তা, ধৈর্য ও সহনশীলতার বিকল্প নেই। এই রমজান মাসে তাই আমাদের প্রার্থনা আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে যেকোনো কাজে সফলতা লাভে কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প, ধৈর্য ও সহনশীলতা পোষণের তৌফিক দান করুন, যেভাবে তিনি বদর প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীকে দান করেছিলেন, আমিন।

 

লেখক : গবেষক, ইতিহাস লেখক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী। islamcox56@gmail.com

সাহায্যকারী গ্রন্থসমূহ :

পবিত্র কোরআনুল করীম, মূল : তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ সাফী রহ., অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। খাদেমুল-হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প কর্তৃক সংরক্ষিত । পোস্ট বক্স নং-৩৫৬১ মদীনা মোনাওয়ারা।
তাফহীমুল কুরআন, ১৯শ খ-, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী র., অনুবাদ : আবদুল মান্নান তালিব। আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা। ২৩তম প্রকাশ মার্চ ২০১০।
তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন (অষ্টম খ-), মূল লেখক : মুফতী মুহাম্মদ শফী এবং বাংলায় অনুবাদ মুহিউদ্দীন খান। পৃ : ৮৮৬ (পঞ্চম সংস্করণ)। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক জুন ২০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত।
তাফসীরে ইবনে কাছীর, ইমাম আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে কাছীর র.Ñ অনুবাদ অধ্যাপক মাওলনা আখতার ফারূক, একাদশ খ-, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দ্বিতীয় সংস্করণ (রাজস্ব), আগস্ট ২০১৩।
ইসলামী বিশ্বকোষ।