সিবিএন ডেস্ক:
কর্ণফুলী নদীর কোস্টগার্ডের জেটি থেকে সাগরপথে প্রায় ৭০ কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখা মিলবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের। এ দৃশ্য দেখতে সময় লাগবে ৫ বছর। দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির গতিশীলতা অব্যাহত রাখতে এ গভীর সমুদ্রবন্দর বিকল্পহীন। এ স্বপ্ন সফল হওয়ার ভাবনায় উচ্ছ্বসিত ব্যবসায়ী মহল। তাই মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে ও বাজেটে শেষ করার মন্তব্য প্রকাশ করছে বন্দরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে এ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তাই চট্টগ্রাম বন্দরের তত্ত্বাবধানে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করবে জাপানি তিনটি সংস্থা ও বাংলাদেশি ১টি সংস্থা। জাপানি সংস্থা তিনটি হলো- নিপ্পন কোয়েই জেভি, ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টস গ্লোভ কো. লিমিটেড (ওসিজি), ডেভেলপম্যান্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস লিমিটেড (ডিডিসি) এবং বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান বিসিএল এসোসিয়েটস লিমিটেড।

২৬ কিলোমিটার রাস্তাসহ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প শেষ হবে দুইটি পর্বে। প্রকল্প শেষে ১ হাজার ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের বাণিজ্যিক এ পোর্ট নির্মিত হবে, যার গভীরতা হবে ১৮ মিটার। এছাড়া বন্দরের কাজে ব্যবহৃত হবে ১৩১ একর জায়গা, যেখানে থাকবে চারটি কনটেইনার জেটি ও চারটি বাল্ক জেটি বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনায় মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজনীয়তা এবং নির্ধারিত সময়ে ও বাজেটে এ প্রকল্প শেষ করার কথা জানান চিটাগং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মাহফুজ-উল হক শাহ।

এ প্রসঙ্গে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘বর্তমানে যেভাবে আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হচ্ছে তাতে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ছে। আগামী ৫ থেকে ৭ বছরে দেশে অনেক বাইরের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আসবে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। তাই এ মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরের কাজ নির্ধারিত সময়ে এবং নির্ধারিত বাজেটে শেষ করতে পারলে ভালো হবে।

তবে মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়নের পূর্বে বন্দরকেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথাও তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপশি মাতারবাড়ি বন্দরের সাথে সব রকমের যোগাযোগ সুবিধা তৈরি করেতে হবে। বিশেষ করে লিংক রোড, রেলপথ, অবকাঠামো, ব্যাকআপ ইয়ার্ড, ডেলিভারি ইয়ার্ড, অফডক, কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য কি-গ্যান্ট্রি ক্রেন ইত্যাদি। অন্যথায় বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শেষ হলেও কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হবে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিশীলতা ব্যাহত হবে।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম সিভয়েসকে বলেন, ‍‘বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করা যায়না। তাই পিসিটি, বে-টার্মিনাল ও মাতারবাড়ি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। মাতারবাড়ি বন্দর প্রকল্পে কাজ দুইটি পর্যায়ে হবে। তারমধ্যে প্রথম পর্যায়ে নকশা ও পরিকল্পনার কাজ চলছে। এ বন্দরে ৮ হাজার ২০০ টিইইউ’স নিয়ে কনটেইনার নিয়ে জাহাজ আসতে পারবে। পাশাপাশি কার্গো ও কনটেইনার দুই ধরনের জাহাজই আসবে। এমনকি মাতারবাড়িতে ১৮ মিটারের জাহাজও আসবে। তাই মাতারবাড়িকে ডিপ ও গ্রিন পোর্ট বলা যায়।’

এ বন্দরের পরিকল্পনা ও নকশা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বন্দর অনেক রকমের হয়। তারমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ছিলো একটি গ্রে পোর্ট। আমরা এটিকে কনটেইনার পোর্টে রূপান্তর করেছি। মাতারবাড়ি বন্দর এমন হবে না। এটি নতুন জায়গায় নির্মিত হচ্ছে। পরিকল্পনা করেই কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য তৈরি করছি। মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়ি ৭০ কিলোমিটার ৮-১০ ঘণ্টায় পরিবহন করা সম্ভব। এ পোর্টে ফিডার ভ্যাসেল থাকবে। ভবিষ্যতে চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন জেটি, টার্মিনাল তৈরি হবে।’

এ বন্দর নির্মাণে খরচের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাতারবাড়ি বন্দরের ফিজিবিলিটি ও ফ্রি ফিজিবিলিটি স্টাডি জাপানের অর্থায়নে হয়েছে। আমাদের সরকারকে কোনো পয়সা ব্যয় করতে হয়নি। শুধু কনসালটেন্সির জন্য আমাদের ব্যয় করতে হচ্ছে। এর জন্য জাইকা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে। দশমিক ০১ শতাংশ সুদে, ২০ বছর পর এটি শোধ করতে হবে। খুবই সহজ শর্তে ঋণ। কনসালটেন্সিতে মোট ২৩৪ কোটি টাকা খরচ হবে। এখন থেকে শুরু করে ২০২৬ সাল পর্যন্ত এর ব্যপ্তি। এখানে ডিজাইন, সুপারভিশন, মনিটরিং, টেন্ডারে সহায়তা এবং পরবর্তী ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও অন্তর্ভুক্ত।’

মাতারবাড়ি বন্দরের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে জাপানি বিশেষজ্ঞের টিম লিডার মি. ওতানি বলেন, ‘আমরা এ প্রকল্পের নকশার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ও দায়বদ্ধ।‌ আমরা (এমপিসিটি) মূলত স্থাপনা প্রকৌশলে কাজ করি। এ প্রকল্পে আমরা অনেক কিছুই বিবেচনা করবো। কারণ বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। তাই এ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা পুরো প্রকল্পটি পর্যবেক্ষণ করবো।’

অন্যদিকে এ মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর নিয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা জানান। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি, প্রকল্প গ্রহণ আর বাস্তবায়ন এক কথা নয়। দীর্ঘদিন ধরে আমরা আশার বাণী শুনে আসছি। যদি মাতারবাড়ী বন্দর চালু হয় এবং মাদারভ্যাসেল ভিড়ে তাহলে এটি হবে ‘মেরিটাইম হাব’। তবে পরিবহনে খরচ বেড়ে যাবে। তাই এ বিষয়টি পরিকল্পনায় রেখে কাজ করলে ব্যবসায়ীরা আরো অনুপ্রাণিত হবে।’

মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কথা বললে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম বলেন, ‘এ প্রকল্পের নকশা ও পরিকল্পনায় কাজ করেছে ৩০ জন জাপানি বিশেষজ্ঞ, ১৮ জন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ ও ২১ জন সহকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এ প্রকল্প দুইটি ধাপে শেষ হবে। প্রথম পর্যায়ে নকশা ও পরিকল্পনা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে কন্টেইনার ও মাল্টি ট্রান্সপোর্টে শেষ হবে। পুরো কাজ আশা করি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি শেষ হবে। তবে আমরা হাতে সময় রেখে ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ করার কথা বলেছি।’

এ বন্দর ব্যবসায়ীদের কতটুকু আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে কেউ কেউ আগ্রহ প্রকাশ না করলেও সময়ের সাথে সাথে সবাই এ আগ্রহ প্রকাশ করবে। এ সমুদ্রবন্দর হলে শুধু আমরা না, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও উপকৃত হবে। এতে করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অব্যহত রাখতে এ বন্দরের কোনো বিকল্প নেই।’ -সিভয়েস।