-দিনুর আলম

“চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি”

কবি চেয়েছিলেন শিশুর জন্য একটি বর্ণিল ও জঞ্জালমুক্ত পৃথিবী। পৃথিবী বর্ণিল হয়েছে বটে কিন্তু এই রঙ নিয়ে কথা বলার আছে। জঞ্জালের আধিক্য নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে কিন্তু আমরা জানতে পারি আমাদের শিশুরা কেমন আছে।
দুই হাজার বিশ খ্রিস্টাব্দের শেষদিনে আমরা বিশ জনেক হাজির হই মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে। উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির সাথে বরাবরের মতোই মিতালীর অভিপ্রায়।
সোনাদিয়ার গোধূলি, ভরা পূর্ণিমা রাত আর ভোরের সুর্যোদয় যে উপভোগ করেনি সে বাংলাদেশর অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছাকাছি আসেনি এমন বলাটা অপবাদ নয় বরং খানিকটা বেশী সত্য।
প্রথম ছবিটা তোলার আগে তাদের অনুমতি নিয়েছি এবং প্রকাশ করার কথাও বলেছি।
কাছে গিয়ে বসে নানা কথা বলছিলাম, কথার চলে তাদের অবস্থা জেনে নিচ্ছিলাম হঠাৎ পাশে চোখ পড়লে দেখলাম একটা কাঁচের বোতল পরে আছে। আকল গুনে বুঝে নিলাম কিসের বোতল। অনেকটা না জানি মতোই জিজ্ঞেস করলাম এটা কীসের বোতল পরে আছে? খুব স্বাভাবিক হাসি দিয়েই উত্তর দিলো ‘নিশের বতল’
( মদের বোতল) খানিকটা মন খারাপ হলো। এই বয়সে এই শিশুরা মাদক সম্পর্কে জেনে গেছে এবং তারা এটাও জানে এই বোতল কারা খায়।
সোনাদিয়ার সমুদ্রতটে হাটলে আপনি অনেক বোতল দেখতে পাবেন এরকম। কিছু সাগর থেকে ভেসে এসেছে আর কিছু ওখানেই ব্যবহার করে ফেলে রাখা হয়েছে। বলতে গেলে শিশুদের আশেপাশে, খেলার মাঠে( উন্মুক্ত স্থান) এই বোতলের ছড়াছড়ি।
সরকার কিংবা সংস্থা যেই বলুন সমুদ্র সৈকত পরিষ্কার রাখার গরজ কারো হয়নি। কিন্তু ইদানীং পর্যটকের আসা যাওয়া বাড়ছে দিনকে দিন।
দ্বীপ শিশুদের শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম দ্বীপের ‘সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।’ গেলো বছর মহেশখালীর কিছু তরণ ‘স্বপ্নযাত্রী’ বলে একটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছে শিক্ষার আলো জ্বালাতে। আবহমান বাংলার শ্বাশত গ্রামের মতো সোনাদিয়ার মক্তবেও সকালে শিশুরা কোরআন পড়তে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে এটুকু তাদের। কোনো শিশু যদি মাধ্যমিক স্কুলে পড়তে হয় তাহলে তাকে মহেশখালীর নূল ভূখন্ডে( ঘটিভঙ্গা) এসে স্কুলে ভর্তি হতে হবে।
একজন শিশুর পক্ষে বিচ্ছিন্ন উপদ্বীপ হতে গাম বোটে করে, দৈনিক ভাড়া মিটিয়ে, শারীরিক কসরত করে প্রতিদিন সোনাদিয়া হতে আসা যাওয়া করা কষ্ট নয় সম্পূর্ণ অসম্ভব। এছাড়া সোনাদিয়া হতে মহেশষখালীর মূল ভূখন্ডে ঘটিভাঙ্গায় কেবল জোয়ার থাকতেই গাম বোট আসা যাওয়া করে।
সুতরাং সোনাদিয়ার শিশুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পড়ার ইচ্ছে জাগাটা এক রকম দুঃস্বপ্ন। এই দুঃস্বপ্ন বাস্তবে পূরণ করতল চাইলে তাকে ঘটিভাঙ্গায় কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে চলে আসতে হয়। মোদ্দা কথা হচ্ছে কতজন শিশু এই আত্মীয়ের সুবিধাটি পাচ্ছে এবং আত্মীয় বাড়িতে একটি শিশু কতটা নিরাপদ ও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে।

সোনাদিয়ার শিশুদের বিনোদন তারা নিজেরাই খোঁজে নেয়। সমুদ্র সৈকত, ঝাউবিথী এসব যেনো তাদের উন্মুক্ত উঠান। শেষের ছবিতে দেখা যায় শিশুরা সমুদ্র সৈকত থেকে ফিরছে খেলাধুলা করে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের কথায় কান গেলো। তারা বলছে
” ঢাহাইয়া মাইয়াপোয়া উগ্গা মরতপোয়া উগ্গে দুরার”
( ঢাকা থেকে আসা মেয়ে একটা তাদের একটা ছেলের সাথে খুনসুটি করছে) তাদের সাথে কথা বলা সহজ কারন আমরা স্থানীয়। তারা আমার হাতে এক প্রকার ( গোট) ছোট বরই দিলেন। তাদের সাথে এটা ওটা নিয়ে আলাপ করেছি।

আমি পর্যর্টকদের আচরণ নিয়ে কথা বলবোনা কিন্তু সে আচরণ এই শিশুদের মনের উপর যে প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে ভাবার আছে আমার।

সোনাদিয়ার শিশুরা প্রকৃতির শিশু। এদের সাংস্কৃতিক জীবন বলতে কিছু নাই, এদের সুস্থ-সুন্দর বিনোদনের ব্যবস্থা নেই,
এরা দেশের নানা জায়গায় ঘুরে মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন পর্যবেক্ষন করেনি। কাজেই সোনাদিয়ার শিশুরা দেশের সমস্ত শিশু থেকে আলাদা।সঙ্গত কারনে এদের বিচার-বিশ্লেষণ ও আলাদা হবে এটাই সত্য।

আপনারা যারা দেশের নানান জায়গা হতে সোনাদিয়ায় ঘুরতে যাবেন তাদের প্রতি আমার করজোড়ে অনুরোধ, আপনারা সোনাদিয়ার সৈকতকে নিজেদের শোবার ঘর এবং মদের বার মনে করবেন না। আপনাদের আনন্দ ভ্রমণ যেনো অন্যদের কোনোরূপ অনিষ্টের কারন না হয়।
আমাদের জনপ্রতিনিধি, আমাদের সরকার চাইলে সোনাদিয়ার শিশুদের জন্য অনেক কিছুই করার আছে কারন তারা অনেক কিছুই পায়নি আমাদের শিশুদের মতো।
আর পর্যটকদের আচরণের কারনে শিশুদের মনের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পরছে তা বন্ধ হোক!
সোনাদিয়ার শিশুরা ভালো থাকুক
বেড়ে উঠুক প্রকৃতির কোলে।