• এইচ.এম নজরুল ইসলাম

যতদূর জানি, আদ্যন্ত মানুষ আর তার জীবন যাপনের যাবতীয় অনুষঙ্গই মানবিক মূল্যবোধের জিনিস। মানুষকে শ্রেষ্ঠ ভাবা, মানবিক গুণগুলোকে জীবনাচরণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া এবং সকল মানব—প্রসঙ্গকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করাকেই আমি মানবিক মূল্যবোধের বিষয় বলে বিবেচনা করি।
আর জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন কক্সবাজারে যোগদানের পর থেকে যে ছোট ছোট গল্প তৈরি করেছে যা সূচনাতেই মানুষ এবং মানুষের যাবতীয় অনুষঙ্গকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
সমুদ্র শহরে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেনের মূল ভিত্তিটাই তৈরি হয়েছে মানব ও মানবিকতা প্রসঙ্গ দিয়ে। তাই মানবিক মূল্যবোধকে মো. কামাল হোসেনের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করার আদৌ কোনো অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। আজ হয়তো চাকরির সুবাধে তিনি চলে যাচ্ছেন সমুদ্র শহর ছেড়ে। কিন্তু তার হাত ধরে কক্সবাজারের আগামী প্রজন্মের জন্য যে মানবিক স্তম্ভগুলো রেখে যাচ্ছেন তা আগামীতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
একজন জেলা প্রশাসক কামাল হোসেনের ছোট ছোট গল্পগুলো আজ অনেক বড় গল্পে রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন সময় সামাজিক কর্মকান্ডসহনানা বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেনের সাথে আমার আলাপ হতো আন্তরিকতার সাথে। তিনি আমাকে কখনো নাম ধরে ডাকতেন না। তাঁর সান্নিধ্যে গেলে বিদ্রোহী অথবা কমরেড বলে সম্বোধন করতেন।
তবে বিদায়ের শেষ মুহুর্তে এসে বেশ কয়েক বার লিডার বলেও ডেকেছেন। আমাকে কেন এমনভাবে সম্বোধন করতেন তিনি হয়তোবা কখনো জানা যাবে না। এমন একজন উদার মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার সুবাদে কখনও ওনাকে আমার একজন শুধুমাত্র প্রশাসক মনে হয়নি।
মনে হত একজন দেশপ্রেমিকের সাথে নিজের ভাবনা, দর্শন কিংবা চিন্তা ভাগাভাগি করছি।
কক্সবাজারের সংকট এবং সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি আধুনিক পর্যটন নগরীতে পরিণত করার স্বপ্ন কিংবা সদ্য জন্ম নেওয়া কোন স্বপ্নের হাত ধরে হেঁটে চলা একজন মানুষের গল্প শুনছি।
তার অনেক গল্পের মাঝে আমি শুরুটা করতে চাই করোনাকালীন সময় নিয়ে। দেশে করোনা দূর্যোগ শুরু হলে যেখানে মানুষের সামাজিক বন্ধনেও বিপর্যয় নেমে এসেছিল। সামাজিক রীতিনীতি প্রায়শই বাধার সম্মুখীন, সে সময় দেখেছি সমাজসেবীরাও লোকচক্ষুর আড়ালে, অনেক জনপ্রতিনিধিও ছিল সেল্ফ হোম কোয়ারেন্টাইনে।
সময়ের সেই সাহসী সন্তানদের মধ্যে থেকে এমনই একজন মানবিক মানুষের কাছে দায়বদ্ধ ছিল তিনি হলেন জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন।
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস যখন প্রিয় পর্যটন নগরী কক্সবাজারে হানা দেয় সেই সূচনা লগ্ন থেকেই তিনি অবস্থান করেছিল প্রথম সারির যোদ্ধা হয়ে। দেশে প্রথম বারের মতো লকডাউন, রেড জোন ঘোষণা করে কক্সবাজারের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তার সুদক্ষতায় সেদিন জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা—কর্মচারি থেকে শুরু করে একঝাঁক তরুণদের নিয়ে নেমে পড়েন। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
অন্যদিকে লকডাউনে কর্মহারানো মানুষের পাশাপাশি সংবাদকর্মীদেরও পাশে দাঁড়াতে রাতদিন নিরলসভাবে কাজ করেছেন। যা এখনো দৃশ্যমান।
বাজারে—বাজারে এমনকি পাড়ামহল্লায় মাইকিং থেকে শুরু করে মাস্ক, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ দিয়ে শুরু হয় প্রাথমিক প্রতিরোধ প্রস্তুতি এমনকি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় কক্সবাজারবাসীকে সুরক্ষায় রাখতে ১০ লাখ মাস্ক বিতরণ কর্মসূচি চলমান রেখেছেন।
কোভিড—১৯ এর বিরুদ্ধে শুধু একজন যোদ্ধা নয় তিনি, এ যুদ্ধে বিজয়ী হতে সম্মুখ যোদ্ধাদের প্রতিনিয়ত উৎসাহ প্রদান করে গেছেন। জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবায় জনগুরুত্বপূর্ণ সব মেডিকেল সামগ্রী সংগ্রহে প্রথম এবং প্রধান ভূমিকা রাখতে দেখেছি একজন মানবিক জেলা প্রশাসককে। যার ফলে আজ জেলার প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল করোনা মোকাবেলায় স্বয়ং সম্পূর্ণ।
চারপাশে এতো আক্রান্ত এতো আতংক, বেঁচে থাকা নিয়ে এত সংশয়ের মাঝেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠা আর বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন কামাল হোসেন মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে নিজের সর্বস্ব দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। একজন জেলা প্রশাসক ধীরে ধীরে কক্সবাজারবাসীর কাছে হয়ে উঠেন মানবিক যোদ্ধা হিসেবে। ঠিক যেন প্রতিটি সূর্যোদয় হয় মানব কল্যাণের স্বপ্ন নিয়ে আর প্রতিটি সূর্যাস্ত হয় মানুষের জন্য কাজ করার তীব্র আকাঙ্খায়।
সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত ছিল জেলা প্রশাসকের কক্ষটি। দিনের বেশ খানিকটা সময় জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধারণ মানুষ জেলা প্রশাসকের কাছে তাদের নানাবিধ সমস্যার কথা জানাতে প্রতিনিয়ত লেগে থাকত ভীড়।
‘মানুষের মধ্যে মানবিকতা নেই। মানবিকতা হারিয়ে গেছে। কেউ আজ আর মানুষ নয়; এমন অনেক কথা সমাজে বলা হলেও আমরা যারা এই কথাগুলো বলে থাকি তারাই কিন্তু বুলি ওড়াই, কেউ এগিয়ে আসি না’। মানবতা এখনো আছে, তার বড় পরিচয় দিয়ে গেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন।
কক্সবাজারে টানা তিন বছর ২ মাসের কর্মজীবনে যারা কামাল হোসেনকে কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন তারা দেখেছেন, কক্সবাজারের মানুষের পাশে দাঁড়াতে তার ভূমিকা কি ছিল।
কখনো মৃত্যুর মুখোমুখি শিশু সায়ানকে বাঁচাতে উদ্যোগী হয়ে উঠা, কখনো অরুণোদয় স্কুলের শিশুদের ভবিষ্যত চিন্তায় মগ্ন থাকা।
একজন কামাল হোসেনের হাত ধরে কক্সবাজারে প্রতিষ্টিত হয়েছে অটিস্টিক শিশুদের জন্য বিশেষায়িত একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান “অরোণাদয়”। গড়ে তুলেছেন একটি কলেজ। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরে এসে একজন জেলা প্রশাসক কামাল হোসেনের হাত ধরে আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে শিশুপার্ক, করোনা হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।
যা তিনি চাইলেও কক্সবাজার থেকে নিয়ে যেতে পারবেন না। এসব প্রতিষ্ঠান একদিন কক্সবাজারের সম্পদ হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
গণমাধ্যমের সূত্র ধরে জানতে পারি ক্যান্সার আক্রান্ত সায়ানের মতো দূরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে আসা কত নারী পুরুষের পাশে দাঁড়ানো গল্প। কুকুরের সাথে রাত্রি যাপন করা পথশিশু রিদুয়ানকে বুকে টেনে নিয়ে নিজ ঘরে স্থান করে দেওয়া। পত্রিকায় সংবাদ দেখে ৬৫ বছরের বয়স্ক হকার শেফালির পাশে দাঁড়িয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছ করে তুলা। টেকনাফে ভবঘুরে মানুষগুলোকে নিরাপদে রাখতে ঘর তৈরি করে দেওয়া, নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা করা। কুতুবদিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের কক্সবাজার এনে তারকা মানের হোটেলে থাকার স্বপ্ন পূরণ, সমুদ্র দর্শনসহ এমন বহু অসহায় মানুষের আর্থিক সহায়তার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে তা এই ছোট গল্পে লিখে শেষ করা যাবে না।
প্রতিনিয়ত এমন শতশত ঘটনা যিনি ঘটিয়ে চলেছেন তিনি আর কেউ নন জনসেবায় দেশসেরা জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। যিনি ইতিমধ্যে তার সততা, জনসেবা ও নানামুখী উদ্বাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে এবং জনবান্ধব প্রশাসন গঠনের মাধ্যমে জনগণের মনি কোঠায় অবস্থান করছেন, প্রশংসিত হচ্ছেন সর্ব মহলে।
একজন মানবিক স্বপ্নচারী মানুষের পথচলার গল্প লেখাটা মোটেও সহজ কাজ নয়। আকাশ বিস্তৃত এই স্বপ্নিল জগতে কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা একজন মানবিক স্বপ্নবাজ মানুষের প্রতিদিনের পথচলায়।
অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, রুচি, শুভবুদ্ধি, দেশপ্রেম সব মিলিয়ে জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন ও মানবিক কামাল হোসেন আমার কাছে অন্যন্য। এমন মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে আমাকে করোনাকালীন আরো বেশি মানুষের জন্য কাজ করার সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে।

লেখক : এইচ এম নজরুল ইসলাম, সভাপতি রিপোর্টার্স ইউনিটি কক্সবাজার, সম্পাদক(ভারপ্রাপ্ত) দৈনিক আজকের কক্সবাজার বার্তা, সদস্য সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি।