কালেরকন্ঠ : বাইরের বিশ্বে করোনাভাইরাসের একের পর এক টিকার সাফল্যের খবরে আগ্রহ-উত্তেজনা বাড়ছে বাংলাদেশেও। দেশে কবে টিকা আসবে, কবে নাগাদ দেশের মানুষের শরীরে প্রয়োগ করার সুযোগ ঘটবে—এমন প্রশ্ন এখন জনে জনে, মুখে মুখে। এমন আলোচনা সরকারের শীর্ষপর্যায়েও আছে। তবে বাস্তবে এখনো আশা-নিরাশার দোলায় দুলছে দেশে টিকার ভাগ্য।

বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলছেন, যেহেতু দেশে টিকা উদ্ভাবনের একটিমাত্র উদ্যোগ ছাড়া আর কোনো কিছুই নেই, তাই অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে—যতক্ষণ না বড় দেশগুলোর চাহিদা পূরণ শেষ হবে কিংবা দেশে টিকার জোগান আসবে।

যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের একটি সভায় বলেছেন, ‘যখনই টিকার অনুমোদন মিলবে, তখনই আমরা পাব।’ তিনি আরো যুক্ত করেছেন, ‘ইতিমধ্যেই আমরা এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে টিকার বুকিং দিয়ে রেখেছি।’

পাশাপাশি সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা অনুসারে এরই মধ্যে দেশে অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা তৈরি ও টিকা পাওয়ার পর তা আমদানি, সংরক্ষণ ও প্রয়োগের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই এসব নিয়ে কাজ চলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে অধিদপ্তর পর্যন্ত। এমনকি মাঠপর্যায়েও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুত করা হচ্ছে টিকা প্রয়োগের জন্য। তবে এই প্রস্তুতি নিতে গিয়ে জনবল সংকটের আশঙ্কায় পড়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিশেষ করে প্রথম দিকে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আদলে কর্মসূচি ঘোষণা করে টিকা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছিল, সেখানে জনবল সংকটের কারণে এখন তা একযোগে না করে ভাগে ভাগে করার পরিকল্পনা চলছে বলে জানা গেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র থেকে।

অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যদি আগামী মাসে টিকা যায়, তবে তখনই বাংলাদেশেও টিকা ঢুকবে বলে ধারণা দিয়েছেন কেউ কেউ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির পরিচালক ডা. সামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ অনুসারে অগ্রাধিকারভিত্তিক যারা টিকা পাবে, তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এমনকি একটা পর্যায়ের কাজে অগ্রগতিও বেশ ভালোই হয়েছে। এখন সেটা উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসারে প্রথমেই পাবেন ফ্রন্টলাইনার চিকিৎসাকর্মীরা। এর বাইরে পর্যায়ক্রমে থাকবেন অন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্তরা।

অন্যদিকে বেসরকারি একাধিক সূত্র অনুসারে, সরকারের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে কোনো কোনো টিকা স্বল্পসংখ্যক হলেও সরকারের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে আগাম দেশে আনার চেষ্টা করছে একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সূত্র মতে, তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ করা টিকাগুলোর মধ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হঠাৎ করেই যেকোনো সময় কোনো না কোনো টিকার অনুমোদন দিয়ে ফেলতে পারে। ফলে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের হুলুস্থুল পড়ে যাবে—কার আগে কে টিকা লুফে নিতে পারে সে জন্য। আর সেদিকে নজর রেখে সব দেশেই সরকারি উদ্যোগের বাইরে বাণিজ্যিক পর্যায়ে ভেতরে ভেতরে তৎপরতা চলছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ওষুধশিল্প পরিচিত থাকায় এবং অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে বলেও মনে করছে বেসরকারি সূত্রগুলো।

গতকাল বিকেল থেকে টিকা বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্যাভি অ্যালায়েন্স ও কোভেক্স নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি ভার্চুয়াল বৈঠক শুরু হয়েছে। ওই বৈঠক সূত্র জানায়, এই সভা থেকে দেশের জন্য টিকা বিষয়ে নতুন কোনো অগ্রগতির খবর আসতে পারে। আগেই সরকার কোভেক্সভুক্ত হয়েছে এবং নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকাও দিয়েছে, যেখান থেকে প্রাথমিকভাবে ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা পাবে বাংলাদেশ। পরে আরো ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষের টিকা আসার সম্ভাবনাও রয়েছে বলে জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু এই মাধ্যমে বাংলাদেশে কবে নাগাদ টিকা আসতে পারে, তা এখনো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।

একাধিক বিশেষজ্ঞ কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনার অভাবে যদি বাংলাদেশ ফাইজার কিংবা মডার্নার টিকা থেকে বঞ্চিত থাকে, সেটার ব্যর্থতা হবে বাংলাদেশেরই। কারণ সরকার চাইলে ছোট পরিসরে হলেও প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত অবকাঠামো এখনো তৈরি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মডার্না বা ফাইজারের প্রযুক্তিগত সহায়তাও নিতে পারে বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে। অন্যান্য দেশও তেমনভাবেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কারণ যে টিকার কার্যকারিতা যত ভালো হবে, সেই টিকার প্রতিই মানুষের আগ্রহ বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সরকার এখন পর্যন্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে, সেটা যথেষ্ট নয়।

যে ছয়টি টিকা সীমিত পরিসরে বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে সরকারের তৎপরতা বাড়ানো দরকার বলেও কেউ কেউ বলেছেন। নয়তো পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। আগাম বা সীমিত পরিসরে প্রয়োগ উপযোগী বলে অনুমোদন পাওয়া ছয় টিকার মধ্যে রয়েছে চীনের ক্যানসিনো বায়োলজির একটি, চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মার দুটি এবং সিনোভ্যাক কম্পানির একটি, রাশিয়ার গামেলিয়া ইনস্টিটিউটের একটি, রাশিয়ার আরেক প্রতিষ্ঠান ভেক্টর ইনস্টিটিউটের একটি। অর্থাৎ এই ছয় টিকার মধ্যে রাশিয়ার দুটি ও চীনের চারটি, যা রাশিয়া, চীন, আরব আমিরাতসহ আরো একাধিক দেশে প্রয়োগ হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একজন জ্যেষ্ঠ টিকা বিজ্ঞানী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাফল্য যা হচ্ছে, তা সবটাই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ফলাফলে সীমাবদ্ধ। এখনো কোনো টিকাই যেহেতু এফডিএ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করেনি, তাই যেকোনো দেশের সরকার চাইলে যখন-তখন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতেই পারে। যেমন কয়েকটি দেশ নিজেরাই সীমিত পরিসরে নিজের সরকারের অনুমোদন বা সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কিছু টিকা দিয়েছে এবং কারো কারো প্রক্রিয়া চলছে। সেদিক থেকে আমাদের সরকার যদি চিন্তা করে এবং কোনো দেশ থেকে এফডিএ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের আগেই টিকা নিয়ে আসতে পারে, সেটা এখানে সীমিত আকারে দিতে কোনো বাধা থাকবে না।’

ওই বিজ্ঞানী বলেন, এখন যে ছয়টি টিকা জরুরি প্রয়োজনে বা সীমিত পরিসরে ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষ নীতিমালা অনুসারে, সেটা চাইলে বাংলাদেশ অনুসরণ করতে পারে। তবে সংশ্লিষ্ট টিকা উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরকার ওই টিকা আনতে সক্ষম হবে কি না, তার ওপরও বিষয়টি নির্ভর করছে।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়েই বলা হচ্ছে, এফডিএ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন ছাড়া কোনো টিকা আনা যাবে না।

এদিকে দেশে প্রক্রিয়াধীন থাকা সানোফি পাস্তুরের টিকার ট্রায়াল নিয়ে এ সপ্তাহে চুক্তির কথা থাকলেও তা কিছুটা পিছিয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সানোফি পাস্তুরের মধ্যে চুক্তি হবে বলে গতকাল কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কনক কান্তি বড়ুয়া।

অন্যদিকে ভারতের বায়োটেক ও সানোফি পাস্তুরের সঙ্গে ট্রায়ালপ্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত চুক্তির পর্যায়ে আসেনি বলে জানিয়েছেন আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. কে এম জামান। আইসিডিডিআরবিতে চীনের সিনোভ্যাক ও বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেকের টিকার ট্রায়ালের নতুন কোনো অগ্রগতি হয়নি গতকাল পর্যন্ত।