সিবিএন ডেস্ক:

দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। এর জেরে দলের নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা তো উঠেছেই, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের দীর্ঘদিনের মিত্রদের সঙ্গেও টানাপোড়ন দেখা দিয়েছে দলটির। এরই অংশ হিসেবে এখন নতুন জোটের আওয়াজ উঠেছে বিএনপিতে। দলটির কিছু নেতা বলছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুটি জোট অর্থাৎ ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এরই মধ্যে অকার্যকর প্রমাণ হয়ে গেছে। এসব অকার্যকর জোটের বাইরে গিয়ে এমন জোট গঠন করতে হবে, যারা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে মাঠে নামতে পারবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিতে নতুন জোট গঠনের আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তাদের পুরনো দুই জোটের ভাঙনই। যেমন বিএনপির দুই দশকেরও বেশি সময়ের ২০ দলীয় জোটের দীর্ঘদিনের মিত্র ইসলামী ঐক্যজোট, শেখ শওকত হোসেন নিলুর (প্রয়াত) ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) অনেক আগেই জোট ত্যাগ করেছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনকে কেন্দ্র করে বিএনপিকে ত্যাগ করেছে জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ ও খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)। ওই নির্বাচনের ফলাফল বর্জন করেও বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সংসদে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপিও জোট ত্যাগ করে।

২০ দলীয় জোট এভাবে ভাঙনের কবলে পড়লে পরে কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীর বিক্রমের নেতৃত্বে আরও ৩-৪টি দল নিয়ে তৈরি হয় জাতীয় মুক্তি মঞ্চ। এই মঞ্চ তৈরির পর প্লাটফর্মটির শরিক এলডিপি, মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীকের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধানের জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপায় ভাঙন সৃষ্টি হয়। কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান আলাদা দল না বানালেও সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে ত্যাগ করেছেন। আর এলডিপি ও জাগপা এখন দুই ভাগে বিভক্ত।

অন্যদিকে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার কিছুদিন পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ করে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ। ফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামও এখন খণ্ডিত। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডিও খণ্ডিত হয়েছে। এছাড়া বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ জামায়াতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের মধুচন্দ্রিমারও অবসান চাইছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির হিসাব-নিকাশে ধাক্কা খাওয়া ২০ দলীয় জোট বা ঐক্যফ্রন্ট অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে সবার কাছেই স্পষ্ট। সেজন্যই উঠেছে বৃহত্তর জোট গঠনের এ আওয়াজ। এ জোটের পক্ষের লোকজনের ধারণা, এমন প্লাটফর্ম গড়ে উঠলে সরকারবিরোধী সকল শক্তি এক মঞ্চে আসতে পারে।

এ বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রেক্ষাপট যদিও এখনো বহাল আছে, তবে এ জোটের আঙ্গিক ও পরিসর বাড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। মাঝে গণফোরাম ও জেএসডির অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং করোনা মহামারি কিছুটা সময় কেড়ে নিয়েছে। তবে উদ্যোগ এখনো সচল আছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, হামলা-মামলায় বিএনপির শক্তি ক্ষয় হয়েছে। সরকার পরিবর্তন করতে হলে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে রাজপথে নামতে হবে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মহল থেকে সরকারকে বাধ্য করাতে হবে। সেজন্য ডান-বাম সবাইকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে চায় বিএনপি।

সূত্র বলছে, সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল নিয়ে ‘বৃহত্তর জোট’ গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য বিএনপির তিন সিনিয়র নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতাও কাজ করছেন। তারা ইতোমধ্যে বাম দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগও শুরু করেছেন।

যদিও জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব খুব বেশি সাড়া পাবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ বাম নেতারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার মাধ্যমে জনগণের কোনো কল্যাণ হবে না। আর বিএনপি জামায়াত ত্যাগ না করলে তাদের সঙ্গে এক মঞ্চে ওঠা সম্ভব নয়। জোট গঠনকে কেন্দ্র করে বাম দলগুলো কোনো ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি বা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে এক হবে না।

বিএনপি সূত্র বলছে, নতুন জোট গঠন নিয়ে নেতাদের দুই ধরনের মত রয়েছে। কেউ কেউ ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে দিয়ে সব দলকে নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠন করার পক্ষে। একইসঙ্গে দুই জোটে থাকা ছোট ছোট কয়েকটি দল বাদ দেয়ার পক্ষেও তারা। আবার অনেকে ২০ দল স্বতন্ত্র রেখে বাম দলগুলো নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের পরিধি বাড়ানোর পক্ষে। তবে এখনো এ বিষয়টি আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।

নতুন জোটে আনার জন্য বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করছেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিইউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, খালেকুজ্জ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, সাইফুল হকের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলনের সঙ্গেও কথা বলছেন তারা। এমনকি ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর যে নতুন দল গঠনের কথা বলছেন, সেই সম্ভাব্য দলের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করেন, সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে পুরনো মিত্রদেরও এই জোটে শামিল করা উচিত। সেক্ষেত্রে তারা ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ, জেবেল রহমান গানি ও খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার সঙ্গেও আলোচনা করতে চান। তারা ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গেও আলোচনার দরজা খোলা রাখতে চান।

দলীয় সূত্র জানায়, নতুন জোট করে বিএনপি নির্বাচন পুনর্গঠন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন করে নির্বাচনের দাবি জানাবে। যেটিকে তারা আগাম নির্বাচনও বলতে পারে।

সূত্র আরও জানায়, বৃহত্তর জোট গঠনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদেরও মত রয়েছে। তবে এ নিয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে এখনো কথা বলেননি বিএনপি নেতারা।

এ বিষয়ে দলটির এক নেতা বলেছেন, জোট গঠনের প্রক্রিয়া এখনো প্রাথমিক অবস্থায় আছে। বিরোধী সব দলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা হয়েছে। তাদের মতামত জানার পর এ বিষয়ে দলীয় ফোরামসহ ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে অলোচনা করা হবে। সবার মতামত নিয়েই বৃহত্তর জোট গঠন করা হবে।

এ জোট গঠনের উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণের চিন্তাভাবনা চলছে। এ ধরনের স্বৈরাচারকে হটাতে হলে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। সেটা কী ফরম্যাটে হবে তা সময়ের ব্যাপার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, নিরপেক্ষ নির্বাচন ইত্যাদি বলতে গেলে একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। আমরা চার্টার তৈরি করব। সেখানে মিনিমাম কিছু দফা একসঙ্গে থাকবে। এর আগে ২০ দল, ঐক্যফ্রন্ট, বামদলসহ অন্য ছোট-বড় যেসব দল আছে, তাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করব। একই ফর্মুলায় যারা আসবে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা হবে। এ ব্যাপারে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা আছে। একই প্লাটফর্মে এসে আন্দোলন করা হয়, আবার যুগপৎ করা যায়।’

জামায়াত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আলাপ-আলোচনা হবে, তখন তো এগুলো আসবে। এই ইস্যুটি মীমাংসা করেই তো ঐক্যবদ্ধ একটা চার্টার হবে। এর ভিত্তিতেই আন্দোলন হবে।’