বার্তা পরিবেশক :

‘আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক । তিনি ( বাবা) পেশাটাকে চাকরি হিসাবে নেননি। নিজের জমিদারী ফেলে তিনি পেশাটাকে গ্রহণ করেছিলেন মানুষ গড়ার একজন কারিগর হিসাবে। কিন্তু সমাজ তাঁকে মূল্যায়ন করেনি। তবুও আমি গর্ব করি একজন আদর্শিক শিক্ষকের মেয়ে হিসাবে। কারণ এই শিক্ষকেরাই হচ্ছেন দেশের উজ্জল ভবিষ্যৎ নির্মাণের মূল হাতিয়ার, নি:স্বার্থ কারিগর‘।

‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা-২০২০’ উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার ( ১৭ নভেম্বর) বিকাল পাঁচটায় অনলাইন সুধী সংযোগ কক্সবাজার পর্বের অনুষ্ঠানে এসব কথা তুলে ধরেন উম্মে সাদিয়া হোসেন সিকদার। কক্সবাজারের উপকূলীয় উপজেলা পেকুয়া থেকে তিনি আলোচনায় যুক্ত হন। তিনি কক্সবাজার সরকারি কলেজের সম্মান চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে সুধী সংযোগ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন কক্সবাজারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, আইনজীবী, কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধসহ নানা শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিরা।
প্রথম আলোর কক্সবাজার নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল কুদ্দুস রানার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও ইভেন্টস বিভাগের প্রধান মুনির হাসান। তিনি বলেন, শৈশবের শিক্ষকদের সম্মান জানানোর জন্যই আমাদের এই আয়োজন।

শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চের ম্যানেজার অনিবার্ণ সরকার। তিনি বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আমরা প্রিয় শিক্ষকদের সম্মানা জানাতে অংশিদার হয়েছি।

অনুষ্ঠানে চকরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এ কে এম গিয়াস উদ্দিন বলেন, শিক্ষকের জ্ঞান নিয়ে আমরা জগতকে দেখি। বিশে^র বিভিন্ন দেশে শিক্ষকের মর্যাদা সবার আগে, আমাদের দেশে এই পেশা এখন কতটুকু মর্যাদায় আছে সেটা আমরা সবাই জানি। মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। অনেকে অন্যান্য চাকরিতে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পেরে এ পেশাকে বেছে নিচ্ছে। এতে শিক্ষার মান তলানীতে যাচ্ছে।

কক্সবাজার সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মুহাম্মদ উল্লাহ বলেন, কক্সবাজারে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ফলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। তারা উচ্চ বেতনে রোহিঙ্গাশিবিরে চাকরি করছে। ফলে তাঁরা ভবিষ্যৎ জীবনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্টির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, সম্মাননা অর্জনের বিষয়। এটি এমনিতে আসে না। শিক্ষকের জীবনকে আমি দু’ভাগে দেখি। একটি সেটিসফাইড লাইফ আরেকটি সাকসেসফুল লাইফ। আমি কিন্তু শিক্ষকের ক্ষেত্রে সাকসেসফুল লাইফকে চাই না। কোনো শিক্ষক সেটিসফাইড লাইফে থাকলে তাঁর হা হুতাশ থাকবে না। তবে এটা সত্য যে শিক্ষক ছাড়া আমাদের গতি নেই। শিক্ষকদের নেতিবাচক কর্মকাÐ পরিহার করতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে শিক্ষকেরা সমাজে খাটো হচ্ছেন।

কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ছোটবেলার প্রায় সব শিক্ষককে মনে পড়ে। আমি মনে করি শিক্ষকেরা সভ্যতার অভিভাবক। তবে এটাও উল্লেখ করতে হয় আমরা শিক্ষকেরা প্রযুক্তির জ্ঞান কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি! শিক্ষার্থীদের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা কি আমরা দিতে পারছি ! এজন্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে হবে শিক্ষকদের।

কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আসমাউল হুসনা বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে যাঁরা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁরাই প্রিয় শিক্ষক। আমরা শিক্ষকেরা প্রাথমিক পর্যায় থেকে তৈরি হয়ে আসা শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি।
কক্সবাজার জেলা সন্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম বলেন, মেধাবীরা শিক্ষকতায় না এলে যোগ্য জাতি গড়ে উঠবে না। তাঁদের পর্যাপ্ত যোগান দিতে হবে। আর্থিক নিরাপত্তা না থাকায় আমাদের বাড়তি রোজগারের চিন্তা করতে হয়। এতে ভালো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয় না।

কক্সবাজার সরকারি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মফিদুল আলম বলেন, শিক্ষকতা পেশায় যদি মেধাবী মানুষগুলো আসে, তাহলে একটি সৃজনশীল জাতি উপহার দেওয়া সম্ভব।

কক্সবাজার সিটি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জেবুন্নেছা বলেন, আগের শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের প্রতি খুব দায়িত্বশীল ছিলেন। তাঁরা একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দিতে শিখিয়েছেন। এখন সেটা চোখে পড়েনা।

কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, শিক্ষকেরা মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকেরা অনুকরণীয়। তাঁরা সারাজীবন আলো দিয়ে যান। তবে দু:খের সঙ্গে বলতে হয় একজন প্রাথমিকের শিক্ষক কোনোমতে খেয়ে পরে বেঁেচ আছে। তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে আরও বেশি পদক্ষেপ দরকার।

অনুষ্ঠানে সংযুক্ত হয়ে আরও বক্তব্য দেন কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রামমোহন সেন, স্বেচ্ছাসেবী বেসরকারি সংগঠন মার্কি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হাসনা হুরাইন চৌধুরী, সুশাসনের জন্য নাগরিক ( সুজন) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান, কক্সবাজার বিতর্ক ক্লাবের সভাপতি কবি শামীম আকতার, কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, সমাজকর্মী মাসুমা আক্তার রুমি, টিআইবি কক্সবাজার ইয়েস ফ্রেন্ডস গ্রুপের সহ-দলনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন, কক্সবাজার ব্লাড ডোনার্স সোসাইটির এডমিন আশরাফুল হাসান রিশাদ, টেকনাফ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী মারুফা জান্নাত, রামু বিট পুলিশিং ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হাফেজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ।

অধিকাংশ বক্তা আইপিডিসি ও প্রথম আলো শিক্ষকদের সম্মাননার এই উদ্যোগকে অত্যন্ত প্রশংসনীয় দাবি করে এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান।
অনুষ্ঠানে একাধিক ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এ ছাড়া প্রিয় শিক্ষক সম্মাননার মনোনয়ন জমা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। অনলাইনে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করা যাবে (www.priyoshikkhok.com) ওয়েব ঠিকানায়। অনুষ্ঠানের আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন প্রথম আলো কক্সবাজারের বন্ধুসভার সদস্যরা।