এম. বেদারুল আলম:
আমি রামু কলেজের ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হওয়াটা কাকতালীয় ভাবে।কক্সবাজার সরকারি কলেজে তখন জামাত-শিবিরের দাপট। সর্বত্রে তাদের জয়জয়কার। কলেজে ভর্তি হলেই তাকে অবশ্যই ছাত্রশিবিরের কর্মী অথবা সমর্থক হতেই হবে। মাধ্যমিকে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজ দ্বিতীয় দিন আমাকে যোগদান করতে হলো মিছিল স্লোগানে।মুখরিত বিশাল মিছিল যখন কলেজ গেট হইয়ে লিংক রোড এগুচ্ছিলেন তখন আমার বড় ভাই ফিরোজ আহমেদ পিএমখালী থেকে কক্সবাজার শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে আমাকে মিছিলে দেখলেন। তিনি ডান রাজনীতি মোটেও পছন্দ করতেন না। রাত্রে বাড়িতে পৌঁছে আমাকে ডাকলেন, আর বললেন কলেজে পড়তে হবে না। দুদিন কলেজে যাওয়া বন্ধ রইল। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফরদিন রাজি করালাম এডমিশন চেঞ্জ করে অন্য কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য। এমনিতে বাড়ীর অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ তার মধ্যে আরেকটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়াটা তার জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আমাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে শিক্ষার পথ সুগম করতে ধার দেনা করে এডমিশন ট্রান্সফার করলেন রম্যভুমির একমাত্র কলেজ রামু ডিগ্রি কলেজে। আমি হয়ে গেলাম সপ্তাহের ব্যবধানে ২ কলেজের ছাত্র।
তখন রামু কলেজের অভ্যন্তরে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে মানুষ গড়ার মহান ব্রত নিয়ে নান্দনিক শিক্ষা পরিবেশ উপহার দিয়েছিলেন যিনি তিনি মহান শিক্ষাবীদ,সমুদ্র ও জনপথের সন্তান বরেণ্য শিক্ষক উক্ত কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ প্রফেসর মোশতাক আহমেদ।

শুরু হলো কলেজ জীবনের যাত্রা। রামু কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের সেই পরিবেশ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে জমজমাট হৃদয়াবেগ ভালোবাসা, শ্রদ্ধার বীজ বপনে যিনি দক্ষ চালক ছিলেন তিনিই মোশতাক স্যার। শুরু হলো পাঠদান। পরিচিত ক্লাসের প্রথম দিকে এলেন অধ্যক্ষ মোশতাক স্যার। স্যারের ৪৫ মিনিটের ক্লাশ মনে হল জীবনের অমোঘ শিক্ষার একটি সোপান। কলেজে আসার আগে স্যারের মেধা ও জ্ঞানের যে গল্প শুনেছিলাম তার সব ছাপিয়ে তিনি যেন রিয়েল হিরো। প্রতিটি কথা, বাক্য, উপদেশ, আদেশ, সাহিত্য, আলাপন যেন আজো বাজে চিত্তের একাকিত্ম বোধের মধ্যে। জাগরিত হই জীবনকে পুণর্জন্ম দিতে। বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে স্যারের সেদিনের প্রতিটি কথা যেন এক একটা অমীয় বাণী। কয়েকটি কথা না বললে নয়। তোমরা আমার সন্তান, গাড়ি ভাংচুর করবেনা, কলেজ অভ্যন্তরে কোন রাজনৈতিক কর্মসুচি চালাবেনা, কলেজ সকলের এর পরিবেশ, শিক্ষায় সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে, ধুমপান মুক্ত ক্যাম্পাস, সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে জড়িতরা অগ্রাধিকার পাবে, আর্থিক সমস্যায় জড়িত শিক্ষার্থীদের জন্য কলেজ থেকে সহায়তা দেয়া হবে। তোমরা একদিন প্রফেশনাল লাইফে যাবে কিন্তু কোন ভুল করা যাবেনা। স্যারের যে কথাটি সব সময় বাজে তা হলো “ছাত্র জীবনের ভুল মার্জনীয় কিন্তু শিক্ষকতা জীবনের ভুল অমার্জনীয়”।
ছাত্র হিসাবে সহ পাঠ ক্রমিক কার্যকলাপে আমার অংশগ্রহণ আমাকে স্যারদের কাছে আদর ও ভালবাসা ও গ্রহনযোগ্যতা এনে দিল। কলেজ ডিবেটিং,সাহিত্য চর্চা,দেয়ালিকা, ক্রীড়ায় আমার নৈপুণ্য আমাকে স্যারদের প্রিয় হতে বাড়তি সুবিধা এনে দিল। আমি তখন জেলার বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছড়া,কবিতা,ছোটগল্পের নিয়মিত লেখিয়ে। মোশতাক স্যার আমার সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে জানতেন।সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা হবে। মোশতাক স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। ভয়ে স্যারের দ্বি তলার কক্ষে অফিসে অনুমতি নিয়ে প্রবেশের পর দেয়ালিকা প্রকাশের কথা বললেন। তুমি পারবে। আমি সম্পাদনা পরিষদ করে দেব। নোটিশ যাবে। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে দেয়ালিকা প্রকাশের ভার আস্থা রেখে আমার উপর ন্যস্ত করে জীবনের প্রথম দেয়ালিকা প্রকাশের সুযোগ করে সাহসে পিঠ ছাপড়ে আজ এতটুকু আসতে যার ভুমিকা অনস্বীকার্য তিনিই আমার পরম শিক্ষা গুরু মোশতাক স্যার। আমার নামকরণে “আলো আরো আলো” দেয়ালিকায় যারা সহপাঠী ও শ্রদ্ধাস্পদ সকল স্যারদের জন্য অনেক দোয়া ও নিরাপদ জীবন কামনা করছি। মোশতাক স্যারের আস্থার প্রতিদান দিয়ে রামু কলেজের সেদিনের দেয়ালিকা আজো কলেজে ঠাঁই দাড়িয়ে আছে।
স্যারের আরো একটি নোটিশে আমাকে ডাকা হলো। স্বাধীনতা দিবসে কলেজ থেকে বেরোবে কলেজ ম্যাগাজিন। রামু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এ কলেজ থেকে কোন ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়নি জানালেন অধ্যক্ষ মোশতাক স্যার। ইকোনমিকস এর নিজাম স্যারকে উপদেষ্টা করে, আমাকে সম্পাদক মনোনীত করে সম্পাদনা পরিষদ গঠন করে মোশতাক স্যার কলেজ ম্যাগাজিনের দায়িত্ব আমার মত না খান্দা নালায়েক ছাত্রকে কেন যে গুরুভার দিয়েছিলেন তা মনে পড়লে জল নেমে আসে। জ্ঞানকোষ নামের সেই কলেজ ম্যাগাজিন নানা কারনে আলোর মুখ দেখেনি। আর্থিক সংকট, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ৫ ফর্মার কলেজ ম্যাগাজিনের প্রসব যন্ত্রণা আজো বয়ে বেড়াই আমি অভাগা ছাত্র।
কলেজ ম্যাগাজিন ঘিরে একটি ঝামেলা হয়। জলসিড়ি ভেঙ্গে পড়ে গ্রন্থের লেখক কক্সবাজার সদরের সে সময়ের নির্বাহী কর্মকর্তা ছৈয়দ মনজুরুর রহমানের আর্টিকেল সংগ্রহে কলেজ থেকে আমরা সম্পাদনা পরিষদ কক্সবাজার সদর উপজেলায় আসার সময় রামু কলেজে গেইটে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। অনেক গাড়িকে সিগনাল দিলেও কোন গাড়ি আমাদের নেয় না। রাগে ক্ষোভে বন্ধু নজরুল সৌদিয়া পরিবহনের একটি গাড়ির কাচ ভেঙে দেয়। রাস্তা জ্যাম লেগে যায়। আমরা কৌশলে পালিয়ে অপর একটি গাড়ি করে সদরে চলে আসি। পরের দিন লেখা কালেকশন করে কলেজে আসি। ইতোমধ্যে চাউর হয়ে যায় আমার নেতৃত্বে গাড়ি ভাংচুর হওয়ার কথা। মোশতাক স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি সবিস্তারে স্যারকে বুঝানোর পর কলেজ থেকে ২০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়। অথচ স্যার আমাকে কোন টাকা দেওয়ার জন্য কোন চাপ দেননি। উল্টো সস্নেহে আদর করে আমার কাজের অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। স্যারের পিতৃ স্নেহ ভালোবাসা আমার এতটুকু আসতে, বাকি পথ চলতে সাহস যোগাবে।
পেশাগত জীবনে স্যারের সাথে রয়েছে অনেক স্মৃতি । কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি স্যারের একটি জটিল অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করে। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের প্রেমের কবিতার সমাহার নিয়ে ইংরেজি অনুবাদের সরস কাব্যগাঁথা। বইটির নাৃ দেয়া হয়েছে গ্লানিংস ফর্ম জীবনানন্দ দাশ। এত কঠিন সরস কাব্য বিশ্লেষণ যে স্যার কত সহজে ইংরেজিতে কাব্য রুপ দিয়েছেন তা দেশের বিখ্যাত সাহিত্যিকগণ সাহস দেখাননি। কবি বলেই সাহিত্যের পরতে পরতে কাব্যিক পরমানন্দের মূর্তরূপ ফুটিয়ে তোলার সাহস একমাত্র আমার মোশতাক স্যার দেখিয়েছেন।মোশতাক স্যারের অনুদিত বনলতা সেনের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রবীন্দ্র ভারত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফকলোরিস্ট ড. অনিমেষ পাল সেদিন বলেছিলেন ” প্রফেসর সাহেব কবি বলেই বনলতা সেন কবিতার কাব্যিক অনুবাদ যথার্তরুপে তিনি ফুটিয়ে কবিতায় রেখেছেন”।
আমি ধন্য। আমার মত নগন্য ছাত্র স্যারের সানিধ্য পেয়ে জীবনে কিছু অন্তত যোগ করতে পেরেছি। পেয়েছি আদর,ভালোবাসা, উপদেশ, শাসন। মানুষ মরনশীল। নশ্বর ধরায় কেউ আজীবন থাকবেনা। স্যারের কৃতি,কৃতিত্ব, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অগুনিত শিক্ষার্থীর মাঝে কিঞ্চিত হলেও বেচে থাকবে। স্যারের চলে যাওয়ার ক্ষতি হয়তো কেউ পুরণ করতে পারবেন না। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন কর্মের, সৃষ্টির মধ্যে। মহান করুনাময় এ জ্ঞানতাপসের সব নেক আমল কবুল করে জান্নাতে পরম উদ্যানে আসীন করুন। আমিন।

লেখক
শিক্ষক, সাংবাদিক ( প্রয়াত প্রফেসর মোশতাক আহমেদের ছাত্র)