সোয়েব সাঈদ ॥
শিক্ষকতা পেশাকে ভালোবেসে ছেড়েছেন নিজ জন্মভূমি। অভিভাবকদের কাছে হাত পেতে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দিতেন স্কুলে। সন্ধ্যার পর হারিকেনের আলোয় ছুটতেন শিক্ষার্থীর ঘরে ঘরে। শিক্ষকতা জীবনে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য আলোকিত মানুষ। ৪০ বছরের শিক্ষকতা পেশায় নেননি কোন ছুটি। অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদকে আলোকিত করে মানুষের হৃদয়ে পেয়েছেন আদর্শ শিক্ষকের খ্যাতি। বুধবার (৬ জানুয়ারি) গুণি ও আদর্শ শিক্ষকের পথিকৃৎ মো. করিম দাদ এর দশম মৃত্যুবার্ষিকী ।
মো. করিম দাদ ১৯৬০ সালে কক্সবাজারের রামু উপজেলার পূর্ব রাজারকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন। পরে তিনি মন্ডলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালসহ আরো একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনে তিনি জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার লাভ করেন।
কক্সবাজারের বৃহত্তর চকরিয়া থানাধীন বরইতলী ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে মাস্টার মো.করিম দাদ এর জন্ম। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আলী। শিশু বয়সেই তিনি পিতৃহারা হয়ে মায়ের সাথে নানার বাড়ি পেকুয়ায় চলে যান। ২ ভাই, ১ বোন নিয়ে সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন করিম দাদ এর মা। মায়ের কষ্ট আর নিজেদের চরম দূঃখ কষ্ট দেখে শিশু বয়সেই করিম দাদ স্বপ্ন দেখেন সুশিক্ষা নিয়ে পরিবার-পরিজন ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে নেয়ার। এ প্রত্যয়ে শিক্ষা অর্জনে সচেষ্ট হন তিনি। মায়ের মতো নিজেও মানুষের জমি চাষাবাদ ও ক্ষেতের কাজ করে পড়ালেখা চালিয়ে যান তিনি। পাকিস্তান আমলেই তিনি পেকুয়া জিএমসি ইন্সটিটিউট থেকে সাফল্যের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ইন্টামিডিয়েট পাশ করেন।
আর্থিক দৈন্যতায় তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অক্ষম হওয়ায় ১৯৬০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে তিনি খোঁজে পান আলোকিত মানুষ গড়ার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ। এ স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে আলোকিত সমাজ ও দেশ গঠনে তিনি আমৃত্য নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত মানুষকে দিয়েছেন আলোর দিশা। ব্যাংক ঋন এবং স্বচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে চালিয়েছেন গরীব-মেধাবী শিক্ষার্থী পড়ালেখার খরচ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি পেকুয়া থেকে চলে যান রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের পূর্ব রাজারকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি খোঁজে পান নিজের শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে পথে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্নপূরণের সুযোগ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে নিজের সন্তানের মতো সুশিক্ষা প্রদান করে তিনি মানুষের কাছে পেয়েছেন আদর্শ শিক্ষকের অনন্য স্বীকৃতি।
মাষ্টার করিম দাদ এর শিক্ষাদান পদ্ধতি বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ ছিলো না। শিক্ষকতা পেশায় তিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের কাছে হাত পেতে তাদের সন্তানদের নিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতেন। সন্ধ্যা হলেই হারিকেন হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে পড়ালেখা তদারক করতেন। পূর্ব রাজারকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে করিম দাদ এর হাতে গড়া সফল শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে দেশ ও জন্যকল্যাণে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক উচ্চতর কর্মকর্তা ডা. বদিউর রহমান, ডা. হানিফ, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক, রাজারকুল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মুফিজুর রহমান উল্লেখযোগ্য। রামুর সাড়াজাগানো আইনজীবি প্রয়াত মনোহরী বড়ুয়াও করিম দাদ এর শিক্ষার্থী ছিলেন। শিক্ষকতা পেশাকে ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন স্বরূপ তিনি নিজ জন্মভূমি ছেড়ে রামুর পূর্ব রাজারকুল গ্রামে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন।
এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার বেশ কয়েকছর পর তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে রামু সদরের মন্ডলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। নিজের মেধা, শ্রম দিয়ে তিনি এ বিদ্যালয়কেও নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। মন্ডলপাড়া সহ আশপাশের অনেক গ্রামের বাসিন্দাদের সুশিক্ষিত করার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন মো. করিম দাদ।
এ বিদ্যালয়ে করিম দাদ এর সুযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন-কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বদিউল আলম পাভেল, রামু উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা হামিদুল হকসহ অনেক গুণী ব্যক্তিবর্গ।

আদর্শ শিক্ষক মো. করিম দাদ ছিলেন- ৮ ছেলে, ৩ মেয়ের জনক। নিজের প্রত্যেক সন্তান বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-দপ্তরে কর্মরত রয়েছেন। এদের মধ্যে বড় ছেলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর ম্যানেজার ও শাখা প্রধান, মেঝ ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম চকরিয়া ভূমি অফিসের ইউনিয়ন সহকারি ভূমি কর্মকর্তা, ৩য় ছেলে নজরুল ইসলাম রামু মডার্ণ কেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, ৪র্থ ছেলে জাহেদুল ইসলাম ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা, ৫ম ছেলে আরিফুর রহমান রাজনীতির সাথে জড়িত, ৬ষ্ঠ ছেলে শাহনেওয়াজ ইউসিবিএল ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের উচ্চতর কর্মকর্তা এবং সবার ছোট ছেলে মো. ওমর ফারুক চট্টগ্রাম জর্জ কোর্টে আইনজীবি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ৩ মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে গৃহিনী, মেঝ মেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগে এবং ছোট মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন।
সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টির মতো নিজের পরিবারের প্রতিটি মুখও তিনি আলোকিত করেছেন সুশিক্ষার আলোয়। এ কারনে রামুবাসীর কাছে এ চির অমর হয়ে থাকবেন আদর্শ শিক্ষক মো. করিম দাদ। মহান এ শিক্ষাগুরু ২০১১ সালের ৬ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন।
এদিকে পারিবারিকসূত্রে জানা গেছে-মো. করিম দাদ এর দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বুধবার (৬ জানুয়ারি) রামুর পূর্ব রাজারকুলস্থ বাড়িতে মাস্টার মো. করিম দাদ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে খতমে কোরআন, দোয়া মাহফিল, শিক্ষা উপকরণ বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও পরিবারের পক্ষ থেকে মো. করিম দাদ এর আত্মার মাগফেরাত কামনায় সকলের দোয়া কামনা করা হয়েছে।