অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন


বর্তমান মায়ানমার সরকার এবং পশ্চিমা কিছু সাংবাদিক এবং লেখক রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব নিয়ে নানা বিদ্বেষমুলক লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা অন্যান্য মাধ্যমে ছাপানো হচ্ছে। তারা রোহিঙ্গাদের একটি প্রচ্ছন্ন ইতিহাসকে উপেক্ষা করে নানা মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে গনতান্ত্রিক নেত্রি অংসাং সূচির বিবিসির সাক্ষাতকার এবং রোহিঙ্গা নিয়ে নীরবতা এই মিথ্যাচারকে আরো প্রকট করে তুলছে। রোহিঙ্গারা জন্মসূত্রে মিয়ানমারের নাগরিক হলেও মিয়ানমার সরকার বরাবরই এটাকে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। ইতিপুর্বে সাবেক পুর্ব পাকিস্তান সরকার ও বাংলাদেশের সাথে শরনার্থী সমস্যা সমাধানে বার্মা সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিলেও একথাকে অস্বীকৃতি দিয়ে বিজ্ঞপ্তিপ্রকাশ করে যে, “ ঐতিহাসিক ভাবে কখনেই কোন রোহিঙগা জাতি ছিলনা। “রোহিঙ্গা ” নামটি আরাকান রাজ্যেও একদল বিদ্রোহীদের দেওয়া এবং ১৭৮৪ সালের প্রথম এ্যাংলো বার্মা যুদ্ধের পর প্রতিবেশী দেশের মুসলিমরা বেআইনী ভাবে বার্মা; বিশেষ করে আরাকান রাজ্যে প্রবেশ করে”। শুধু তাই নয় বার্লীন থেকে প্রকাশিত The origin of the name Rohingya’’ ‡Z u khinMaung Saw e‡jb I have consulted with scholars and historians including Muslims but nobody knows the meaning nor the origin of the word “Rohingya”. The only thing they could tell me was that there were a lot of rebels in Burma in 1949. one of the rebel groups was a fanatic Muslim group lead by Mir Qassim. They named themselves “Mujahids”. Most of the “soldiers” in this “Mujahid Army” and their families were former illegal immigrants living in the Arakan Division of the Union of Burma who wanted to turn northern Arakan into a separate Muslim State of “Arakanistan” and planned to join East Pakistan. শুধু তাই নয় বাংলাদেশের কিছু লেখক মায়ানমারের ইতিহাস,ভ্রমন কাহিনী ইত্যাদী লেখাতে রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ একেবারে এড়িয়ে গেছেন। এটি তাদের একদেশদর্শিতার বহি:প্রকাশ ।তারা জেনে শুনেই একাজটি করেছেন।তারা আরাকানে বর্মী সরকারের নিপিড়ন বলতে শুধু রাখাইনদের উপর নির্যাতন একথাই বোঝাতে চেয়েছেন। ওখানে রোহিঙ্গা বলে যে একটি ঐতিহাসিক জাতি রয়েছে তা তারা সম্পুর্ন অস্বীকার করে।

এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এই সব প্রোপাগান্ডা , মিথ্যাচার , ভ্রান্ত ধারনা ভুল ভাঙ্গানোর পরিপ্রেক্ষিতে ঐ সব পথভুলা জ্ঞানপাপীদের রোহিঙ্গাদের আসল ইতিহাস এর কিছু অংশ জানালে হয়তো তাদের ভুল ভাঙ্গতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। এই জন্য আমি তৎকালীন রোসাঙ্গের বিরাট ইতিহাসের শুধু একটি দিক কবি দৌলত কাজীকে নিয়ে একটি লেখা সম্মানীত পাঠককুল উদ্দেশ্যে প্রকাশ করলাম।

বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয় শুধু বাংলার ইতিহাসে নয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।বৌদ্ধযুগে বাংলা সাহিত্যের যে উন্মেষ ঘটেছিল, সে সাহিত্যধারা হিন্দুসেন রাজাদের আমলে শেষ হয়ে যায়। মুসলমান আমলে রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় সে সাহিত্য ধারারা শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বাংলাসাহিত্যকে তাঁরা দেবদেবীর বেদীমুল থেকে সাধারন মানুষের গৃহাঙ্গনে নিয়ে এলেন। শুধু তাই নয় আরবী, ফারসী,হিন্দী প্রভৃতি বিদেশী সাহিত্য থেকে বিভিন্ন অমুল্য রত্ন সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। ১৬৬৬ সনের মুঘল বিজয়ের পুর্ব অবধি চট্টগ্রাম ছল সাধারণ ভাবে আরাকান রাজ সভা ভুক্ত।সে সুত্রে চট্টগ্রামবাসীরা নানা গঞ্জে বাস করত রাজধানী ম্রোহং এ বা রোসাঙ্গে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোন কোন মুসলমান রাজ সচিবও থাকতেন।সচিবদের মধ্যে আশরাফ খান, সৈয়দ মূসা এবং মাগন ঠাকুর যে চাঁটগার লোক ছিলেন তা একপ্রকার নিশ্চিত। আলাউর ব্যতিত কাজী দৌলত, মরদন, শমশের আলী প্রমুখ রোসাঙ্গ শহরের কবিদের বাড়ীও ছিল চট্টগ্রামে। আরাকানে মুসলমান কবি ও কাব্য গ্রন্থের নাম:-

ক্র:নং কবির নাম কাব্য /পুথি

১ কবি দৈালত কাজী সতমিয়না লোর চন্দ্রনী(অসমাপ্ত)

২. কবি কোরেশী মাগনঠাকুর

চন্দ্রাবতী কাব্য

৩. মহাকবি আলাওল পদ্মাবতী কাব্য, সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামান,

হপ্ত পয়কার,সেকান্দর নামা , তোহফা বা তত্তোপদেশ, দৌলতকাজীর অসমাপ্ত

”সতীময়না লোর চন্দ্রানী ও রাগতালনামা প্রভৃতি।

৪. কবি মরদন নসিব নামা

৫. কবি আবদুল করিম দুল্লা মজলিশ,তমিম আনসারীও হাজার খোন্দকার মাসায়েল।

৬. কবি আবদুল করিম রোসাঙ্গ পাঞ্চালী

৭ কবি আবুল হোসেন আদমের লড়াই

৮. কাজী আবদুল করিম রাহাতুল কুলুব, আবদুল্লাহর হাজার সাওয়াল, নুরনামা, মধমালতি , দরীগে মজলিশ।

৯. ইসমাঈল সাকেব বিলকিসনামা।

১০. কাজী মোহাম্মদ হোসেন আমীর হামজা , দেওলাল মতি, হায়দর জঙ্গ।

১১. ইসরুল্লাহ খান জঙ্গনামা, মুসার সোয়ার, শরীয়তনামা,হিদায়িতুল ইসলাম।

মধ্যযুগের এই রোমান্টিক কাব্য ধারায় দৌলত কাজী এক অবিস্মরনীয় নাম ।সপ্তদশ শতাদ্বীতে বাঙলার প্রত্যান্ত প্রদেশ আরাকানে বাংলা সাহিত্যের অনেক শ্রীবৃদ্দি হয়েছিল। দৌলত কাজী আরাকান বা রোসাঙ্গ রাজ সভার প্রথম বাঙালী কবি। পরবর্তী বাঙালী কবিদের মধ্যে আলাওল, মরদন, মাগন ঠাকুল উল্লেখযোগ্যকবি । দুর্ভাগ্যের বিষয় কবি দৌলত কাজী সম্পর্কে কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।তাঁর কাব্যে রোসাঙ্গের রাজা ও অমাত্যের কথা থাকলেও , নিজের পরিচয় তেমন পাওয়া যায়না।অনেকের মতে কবি চট্টগ্রামের রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামে জন্মগ্রহন্ করেন। অল্পবয়স থেকে তিনি নানা শাস্ত্রে সুপন্ডিত ছিলেন। কিন্তু কিংবনন্তীতে আছে দেশের কোন পন্ডিত অর্বাচিনতার অজুহাতে তার এই পান্ডিত্যকে স্বীকৃতি ন্ধাসঢ়; দেওয়ায় কবি বীতশ্রদ্ধ হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং আরাকানের রাজসভায় স্বীকৃতি লাভের আশায় গমন করেন। দৌলত কাজী রোসাঙ্গের রাজা ‘থিরি – থু – ধম্মার’ লস্কর উজীর আশরফ খানের অনুরোধে “সতী ময়না ও লোর – লোর চন্দ্রানী” কাব্য রচনা করেন। শ্রী সুধর্মার রাজত্বকাল ১৬২২ থেকে ১৬৩৮ খ্রী: পর্যন্ত।দৌলত কাজীর রচনা কালও ১৬২২ থেকে ১৬৩৮ খ্রী: পর্যন্ত। “সতী ময়না ও লোর – লোর চন্দ্রানী” এই কাব্যটি দৌলতকাজীর জীবদ্দশায় শেষ করতে পারেন নাই। পরবর্তীতে বহু বৎসর পর শ্রীচন্দ্র সু ধম্মার আমলে রোসাঙ্গের কবি আলাউল কতৃক বাকী অংশ রচিত হয়। “সতী ময়না ও – লোর চন্দ্রানী” কাহিনীর মুল উৎস ছিল হিন্দু হিন্দি লৌকিক কাহিনী। দৌলত কাজীর “বারমাসী’র এগার মাস (আষাঢ় থেকে বৈশাখ) পর্যন্ত দৌলত কাজীর রচনা বাকী দ্বাদশ মাসের বর্ননা কবি আলাউল সমাপ্ত করেন। ময়নার বারমাসী খন্ডের বর্ননাটি দৌলত কাজী সাধনের “মৈনাসত” কাব্যগ্রন্থ অনুসরনে রচনা করেন। প্রথম খন্ডে বর্নিত লোর ও চন্দ্রানীর প্রণয় কাহিনীটি কবি দাউদের “চান্দাইন” কাব্য অবলম্বনে রচিত।কবি দাউদ ও কবি সাধনের কাব্য ছাড়া দৌলতকাজী আরো অনেকের কাব্য থেকে প্রচুর উপকরন সংগ্রহকরেন।দৌলতকাজী আরবী, ফারসী, হিন্দী, সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন দৌলত কাজী একজন শক্তিশালী কবি ছিলেন।তাঁর “বারমাসী” রচনায় দৌলত কাজী ব্রজবুলি ব্যাবহারে পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী এ বারমাসীতে শুধু বিরহ বর্ণনাই প্রকাশিত হয়নি। এ গাঁথা কবিতায় একদিকে ছাতনের সহস্র প্রলোভন অন্যদিকে স্বামী বিরহ — এ দুয়ের দ্বন্ধে নায়িকা বিপর্যস্ত। অবশেষে অগ্নি পরীক্ষায় ময়নাবতীর ন্যায়নিষ্ঠা ও শুচিতাই জয়ী হল।তাছাড়া বারমাসী অংশে কবির বর্ণনা যেমন কবিত্বময় তেমন হৃদয়স্পর্শী দৌলতকাজী শুধু বাঙালী মুসলমান কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ট নন, প্রাচীন বাংলার শক্তিমান কবিদের মধ্যেও তিনি একজন শ্রেষ্ট ব্যক্তি