কবির হোসেন


হঠাৎ একদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নজরে এলো নওগাঁ লিখিয়ে সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, লেখক ও লিখিয়ে প্রকাশনীর কণর্ধার রবিউল ফিরোজের আঁকুতি। তাদের গ্রামে একটি অবহেলিত প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। সেই মসজিদটি ঠিক কবে বা কে নির্মাণ করেছিল, এই তথ্য তার পিতা, পিতামহ বা নিজ গ্রামসহ আশেপাশের এলাকার কেউ বলতে পারেনা। গ্রামের বায়োজ্যেষ্ঠদের মুখের কথার ভিত্তিতে ধারণা করা হয়, মসজিদটি পাঁচশ বছরেরও বেশি পুরাতন।

এই মসজিদকে কেন্দ্র করে লোকশ্রুতি আছে যে, কোন এক রাতের মধ্যেই নাকি মসজিদটিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। শেষে মসজিদটির বর্তমান অবস্থার বেহাল দশা ও আর্থিক সংকটের কারণে পুনঃ নির্মাণ বা সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছেনা জানিয়ে লেখা শেষ করেছেন। আমি মসজিদটির ছবিগুলো বেশ ভালোভাবে খেয়াল করলাম। তিন গুম্বজওয়ালা মসজিদ। মধ্যযুগীয় অন্যসব স্থাপনার মতই। পাশের উচু মিনারের ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল। অপরূপ কারুকার্য করা। মিনারটা আর একটু ভালোভাবে খেয়াল করতেই সন্দেহের উদ্বেগ জন্মালো। উচু মিনারটি মসজিদের নয়। কেননা মিনারটিতে অসংখ্য প্রাণীর প্রতিকৃতি। নিশ্চয়ই এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মঠ।

মঠ বলতে এমন একটি অবকাঠামোকে বুঝানো হয় যেখানে কোন এক বিশেষ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ ধর্মীয় কারণে অবস্থান করেন এবং সেখানে উক্ত ধর্মীয় বিভিন্ন গুরুগণ উপদেশ প্রদান ও শিক্ষাদান করেন। মসজিদ ও মঠ পাশাপাশি। বিষয়টা নিয়ে আমার আরও অধিক আগ্রহ জন্মায়। একটু রিসার্চ করা প্রয়োজন। কারণ দুই ধর্মের আলাদা স্থাপনা এক স্থানে কিভাবে থাকতে পারে। ইতিহাসে অনেক ঘটনা আছে যেখানে দেখা যায়, এক ধর্মের আধিপত্য হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে অন্য ধর্মের স্থাপনা উচ্ছেদ কিংবা নিজেদের ধর্মের প্রচার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এখানে বিষয়টা তার ব্যতিক্রম।

ইসলামগাঁথী গ্রামের এই মসজিদ ও মঠ সম্পর্কে অনলাইনে অনেক সময় ব্যয় করেও কোন তথ্য পেলাম না (সম্পৃতি উইকিপিডিয়া সার্চ করে যে তথ্য পাবেন তা আমার সংযুক্ত করা)। রবিউল ফিরোজের সঙ্গে কথা বলে মসজিদ ও মঠের অবস্থান জেনে নিলাম। নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার বিশা ইউনিয়নে ইসলামগাঁথী গ্রাম। সঠিক তথ্য ও ইতিহাস উৎঘাটন করতে হলে অবশ্যই আগে সেখানে যাওয়া উচিৎ। আমি ইতিহাসবেত্তা কিংবা ইতিহাসের ছাত্রও নই। তবে একটা রিপোর্ট করে যদি বিষয়টা কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে পারি। করোনা মহামারী এবং কর্মব্যস্ততায় অনেকদিন আশাটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখলাম। অবশেষে দশদিনের ছুটি মিলতেই ছোট মামাকে নিয়ে ২৩ শে অক্টোবর ২০২০ তারিখে বেরিয়ে পড়লাম ইসলামগাঁথী গ্রামের উদ্দেশ্যে।

নাটোরের সিংড়া বাসস্ট্যান্ড হতে রিজার্ভ মোটরসাইকেল যোগে আত্রাই রোডে চলতে লাগলাম। একটু পরপরই রোডের একপাশে আত্রাই নদী, অন্যপাশে চলনবিল উঁকি দিচ্ছিল। যদিও চলনবিলের পানি কমতে শুরু করেছে। কারণ আমি বর্ষা শেষে এসেছি। তবু এর রুপ লাবণ্যে হৃদয় জুড়িয়ে যায়। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। কয়েকবছর আগের কথা মনে পড়ে। সেবার এই আত্রাই উপজেলাতেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পতিসর কাচারী বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিনও আজকের মতো ঝিরঝির হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো। এটাকে মন্দ ভাগ্য বলবোনা। বরং রোমাঞ্চকর যাত্রা বলবো। আজকের আত্রাই নদীর মতো সেদিন পাশে ছিলো কবিতার বিখ্যাত সেই ছোট নদী। নাগর নদী।

এখন মূল কথায় আসা যাক্। বিখ্যাতের ভিড়ে অখ্যাত হারিয়ে যায়। অনেক সময় অখ্যাত পরিচয়ে অনেক বড় কোন ইতিহাস-ঐতিহ্য চাপা পড়ে যায়। আমরা আত্রাই উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য কিংবা ঐতিহাসিক/দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে পর্যালোচনা করলে ঘুরেফিরে কবিগুরুর পতিসর কাচারীবাড়ি, ভবানীপুর রাজবাড়ি, সুটিকিগাঁথা রাবার ড্যাম, গান্দীজির আশ্রম অথবা সর্বোচ্চ শাহাগলা ইউনিয়নের কদমতলা ও চলনবিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা জানি।

কিন্তু এই স্থানগুলোর চেয়েও অধিক গুরুত্ব বহন করে ইসলামগাঁথী গ্রামের এই প্রাচীন মসজিদ ও মঠ। জগদাশ বাজার/চকবিষ্টপুর এর পিছনেই ঐতিহাসিক আত্রাই নদী। আত্রাই নদীর অপর পাশেই নদীর তীর ঘেসে এই স্থাপনা। প্রাচীন সকল সভ্যতায় নদী কেন্দ্রীক। তবে দেখা যায়, অনেক সময় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় মূল স্থাপনা থেকে নদীর অবস্থান দূরে সরে যায়। তবে কি এটা বড় কোন সভ্যতার নির্দশন। যার অনেক অংশই বর্তমানে বিলীন হওয়া সত্ত্বেও এই অংশ টিঁকিয়ে আছে নদীর তীরে।

ইসলামগাঁথী গ্রামের প্রাচীন মসজিদ ও মঠ

সুবেদার ইসলাম খানের আমলে (১৬০৮-১৬১৩) ইসলাম খাঁ কর্তৃক আনুমানিক মধ্যযুগে ইসলামগাঁথী গ্রামের এই মসজিদটি স্থাপন করা হয় বলে ধারণা পাওয়া যায়। তবে মসজিদটির গঠন প্রণালী ও ইসলাম খানের শাষণামলের ইতিহাস থেকে বিবেচনা করলে বিষয়টি আরও অধিক গবেষণার দাবি রাখে। আত্রাই উপজেলার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস খুবই ক্ষীণ। ব্রিটিশ সরকার আত্রাই নদীর নামকরণ করে। আর এই জনপদের নাম হয় আত্রাই। তবে আত্রাই নদীর ইতিহাস বহু পুরাতন। এই আত্রাই নদীর কথা মহাভারতেও আছে। এই হিসেবে হিন্দু স্থাপত্য মঠটি ইতিহাসের নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠীর সেকেলের কোন সাম্রাজ্যকে নির্দেশ করে। চলনবিলের ইতিহাস থেকে এই জনপদের সঠিক তথ্য বের করতে হলে আমাদের প্রাচীনকালের উরিষ্যা অঞ্চলের চোল রাজবংশ এবং চোল সমুদ্র বা চোল হ্রদের সঠিক ইতিহাস খুজে বের করতে হবে। যা ভূতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় বিষয়। অপরদিকে মধ্যযুগে অনেক মঠ ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। এই মঠগুলি কৃষকদের সুদের বিনিময়ে ঋণ দিত । কৃষকরা এই ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে মঠ গুলি তাদের জমি বাজেয়াপ্ত করতো । এই ইসলামগাঁথী গ্রামে এখনও অনেক হিন্দু বসতি রয়েছে। তবে সেটি মঠ কিংবা তাদের অন্য কোন ধর্মীয় স্থাপনা কি-না, সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। প্রতীয়মান হয়, মধ্যযুগে ভারতবর্ষে মুসলিম শাষণামলে মসজিদটি নির্মিত। তবে কোন সময় মঠটি নির্মিত তার ধারণা পেতে হলে প্রত্নতাত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।

মসজিদটিতে বর্তমানে মুসল্লিরা নিয়মিত নামাজ পড়ে। নান্দনিক বৈশিষ্ট্যে ভরপুর মসজিদটি যুগের বদলে স্বকীয়তা হারাতে বসেছে। মসজিদটি সংরক্ষণে সরকারি হস্তক্ষেপ কামনা করে এলাকার সকল সুধীজন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বিশেষ করে আশেপাশের অঞ্চলের অনেকেই দেখতে আসেন ইসলামগাঁথী গ্রামের এই ঐতিহাসিক মসজিদ ও মঠ। বিস্তর প্রচার ও সরকারের হস্তক্ষেপে স্থানটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এখানে ঘুরতে এসে একইদিনে ভবানীপুর রাজবাড়ী, পতিসর কবিগুরুর কাচারী বাড়ী ও বর্ষায় এলে চলনবিলের অপরুপ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। তাই হাতে একদিন অবসর সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন আত্রাই উপজেলার ঐতিহাসিক এই স্থাপনা দেখতে।

আসার পথ: নওগাঁ জেলা সদর থেকে সিএনজিতে আত্রাই থানা সদর, সাহেবগন্জ থেকে অটো রিকসায় চেপে চকবিষ্টপুর যেতে হবে। তারপর নদী পার হলেই পৌঁছে যাবেন ইসলামগাঁথী গ্রামে। অথবা নাটোর থেকে বাসে সিংড়া হয়েও এখানে আসা যাবে খুব সহজে। ঢাকা বা দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে ট্রেন যোগেও আত্রাই স্টেশনে আসা যায় খুব সহজে। বিমান পথে আসতে চাইলে প্রথমে আপনাকে আসতে হবে রাজশাহী শাহ মখদুম বিমানবন্দরে। তারপর বগুড়াগামী বাস যোগে সিংড়া। তারপর গন্তব্যস্থল।

ইসলামগাঁথী মসজিদ ও মঠ সংলগ্ন লিখিয়ে সাহিত্য পরিষদ, নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক ও লেখক রবিউল ফিরোজের ইটের দো’তলা বাড়ী। বাড়ীটির অনন্য বৈশিষ্ট হলো এর মাঠির ছাদ। এই ভ্রমণটি আপনার জন্য হতে পারে কাব্যিক ভ্রমণ।

অতি প্রাচীন এই মসজিদটি সম্পর্কে তিনি বলেন, কালের বিবর্তনে ভগ্নপ্রায় মসজিদটি সংস্কার করা বিশেষ প্রয়োজন। সরকারের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি যেন তার প্রাচীন ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রেখে সংস্কারসহ পরিসর বৃদ্ধি করা হয়। তিনি আরও জানান, কেউ বা কোন সংস্থা এই স্থাপনা নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে তিনি তাকে সার্বিক সহযোগীতা করবেন।

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এরকম অনেক ঐতিহাসিক স্থান সবার অগোচরে অজানা রয়ে গেছে। আমাদের উচিত স্থানগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ঐতিহ্য তুলে ধরা।