মো. নুরুল করিম আরমান, লামা:
তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও অর্থকরী হওয়ায় যুগ যুগ ধরে বান্দরবানের লামা উপজেলায় এ চাষ করে আসছে অধিকাংশ কৃষক। বিকল্প চাষাবাদের কথা কখনো ভাবেননি তারা। তবে সময়ের পবিবর্তনে অনেকে বিষয়টি বুঝেছেন এবং তারা তামাকের বিকল্প চাষ খুঁজতে শুরু করেন কৃষকরা। ঠিক সেই মুহুর্তে বান্দরবান তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা উপজেলার বেশ কয়েকজন কৃষককে উদ্বুদ্ধ করেন সম্ভাবনাময় অর্থকরি তুলা চাষে। এতে চলতি মৌসুমে এ চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেন, উপজেলার লামা সদর ইউনিয়নের শীলেরতুয়া গ্রামের কৃষক আবদুল হামিদ। তার দেখাদেখি পাশের রুপসীপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব শীলেরতুয়া গ্রামের কৃষক সোহেল ইকবাল, হাছিনা আক্তার, ফতু মার্মা, আবদুল হালিম ও নাছির, গজালিয়া ইউনিয়নের আদিগা ত্রিপুরা আবদুল হালিম, দিনারাম ত্রিপুরা, প্রিতমা ত্রিপুরা ও সজরাম ত্রিপুরা ১৫ জন কৃষক। এদের প্রতিজনকে ১ বিঘা হারে ১৫টি প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে গত জুন-জুলাই মাসে পরীক্ষামূলক চাষে সার্বিক সহযোগিতা করে বান্দরবান তুলা উন্নয়ন বোর্ড। এসব প্লটে ফলন ভালো হওয়ায় পাহাড়ের ঢালে ও সমতল ভূমিতে তুলা চাষে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন চাষীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে দুই প্রজাতির তুলা চাষ হয়ে থাকে, পাহাড়ি তুলা এবং সমভূমির তুলা। পাহাড়ি তুলা পার্বত্যাঞ্চলে জুম চাষে অন্য ফসলের সাথি ফসল হিসেবে চাষ হয়ে থাকে। জুম চাষিদের মূল অর্থকরী ফসল পাহাড়ি তুলা। সমভূমির তুলা পাহাড়ের ঢালে ও সমতল ভুমিতে চাষ হয়ে থাকে। পাহাড়ি তুলার আঁশের দৈর্ঘ্য ০.৫ ইঞ্চি। আঁশ খাটো বলে এই তুলা স্পিনিং মিলে সুতা তৈরীর উপযোগি নয়। জুম চাষিরা উৎপাদিত তুলার একটি অংশ নিজেদের জন্য কম্বল, মোটা কাপড় তৈরির কাজে ব্যবহার করেন। এছাড়া এই তুলার একটি অংশ লেপের তুলা হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং কিছু অংশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সমভূমির তুলার আঁেশর দৈর্ঘ্য গড়ে ১.১৫ ইঞ্চি। এই তুলা স্পিনিং মিলে সুতা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তুলার বীজ থেকে পশু খাদ্য খৈল, ফ্যাক্ট মুক্ত তৈল ও ফাজ (ব্যন্ডেজ বা গজ) তৈরি করা হয়। গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

পার্বত্যাঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটি তুলা চাষের উপযোগি। ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চল ‘কার্পাস মহল’ হিসাবে পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলের পাহাড়ের পাশাপাশি নদী ও প্রচুর ঝিরি রয়েছে। নদী ও ঝিরির পাড়ের অনুর্বর, বেলে দোঁ- আশ মাটিতে সমভূমির তুলা ভাল হয়। এছাড়া সমভূমির তুলা পাতাঝড়া উদ্ভিদ বিধায় গাছের মোট আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ জৈব পদার্থ হিসেবে যোগ হয়। ফলে সমভূমির তুলা চাষকৃত জমি উর্বরতা লাভ করে। বছরের জুন মাসের শেষের দিকে ও জুলাই মাসের প্রথম দিকে জমিতে তুলার বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়। পাঁচ মাস পর অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তুলা উত্তোলন করা হয়।

বস্ত্র বাংলাদেশের প্রধান শিল্প পণ্য। অর্থনৈতিক মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে বস্ত্র শিল্পের অবদান শিল্প খাতের প্রায় ৪০% এবং জাতীয় আয়ের প্রায় ১৩%। দেশে ৩৬৩টি সুতাকলের জন্য বার্ষিক ৪০ লক্ষ বেল আঁশ তুলার চাহিদা আছে। এ পরিমান তুলা আমদানি করতে বছরে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ বিপুল পরিমান আঁশ তুলার চাহিদা পূরনের জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড দেশের সমতল অঞ্চলের পাশাপাশি পার্বত্যাঞ্চলেও সমভূমির তুলা চাষ সম্প্রসারনের উদ্যোগ গ্রহন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বান্দরবান তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সম্প্রসারিত তুলা চাষ প্রকল্প (ফেজ-১) এর আওতায় পরীক্ষামূলক প্রদর্শণীর মাধ্যমে ১৫হেক্টর পাহাড়ি ও সমতল ভুমিতে রুপালী-১, সিবি-১২, ১৩ ও ১৪ জাতের তুলা চাষ করা হয়। এর আগে চাষিদেরকে তুলা চাষের উপর প্রশিক্ষণও প্রদানসহ বিনামেূল্য বীজ, সার, কীটনাশক ও উপকরণ প্রদান করে। গত ১৯ নভেম্বর বান্দরবানের প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন মৃধা, থানচি ইউনিট অফিসার উক্যচিং চাক ও লামা ইউনিট অফিসার আবদুল খালেক ও সাংবাদিক মো. নুরুল করিম আরমান লামা সদর ইউনিয়নের শীলেরতুয়া ও রুপসীপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব শীলেরতুয়া এলাকার তুলা প্রদর্শনী প্লট পরিদর্শন করেন। এ সময় তুলা চাষীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রদর্শনী প্লট পরিদর্শন শেষে তুলা উন্নয়ন বোর্ড বান্দরবানের প্রধান উন্নয়ন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন মৃধা বলেন, চলতি মৌসুমে লামা ইউনিটের অধীনে ১৫ হেক্টর জমিতে দেশী ও হাইব্রিড জাতের সমভূমি তুলা চাষের আবাদ করা হয়েছে। এ চাষের গুণগত মান ভাল। কোন প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে ভাল ফলন হবে বলে আমরা আশাবাদী। তিনি আরও বলেন, চাষিরা তামাক চাষে অভ্যস্থ ছিল। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ধরণ পাল্টিয়েছে। এখন তামাকের পরিবর্তে কৃষকদেরকে তুলা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, বেশ সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে।

তুলা চাষী আবদুল হামিদ জানান, তামাক চাষের পাশাপাশি তুলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্বুদ্ধ করনে তিনি চলতি মৌসুমে ১ বিঘা জমিতে তুলা চাষ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। তবে শেষের বৃষ্টির কারণে তুলার ফল ঝরে গেছে। এর পরেও প্রায় ১৪মন তুলা পাওয়া যাবে। যার মূল্য ৩২ হাজার ২০০টাকা। সরকারী সহায়তা পেলে তুলা চাষের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পার্বত্য লামা উপজেলার পতিত জমিতে ব্যাপক তুলা চাষের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি। গজালিয়া ইউনিয়নের তুলা চাষী প্রিতমা ত্রিপুরা বলেন, এক বিঘা জমিতে তুলা চাষ করতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। বিঘাপ্রতি ১২ থেকে ১৪ মণ তুলা উৎপাদন করা যায়। প্রতি মন তুলার বাজার মূল্য ২৩ হাজার টাকা। তিনি আরও বলেন, তুলা উন্নয়ন বোর্ড এ চাষে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, বিনামেূল্য বীজ, সার, কীটনাশক ও উপকরণ প্রদান করায় অন্য কৃষকরাও ক্ষতিকর তামাক চাষ ছেড়ে তুলা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এখন প্রয়োজন আরো বেশি সরকারী সহযোগিতা।