ফজলুর রহমানঃ
দিনটি কেমন যাবে, তা সকাল দেখেই অনেকটা অনুমান করা যায়। সারাদিনের পূর্বাভাস সকালবেলায়ই পাওয়া যায়।দিনের শুরুটা যদি ভালো হয়, তাহলে দিনের বাকি সময়টাও ভালো কাটার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
কিন্তু যদি গোড়াতেই গলদ থেকে যায়, তাহলে পুরো দিনে ভালো কিছুর সম্ভাবনাও কমে যায়। তাই সকালটা আমরা কীভাবে সুন্দর করে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে ভাবা দরকার।
উনিশ শতকের অন্যতম পণ্ডিত ও সাহিত্যিক মদন মোহন তর্কালঙ্কার বলেছিলেন, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।’ এই কথার আসল মাহাত্ম্য এই যে, কোনও কাজের শুরুটা  ইতিবাচক হলে শেষটাও যেমন প্রত্যাশিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তেমনি দিনটা সতেজ, ফুরফুরে ভাবে শুরু হলে বাকি বেলায়ও ইতিবাচক থাকা যায়। কাজকর্মেও যার ইতিবাচক প্রভাব থাকে।
তাই বলা যায়, আপনার পুরো দিনটি কেমন যাবে তা নির্ভর করে সকালে আপনি কিভাবে দিনটি শুরু করলেন তাঁর উপর। সকালে করা কিছু কাজ আপনাকে রাখবে সারাদিন কর্মক্ষম, রাখবে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ। আবার এমন কিছু কিছু বদভ্যাস আছে যেগুলো করা মোটেও উচিত নয়। তাই এই বদভ্যাসগুলো অবশ্যই বদলে ফেলতে হবে, আর তার পরিবর্তে কিছু ভালো কাজ করতে হবে। এতে করে আপনার সম্পূর্ণ দিন ভালো এবং মনোরম হয়ে উঠবে। আসুন ‘এন্টারপিনিয়ার’ থেকে  জেনে নেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কোন কাজগুলো করা উচিত যা আপনি আগামীকাল থেকেই শুরু করতে পারেন:

স্ট্রেচিং করুন:
সকালে আমরা যখন ঘুম থেকে উঠে থাকি তখন আমাদের মেরুদন্ড ও শরীরের অন্যান্য পেশী কিছুটা শক্ত হয়ে থাকে।এতে ঘুম থেকে উঠেই স্ট্রেচিং অথবা শরীরকে প্রসারিত করতে হয়।ফলে আমাদের শরীরের উৎপাদনশীলতা ঠিক থাকে। ঘুম থেকে উঠেই তিন-চার বার স্ট্রেচিং করুন এবং কয়েকবার গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিন। ও ১০ থেকে ১৫ মিনিট ইয়োগা করে নিন।

ফোন বন্ধ রাখুন:
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আপনি ফোন ও মেইল চেক করবেন না। কারণ এতে আপনার মেজাজ খারাপ হতে পারে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় নেমে পরার দরকার নেই বরং অফিসের কাজ অফিসেই করে ফেলুন। এতে মেইল দেখেই কাজ শুরু করার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। তবে, ঘুম থেকে উঠেই মেইল দেখবেন না।

পানি পান করুন:
সকালে ঘুম থেকে উঠেই খালি পেটে এক গ্লাস পানি পান করুন। দীর্ঘ সময় বিশ্রামে থাকা শরীরকে ঠিকমতো জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করবে পানি। এই এক গ্লাস পানি রক্তে অক্সিজেনের সরবরাহতে সাহায্য করবে এবং ঘুমঘুম ভাব কেটে গিয়ে শরীর হবে চাঙা।

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খান:
সকালের ব্রেকফাস্টে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। কারণ এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে। প্রোটিন অনেকটা সময় ধরে পেট ভর্তি রাখে এবং ক্ষুধা নিবারন করে। আপনি যখন ক্ষুধার্ত কম হবে তখন আপনি সাধারণভাবেই কম খাবেন। এতে করে আপনার ওজনও কমবে।

১৫ মিনিট হাঁটুন:
হাঁটার চেয়ে উত্তম কোনো ব্যায়াম হতে পারে না। প্রতিদিন সকালে অন্তত ১৫ মিনিট টানা হাঁটার অভ্যাস আছে অনেকেরই। আর যাদের এ অভ্যাস নেই তাদেরও অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। কারণ প্রতিদিন সকালে মাত্র ১৫ মিনিটের এ হাঁটা সারা দিন ভালো কাটাতে সাহায্য করে এবং স্বাস্থ্য ভালো রাখে। তাই নিয়মিত আলো-বাতাসপূর্ণ জায়গায় কমপক্ষে ১৫ মিনিট হেঁটে নিন।

সকালে উঠে হালকা নাশতা করে দিন শুরু করা স্বাস্থ্যকর। পেট ভরে খাওয়া ঠিক নয়। রাতের ঘুমের পর বা দীর্ঘ বিশ্রামের পর পুরো শরীর জাগতে কিছুটা সময় নেয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, দিনের শুরুতে হালকা গরম পানি ও হালকা নাশতা দিয়ে শুরু করা উচিত। এতে শরীরের বিপাক-প্রক্রিয়া ঠিক থাকে। দিনের প্রথম খাবার বা নাশতার আগে স্বাস্থ্যকর কিছু খাবার দিয়ে সকাল শুরু করতে পারে।

ভারতের মুম্বাইভিত্তিক পুষ্টিবিদ রুপালি দত্ত বলেন, সকাল শুরুর জন্য সঠিক খাবার পছন্দ করা গুরুত্বপূর্ণ।সকালে ঘুম থেকে জাগার দুই ঘণ্টা পরে নাশতা খাওয়া উচিত।

‘ওয়েবএমডি’ সূত্রে জানা যায়,এমন আরও কিছু কাজ আছে, যেগুলো সকালে ঘুম থেকে উঠেই করা উচিত নয়। আসুন জেনে নিই এসব কাজের কথা:

১. অন্ধকারে থাকবেন না
সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেকে বেশ খানিকটা সময় অন্ধকারে থাকেন। তাঁরা হয়তো ভাবেন, হুট করে সূর্যের আলো চোখে পড়লে তা খারাপ হবে। কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর সুয্যিমামার দেখা পাওয়াটা খুব দরকার। কারণ এটি মানুষের শরীরের প্রাকৃতিক ঘড়ির সময় নির্ধারণ করে দেয়। এতে আপনার ঘুম সঠিক সময়ে এবং হজমক্রিয়া ভালোমতো হবে। এ ছাড়া সূর্যের আলো শরীরে লাগলে ভিটামিন ডি-র অভাব পূরণ হয়।

২. তাড়াহুড়ো নয়
কেউ কেউ তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে ওঠেন। দুম করে উঠে বসে আবার হাঁটাচলাও শুরু করে দেন। শোয়া থেকে উঠে বসার কারণে পায়ে রক্ত যেতে দেরি হয়। এতে করে রক্তচাপ হুট করে আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে। এতে কিছুক্ষণের জন্য মাথা ঘোরানো বা বিহ্বলতার ভাব হতে পারে। রক্তচাপ বেশি কমে গেলে তা মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই ধীরে-সুস্থে ঘুম থেকে উঠতে হবে। এতে বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা এড়ানো যাবে।

৩. বাদ দেবেন না কফি বা চা
ঘুম থেকে ওঠার পর কফি বা চা পানের অভ্যাস থাকে সবারই। কেউ কেউ আবার স্বাস্থ্যগত কারণে কফি বা চা বাদ দিতে চান। কিন্তু হুট করে এসব বাদ দেওয়া উচিত নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাফেইনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে মানুষের শরীর। হঠাৎ করে কফি বা চা বাদ দিলে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, জ্বর, বমির ভাব হতে পারে। এ ছাড়া মনোযোগের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। যদি একেবারেই ছাড়তে চান, তবে ধীরে ধীরে মাত্রা কমিয়ে দেওয়া ভালো।

৪. দাঁতের কথা ভুলে যান?
ঘুম থেকে উঠে কেউ কেউ দাঁত না মেজেই প্রাত্যহিক কাজ করা শুরু করে দেন। কারও আবার ঘুম থেকে উঠেই কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকে। কিন্তু সকালে উঠেই না মাজলে দাঁতে টারটার নামের এক ধরনের পদার্থ জমা হতে শুরু করে। এসব থেকে মুখের দুর্গন্ধ, ক্যাভিটিজ ও দাঁতের অন্যান্য রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া কফি পানের পরপরই দাঁত ব্রাশ করা উচিত নয়। কারণ কফিতে থাকা অ্যাসিড দাঁতের এনামেলকে দুর্বল করে দেয়। কফি খাওয়ার পর পরই ব্রাশ করলে এনামেল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই কফি বা লেবুর শরবত পানের অন্তত ৩০ থেকে ৬০ মিনিট পর দাঁত মাজা উচিত।

৫. ঘুম চোখেই ই-মেইল?
স্মার্ট ডিভাইস এখন আমাদের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। ই-মেইল দেখা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিউজফিডে চোখ বোলানো—সব সময় এগুলো করতে করতে বেড়ে যায় মানসিক চাপ ও উদ্বেগ। এই চাপ ও উদ্বেগ আর বেড়ে যায় যদি ঘুম থেকেই দেখতে বসেন ই-মেইল। এতে করে সকাল সকালই বাড়তি চাপে পড়ে যেতে হয়। এটি থাকে সারা দিনই। তাই অন্তত সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর কয়েক ঘণ্টা ই-মেইল বা ফেসবুক না দেখাই ভালো। এতে মন প্রশান্ত থাকবে। ধীরে ধীরে কর্মব্যস্ত দিনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

৬. পরিকল্পনা ছাড়াই দিন শুরু?
কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই দিন শুরু করলে তা মোটেই ভালো ফল দেয় না। এতে করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও শেষে আর করা হয়ে ওঠে না। তাই প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পরপরই দিনের কাজের একটি তালিকা বানিয়ে ফেলুন। আর সেই অনুযায়ী এক-একটি কাজ শেষ করুন। তাহলেই দেখবেন দিন শেষে সাফল্যের হাসি ফুটেছে মুখে।

৭. না খেয়েই সকাল পার?
অফিসের তাড়াহুড়োয় অনেকে না খেয়েই বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। কারও আবার সকালে কম খেয়ে দুপুরে বেশি খাওয়ার অভ্যাস। কিন্তু এ দুয়ের কোনোটাই ভালো নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা সকালে নিয়মিত স্বাস্থ্যকর নাশতা খান, তাদের শরীরে চর্বি জমে কম। তা ছাড়া ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কম থাকে। কাজেই সকাল শুরু করুন একটি স্বাস্থ্যকর নাশতা দিয়ে। সারা দিন থাকুন ফুরফুরে।

ফজলুর রহমান
প্রাবন্ধিক, রচনাসাহিত্যিক এবং সহকারী রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।