বিবিসি বাংলা:

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান চীন নিয়ে তার এবং তার সংস্থার অবস্থান খোলাখুলি প্রকাশ করেছেন এবং বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে স্পর্শকাতর বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরেছেন।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় দীর্ঘ এক লেখায় জন র‌্যাটক্লিফ বলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন “গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি“ হিসাবে দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি চুরি করে চীন তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে এবং বিশ্ব বাজার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে হটিয়ে দিচ্ছে।

এসব কথাতেই থেমে থাকেননি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক। তিনি বলেন চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংঘাতের জন্য তৈরি হচ্ছে। “চীনের এখন লক্ষ্য অর্থনীতি সামরিক এবং প্রযুক্তিকে বিশ্বে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।“

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় চীন বলেছে মি র‌্যাটক্লিফের কথা ”মিথ্যার ফুলঝুরি”।

শুক্রবার বেইজিংয়ে তাদের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং বলেন “আমরা আশা করি মার্কিন রাজনীতিকরা সত্যকে মর্যাদা দেবেন, ভুয়া সংবাদ তৈরি এবং বিক্রি বন্ধ করবেন … না হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা আরো প্রশ্নবিদ্ধ হবে।“

‘রাশিয়া নয়, শত্রু এখন চীন‘

মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান জন র‌্যাটক্লিফ তার লেখায় বলেন, আমেরিকার প্রধান শত্রু এখন রাশিয়া নয়, বরঞ্চ চীন।

তিনি বলেন, চীন যে “অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তিতে“ লিপ্ত রয়েছে তার লক্ষ্যই হচ্ছে “চুরি, নকল এবং হুবহু পণ্য তৈরি“। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, সম্প্রতি চীনা যে প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তি চুরির জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তারা যখন সারা বিশ্বে উইন্ড টারবাইন বিক্রি করেছে, তখন চুরির শিকার মার্কিন কোম্পানি ব্যবসা হারিয়ে বহু শ্রমিক কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মেধা-স্বত্ব চুরি হচ্ছে। প্রযুক্তি চুরির জন্যে এফবিআই গোয়েন্দাদের হাতে অনেক চীনা নাগরিক আটক হচ্ছেন। “এমনকি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রধান গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত চীনের কাছ থেকে মাসে ৫০ হাজার ডলার করে পাচ্ছিলেন।“

সামরিক শক্তি বাড়াতে চীন কতটা মরিয়া তা বলতে গিয়ে মি র‌্যাটক্লিফ দাবি করেন যে আমেরিকার কাছে গোয়েন্দা এমন তথ্য রয়েছে যে চীন কৃত্রিমভাবে তাদের সৈন্যদের শারীরিক এবং মানসিক ক্ষমতা বাড়াতে সৈন্যদের ওপর সরাসরি পরীক্ষা চালাচ্ছে।

মি র‌্যাটক্লিফ লিখেছেন শুধু আমেরিকা নয়, অন্যান্য অনেক দেশই এখন চীনের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

“চীন বিশ্বাস করে বিশ্ব ব্যবস্থার শীর্ষে তাদের না থাকা ঐতিহাসিকভাবে ভুল এবং অন্যায়। সেই বাস্তবতা তারা বদলাতে চায়।“

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন সবচেয়ে বড় হুমকি হিসাবে হাজির হয়েছে - জন র‌্যাটক্লিফ, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন সবচেয়ে বড় হুমকি হিসাবে হাজির হয়েছে – জন র‌্যাটক্লিফ, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান

এছাড়া, তিনি বলেন, চীনারা যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস অর্থাৎ পার্লামেন্ট সদস্যদের ওপর প্রভাব বিস্তারে ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। “বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে চীন প্রভাবিত করছে যাতে তারা যেন চীনের ব্যাপারে নমনীয় অবস্থান নিতে স্থানীয় রাজনীতিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।“

তিনি বলেন, কংগ্রেস সদস্যদের ওপর প্রভাব বিস্তারে চীনের চেষ্টা “রাশিয়ার চেয়ে ৬ গুণ এবং ইরানের চেয়ে ১২ গুণ বেশি।“

চীনের প্রতিক্রিয়া

শুক্রবার তাদের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং বলেন, মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের লেখা নেহাতই “স্পর্শকাতর একটি শিরোনাম“ এবং কোনো কথারই কোনো প্রমাণ মি র‌্যাটক্লিফ দেননি।

“তার লেখা গাদা-খানেক মিথ্যার ফুলঝুরি যা আগেও অনেকবার শোনা গেছে।“ চীনা মুখপাত্র বলেন, “আমরা আশা করি মার্কিন রাজনীতিকরা সত্যকে মর্যাদা দেবেন, ভুয়া সংবাদ তৈরি এবং বিক্রি বন্ধ করবেন। রাজনৈতিক ভাইরাস এবং মিথ্যা ছড়িয়ে চীন-মার্কিন সম্পর্ক নষ্ট করার প্রয়াস বন্ধ করবেন। না হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা আরো প্রশ্নবিদ্ধ হবে।“

বুধবার বেইজিংয়ের চীনা পররাষ্ট্র দপ্তরের ঐ মুখপাত্র বলেছিলেন, “চীনা একটি প্রবাদ রয়েছে যে মন যা বিশ্বাস করে, চোখ সেটাই দেখে…আমরা আশা করি সবাইকে গুপ্তচর হিসাবে বিবেচনা করার মানসিকতা থেকে আমেরিকা বেরিয়ে আসবে।“

এছাড়া, মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে চীনা দূতাবাসের একজন মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টর্সকে বলেন, মি র‌্যাটক্লিফের লেখায় বোঝা যায় যে “এখনও যুক্তরাষ্ট্রে কিছু মানুষের মধ্যে শীতল যুদ্ধকালীন মানসিকতা এবং আদর্শিক পক্ষপাতদুষ্টতা কতটা শক্ত।“

চীনকে আটকাতে নানা কৌশল

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত কয়েক বছর ধরে নানা ক্ষেত্রে চীনকে কোণঠাসা করতে একের পর এক ব্যবস্থা নিয়েছেন। চীনও অবশ্য পাল্টা জবাব দিয়েছে।

দুই দেশই একে অন্যের আমদানি পণ্যের ওপর শত শত কোটি ডলারের বাড়তি শুল্ক বসিয়েছে। বেশ কতগুলো চীনা প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এমনকি গতকালও (বৃহস্পতিবার) হোয়াইট হাউজ চারটি চীনা কোম্পানিকে – চিপ নির্মাতা এসএমআইসি, চীনের জাতীয় জ্বালানি সংস্থা সিএনওওসি, চীনা নির্মাণ প্রযুক্তি তৈরির প্রতিষ্ঠান চায়না কন্স্ট্রাকশন টেকনোলজি কোম্পানি এবং চায়না ইন্টারন্যাশনাল কনসাল্টিং কর্পোরেশন – কালো তালিকাভুক্ত করেছে। অভিযোগ – এসব কোম্পানির সাথে চীনা সেনাবাহিনীর সম্পর্ক রয়েছে।

এ বছরের গোড়ার দিকে অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে আমেরিকা হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়। পাল্টা জবাবে, চীন চেংডুতে মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এমনকি দুই দেশ এক অন্যের সাংবাদিকদেরও বহিষ্কার করেছে।

২০১৬ সালে চীনা প্রেসিন্ট শি জিন পিংয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় এক বৈঠকে তৎকালীন প্রেসিডন্ট ওবামা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত পাঁচ বছরে দুই দেশের সম্পর্ক অনেক খারাপ হয়েছে

২০১৬ সালে চীনা প্রেসিন্ট শি জিন পিংয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় এক বৈঠকে তৎকালীন প্রেসিডন্ট ওবামা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত পাঁচ বছরে দুই দেশের সম্পর্ক অনেক খারাপ হয়েছে

নতুন এক শীতল যুদ্ধ কি অবশ্যম্ভাবী?

চীনকে প্রধান শত্রু, প্রধান হুমকি বা চ্যালেঞ্জার হিসাবে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের বিবেচনায় হয়তো তেমন বিস্মিত নয় চীনা নেতৃত্ব বা অধিকাংশ বিশ্লেষক।

বেশ কবছর ধরেই বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বৈরিতা দিনে দিনে বাড়ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ে এসে তা অনেকটাই প্রকাশ্যে চলে এসেছে।

বেইজিং ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ওয়াং হুহাইওর মতে, ১৯৭৯ সালে দুই দেশের মধ্যে পুরোমাত্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর পারস্পরিক অবিশ্বাস এত খারাপ কখনো হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা এশিয়া সোসাইটির মার্কিন-চীন সেন্টারের পরিচালক অরভিল শেল সম্প্রতি বিজনেস ইনসাইডার পত্রিকাকে বলেন, “আমরা একটি শীতল যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।“

সম্প্রতি বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে বলেন, বেশ অনেকদিন ধরেই চীনকে আমেরিকা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতি প্রধান হুমকি হিসাবে বিবেচনা করছে।

ড. আলী বলেন , সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নেয়, তাতে পরিষ্কার বলা আছে যে আর কোনদিনই বিশ্বের কোথাও তারা এমন কোন শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দেবে না যারা আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

তিনি বলেন, “অনেকদিন ধরেই চীনকে তারা ভবিষ্যতে সেই ধরণের একটি চ্যালেঞ্জ মনে করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক সরকারি সমস্ত নথিপত্র, দলিলে তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।“

ড. আলী মনে করেন, শুধু ট্রাম্প প্রশাসন, সুযোগ পেলেই চীনকে ঘায়েল করার বিষয়ে আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একধরনের ঐক্যমত্য রয়েছে।

তিনি বলেন, চীনের প্রতি বৈরিতা আমেরিকা শুধু নথিপত্রের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বেশ কিছুদিন ধরেই কার্যকরী করতে শুরু করেছে। যেমন, তিনি বলেন, চীনের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সাথে, যেমন ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম, সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশগুলোর সাথে যৌথ সামরিক মহড়া করছে।যেসব ডব্লিউ টি ও বা ডব্লিউ এইচ ওর মতো যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চীনের প্রভাব রয়েছে, যেগুলোর সুবিধা চীন নিচ্ছে সেগুলোকে খাটো করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

রয়টার্স বার্তা সংস্থা বলছে, চীনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে সতর্ক করা হয়েছে যে চীনের প্রতি যে বৈরি মনোভাব বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে এখন তৈরি হয়েছে, তার নজির ১৯৮৯তে তিয়েনানমেন স্কোয়ারের ঘটনার পর দেখা যায়নি। ঐ নথিতে বলা হয়েছে, চীন এবং চীনা কম্যুনিস্ট পার্টিকে ঘায়েল করা, অপদস্থ করা , তাদেরকে বিশ্ব নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির জন্য একটি হুমকি হিসাবে দেখানোর জন্য আমেরিকা উঠেপড়ে লেগেছে।

বাইডেন কি ভিন্ন কৌশল নেবেন?

জো বাইডেন, যিনি জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন, চীনকে মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতিই প্রধানত অনুসরণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি এই লড়াইতে মিত্রদের আরো ঘনিষ্ঠভাবে পাশে রাখতে চাইবেন।

হোয়াইট হাউজে বিবিসির সংবাদদাতা তারা ম্যাকেলভি বলছেন বাণিজ্য এবং অন্যান্য ইস্যুতে চীনের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে দুই দলের মধ্যে বিরল একটি ঐক্যমত্য হয়েছে।

এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে, মি বাইডেন বলেন তার চীন নীতির প্রধান লক্ষ্যই হবে মিত্রদের সাথে জোটবদ্ধভাবে চীনের, তার ভাষায়, “অন্যায় বাণিজ্য নীতির মোকাবেলা।“ তবে, জলবায়ু পরিবর্তন সহ আরো কিছু ইস্যুতে চীনের সাথে সহযোগিতার রাস্তা হয়ত মি. বাইডেন খুঁজবেন।