জসিম উদ্দীন :
‘সবার সুখে হাসবো আমি কাঁদব সবার দুঃখে, নিজের খাবার বিলিয়ে দেব অনাহারীর মুখে’- জসীম উদ্দীন-এর কবিতার মতই বাস্তবে নিজের জীবন গড়েছিলেন কক্সবাজারের আবদুশ শুক্কুর প্রকাশ শুক্কুর ফকির।

পেশায় ভিক্ষুক হলেও তিনি খাবার তুলে দিতেন অনাহারীর মুখে। মানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে দেশব্যাপী আলোচিত সেই ভিক্ষুক আবদু শুক্কুর ৬৫ বছর বয়সে এসে মারা গেছেন। শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) কক্সবাজার পৌরসভার নুনানিয়ার ছাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় তার মৃত্যু হয়েছে।

শুক্কুরের আত্মীয় স্বজনের অভিযোগ, আবদু শুক্কুর গত কয়েক মাস ধরে গুরুতর অসুস্থ থাকলে চিকিৎসায় জন্য বিভিন্ন মহলে ধর্ণা দিয়েও কোনো সাড়া পাননি। বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান।

এদিকে মানবিক ভিক্ষুক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আবদু শুক্কুরের মৃত্যুর খবরে কক্সবাজারের অনেকেই ফেসবুকে শোক প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ ভিক্ষুক আবদু শুক্কুরের মৃত্যুতে ‘মানবতার মৃত্যু’ হয়েছে বলে উল্লেখ করছেন।

স্থানীয়রা জানান, সারাদিন ভিক্ষাবৃত্তি করে যা আয় করেন, সেখান থেকে অর্ধেক টাকা অন্ধ আর চলত্শক্তিহীন ভিক্ষুকদের দান করে দিতেন আবদু শুক্কুর।

শুধু তাই নয়, আবদু শুক্কুর সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে সবসময় আলোচনায় থাকতেন।

স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় কবলিত ক্ষতিগ্রস্তের পাশে শুক্কুর দাঁড়িয়েছিলেন সবার আগে। সেসময় ঘূর্ণিঝড় কবলিত মানুষের জন্য নিজের ভিক্ষার টাকা সেনাবাহিনীর হাতে দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন তিনি।

সে থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচনায় ও নিয়মিত গণমাধ্যমের শিরোনামে থাকতেন ভিক্ষুক আবদু শুক্কুর।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের হয়ে ভোট ভিক্ষা করে ফের আলোচনায় আসেন। করোনাকালেও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শুক্কুর।

যদিও মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না আবদু শুক্কুরের। মৃত্যুর আগে আবদু শুক্কুরের অভিযোগ ছিল, কক্সবাজারের সাবেক একজন ডিসি তাকে একটা খাস জমি দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঘর করে বসবাস করে আসছিলেন।

কিন্তু দুই বছর আগে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য সে বাড়িটি উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে অবকাঠামোর টাকা ও জমিসহ সরকারিভাবে ঘর করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি প্রশাসন।

আবদু শক্কুরের স্বজন সুজন ও মিজানের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা করার পরও একটি চক্র মোটা অংকের কমিশন দাবি করেন। ঘুষের টাকা দিতে না পারায় ক্ষতিপূরণের টাকা আর উত্তোলন করতে পারেননি আবদু শুক্কুর।

তাদের দাবি, মৃত্যুর আগে জেলা প্রশাসক ও ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাদের কাছে গিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলনের জন্য সহায়তা চেয়েছিলেন আবদু শুক্কুর। কিন্তু অনেকেই তাকে উল্টো ধমক দিয়েছিলেন।

এ কারণে ক্ষতিপূরণের টাকার আশা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন শুক্কুর। এক পর্যায়ে বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। তবে ক্ষতিপূরণের কী পরিমাণ টাকা তিনি পাবেন তা জানাতে পারেননি কেউ।

স্থানীয় কাউন্সিলর মিজানুর রহমান বলেন, অবকাঠামো বাবদ ক্ষতিপূরণের টাকা আবদু শুক্কুরের নামে ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় জমা রয়েছে। তবে টাকার পরিমাণ কত, ঠিক এ মুহূর্তে মনে নেই।

তিনি বলেন, একসময় ওই টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে ভিক্ষুক শুক্কুর আমার কাছেও এসেছিল। কিন্তু ঘুষের কথা জেনে তিনি রাজি হননি। পরে শুনেছি জনৈক শুক্কুর হাজি নামক ব্যক্তির ছেলের সাথে তার এ নিয়ে কথা হয়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেনের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিবার রিং দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি, তাই বিষয়টি নিয়ে অবগত নই। তবে কাগজপত্র নিয়ে শুক্কুরের পরিবারের কেউ যোগাযোগ করলে দ্রুত টাকা উত্তোলন করে দেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।