রামু সংবাদদাতা :
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) দেয়া ১ হাজার দরিদ্র জনসাধারণের ত্রাণের বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে রামুর বিতর্কিত  ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুচ ভূট্টোর বিরুদ্ধে। পাহাড় খেকো হিসেবে খ্যাত এ চেয়ারম্যানকে ইতিপূর্বে পরিবেশ অধিদপ্তর অর্থদন্ড দেয়। এছাড়া ইতিপূর্বে ওই ইউনিয়নে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়েছিলো জেলার ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার একদল সাংবাদিক। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগে এবং পরে তার অনেক কুর্কীতির সাথে এবার যোগ হলো ত্রাণের টাকা আত্মসাতের বিষয়।
জানা গেছে, গত ২৩ নভেম্বর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ত্রাণ সহায়তার আতওায় রামুর দক্ষিণ ইউনিয়নের ১ হাজার পরিবারকে ৩য় দফায় ৪ হাজার টাকা করে বিতরণ করার কথা ছিলো। কিন্তু আগের রাতে ডব্লিউএফপির টাকা প্রদানের টোকেন দেয়ার সময় উপকারভোগীদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে নগদ আদায় করেন ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুচ ভূট্টো ও তার একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এ নিয়ে ভুক্তভোগীদের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক অডিও রেকর্ড এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক, স্থানীয় সংবাদপত্র এবং অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশ হলে সর্বত্র সমালোচনা ঝড় উঠে। এ নিয়ে সাংবাদিকদের তথ্য দেয়ায় অনেক উপকারভোগীকে ডেকে এবং প্রকাশ্যে হুমকী দিতে শুরু করেছে চেয়ারম্যান ভূট্টো ও তার সহযোগীরা। হুমকীতে আতংকিত একাধিক ভুক্তভোগী প্রশাসনের কাছে নিরাপত্তা প্রদানের দাবি জানিয়েছে এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হতদরিদ্র মানুষের আত্মসাৎকৃত ত্রাণের টাকা ফেরত দেয়ারও দাবি জানিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পুরো ইউনিয়নজুড়ে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ত্রাণের টাকা লুটের এ ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে বলে জানান সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা।
দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের ভূক্তভোগীরা জানিয়েছেন-গত সোমবার টাকা বিতরণকালে চেয়ারম্যানের নির্দেশে ত্রাণের টাকা থেকে মাথাপিছু ১ হাজার টাকা করে নিয়ে নেয় চেয়ারম্যান ও তার সহযোগিরা। অধিকাংশ উপকারভোগীর কাছ থেকে টাকা বিতরণের আগের রাতেই ১ হাজার টাকা নিয়ে নেয়া হয়।
অনেকে ৪ হাজার টাকা মধ্যে ১ হাজার টাকা করে চেয়ারম্যান ও তার লোকজন নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। এসব উপকারভোগীদের মধ্যে রয়েছেন-দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের ফকিরামুরা এলাকার নজির আহমদের ছেলে শামসুল আলম, ৭ নং ওয়ার্ডের উজির আলী ছেলে ছৈয়দ করিম, ৫ নং ওয়ার্ডের আবদুস ছোবহানের ছেলে কলিম উল্লাহ, পানেরছড়া এলাকার জহুরা খাতুন, নুরুচ্ছাফা, আমান উল্লাহ, লেদু মিয়া ও জাহাঙ্গীর আলম, কাইম্যারঘোনা এলাকার দিলোয়ারা বেগম, ফাতেমা বেগম, ছায়েরা খাতুন, ৯ নং ওয়ার্ডের মোস্তাফিজের স্ত্রী রেজিয়া, কাইম্যার ঘোনা এলাকার আজিজুল হকের স্ত্রী আনোয়ারা, ৭ নং ওয়ার্ডের ফকিরামুরা এলাকার মৃত ইছহাকের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম।
এসব উপকারভোগী জানান-তাদের মত অসহায় মানুষ আর নেই। কিন্তু সাহায্যের নামে তাদের দেয়া অর্থ চেয়ারম্যান ইউনুচ ভূট্টো ও তার সহযোগিরা ছিনিয়ে নিয়েছে। সহায়তার নামে এমন লুটপাট তারা আর কখনো দেখেননি। তারা আরো জানান-তাদের অধিকাংশ উপকারভোগীর কাছ থেকে টোকেন নেয়ার সময় চেয়ারম্যান ও তার সহযোগিরা ১ হাজার টাকা করে নিয়ে গেছে। আর যাদের টাকা ছিলো না, তাদের সোমবার পরিষদে টাকা দেয়ার পর বাড়ি ফেরার সময় নিয়ে নিয়েছে। পরিষদের ভিতরে টাকা দেয়া হলেও পরিষদের বাইরে সারিসারি ভাবে চেয়ারম্যানের ঠিক করা লোকজন দাঁড়িয়ে ছিলো। তারাই চেয়ারম্যানের নির্দেশের কথা বলে ১ হাজার টাকা করে উপকারভোগীদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়। অনেকে টাকা দিতে না চাইলেও তাদের মারধর-প্রাণনাশের হুমকী দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে উপকারভোগীরা।
এসব ভুক্তভোগীরা আরো জানান, রাতে টাকা বিতরণ শেষে ডব্লিউএফপি-ব্র্যাক এর কর্মকর্তা-কর্মচারিরা চলে যাওয়ার পর তাদের কাছ থেকে নেয়া টাকা পরিষদেই ভাগ-বাটোয়া করেন ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুচ ভূট্টো।
চেয়ারম্যানের সহযোগি হিসেবে কারা ছিলো জানতে চাইলে ভূক্তভোগীদের মুুখে অনেকে নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে রয়েছেন-আমান উল্লাহ সওদাগর, চেয়ারম্যানের শ্যালক নুরুল আজিম, চাচাতো ভাই মুন্না, খালাতো ভাই সুলতান, পরিষদের তথ্য সেবা কেন্দ্রে দায়িত্বরত জাহেদ, আবদুল করিম, ১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হোছন আহমদ, ২ নং ওয়ার্ডের মাস্টার মনু, মাস্টার রহমত উল্লাহ, আহমদ উল্লাহ, আবু ছৈয়দ, ৩ নং ওয়ার্ডের ইব্রাহিম সওদাগর, পাসপোর্ট অফিসের দালাল হিসেবে পরিচিত আমান উল্লাহ। এছাড়া ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হোছন আহমদ ও ৬ নং ওয়ার্ডের চৌকিদার ছলিম চেয়ারম্যানের এসব অপকর্মে অন্যতম সহযোগি হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন বলেও জানায় ভুক্তভোগীরা।
এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা সুপ্রীম কোর্টেরর আইনজীবি সাদ আল আলম চৌধুরী। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘ দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নে দূর্ণীতির মহোৎসব চলছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সহায়তাধিন, উপজেলা প্রশাসন রামু ও জেলা প্রশাসন কক্সবাজার এর সার্বিক সহযোগিতায় ৮ নং দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের উপরকাভোগী পরিবারের মাঝে নগদ প্রতি ৪ হাজার টাকা করে দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু অত্যন্ত দূঃখের ও পরিতাপের বিষয় ৪ হাজার নগদ সহায়তা পাওয়ার জন্য ১ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছে। যা ইউনিয়নের লোক মুখে এখন বহুল আলোচিত। ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও তার দলবলের এ ধরনের ঘৃন্য অপরাধ ও অভিযোগের শেষ নেই। বর্তমান চেয়ারম্যান দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের জনগনের সম্পদ হরিলুট করে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের মেম্বার মোজাহের আহমদ জানিয়েছেন-এসব ত্রাণ বরাদ্ধে মেম্বারদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। চেয়ারম্যান উল্টো মেম্বাদের বলেছেন-এসব বরাদ্ধ সরকারি নয়, এনজিও’র দেয়া। তাই এসব ত্রাণ তিনি নিজের উচ্ছে মতো বিতরণ করবেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ^ খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বরত সহকারি প্রকল্প কর্মকর্তা সোহানুর রহমান আসিফ জানিয়েছেন- দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নে ১ হাজার পরিবারকে ৪ হাজার টাকা করে গত সোমবার (২৩ নভেম্বর) বিতরণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান নিজেই তালিকা তৈরী সহ যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। উপকারভোগীদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে নেয়ার বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত করা হবে। প্রমাণ পেলে টাকা ফেরত দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি আরো বলেন- এখনো করোনার প্রভাব চলছে। এভাবে অনিয়ম হয়ে থাকলে ভবিষ্যতে এ ইউনিয়নে ডব্লিউএফপির ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হতে পারে।
রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রণয় চাকমা জানিয়েছেন-টাকা বিতরণের শুরুতে অনিয়মের কথা শুনেছি। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) কর্মকর্তারাও এ নিয়ে আমার কাছে এসেছিলো। তারা বলেছে, পরবর্তীতে তারা এটা বন্ধ করে দিয়েছে। ইউএনও আরো বলেন-এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত করা হবে। অনিয়মের প্রমাণ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইউনুচ ভূট্টো সাংবাদিকদের জানিয়েছেন-‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন ও হাস্যকর। নির্বাচন আসছে, তাই আমাকে ঠেকানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি-এসব অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নেবো”।
এদিকে রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের সর্বস্তরের জনসাধারণ ত্রাণের বিপুল টাকা লুটের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িত চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি ইউনুচ ভূট্টো সহ দোষী সকল ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।