সিবিএন ডেস্ক:
দেশে একের পর এক জলদস্যু ও বনদস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণ করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এসেছে ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। তবে জলদস্যুদের লাগাম টেনে ধরতে পারলেও এই দুষ্কৃতকারীদের মদতদাতাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি এখনও। এমনকি জানাও যায়নি, কাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় এসব দুর্ধর্ষ দস্যু বাহিনী তৈরি হয়েছিল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এসব দস্যু বাহিনীর গডফাদারদের তালিকা তাদের হাতে এসেছে। তাদেরও আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হবে। আত্মসমর্পণে না এলে আইনের হাত থেকে তারাও রেহাই পাবে না।

র‍্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, জলদস্যু তৈরির পেছনে যারা মাস্টারমাউন্ড হিসেবে কাজ করেছে, তারা আমাদের নজরদারিতে আছে। ২০১৬ সালের ৩১ মে সুন্দরবনের আলোচিত মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দস্যুদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছেন ৩২৮ জন জলদস্যু। জলদস্যু নির্মূল করা সম্ভব না হলেও কমানো গেছে অনেকাংশে।

র‌্যাব সদর দফতরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘জলদস্যুদের তৈরির পেছনে যারা মাস্টারমাউন্ড হিসেবে কাজ করেছেন, সেসব মাস্টারমাইন্ডকে আমরা নজরদারিতে রেখেছি। কারা জলদস্যুদের অস্ত্র জোগাড় করে দেয়, নৌকা বানিয়ে দেয়, দস্যুতা করার সাহস জোগায়, তাদেরও আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসবো। সেটা নিয়েও কাজ চলছে।’

এখনও আত্মসমর্পণে না আসা দস্যু নেতাদের সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আপনারা আত্মসমর্পণ না করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখোমুখি হলে কী পরিস্থিতি হবে, তা আপনারাই জানেন। যে যেখানে আছেন, তাদের খুঁজে বের করা হবে। তাই কঠোর পরিণতির আগে আত্মসমর্পণ করে ফেলুন।’

যা বললেন অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুরা

আব্দুল হাকিম ওরফে বাইশ্যা ডাকাত। তিনিই ‘বাইশ্যা ডাকাত দলের’ নেতা। আব্দুল হাকিম বলেন, ‘ডাকাত জীবনটা ভালো না। ভুল বুঝে আর খারাপ মানুষের প্রলোভনে এই অন্ধকার পথে চলে এসেছি। খুব যে টাকা পয়সা করেছি তাও না। একটা দিনও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। মানুষ আমাকে খারাপ জানে, তাতে কষ্ট নেই। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েকেও সবাই ঘৃণা করে। ভালো হবার সুযোগ পেয়েছি, তাই কাজে লাগালাম।’

বাইশ্যা ডাকাত বলেন, ‘আমরা বেঁচে থাকার সুযোগ খুঁজেছি। সুযোগ পেলে এ পথ থেকে ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। এই অন্ধকার পথে কোনও আলো নেই। আমরা প্রশাসনের ভয়ে রাস্তায়, এমনকি বাজারেও যেতে পারি না। র‌্যাব সুযোগটা করে দিয়েছে আমাদের।’

ডাকাতদের হাতে চোখ হারানো ভুক্তভোগীর বয়ান

কয়েক বছর আগে জলদস্যুদের হামলায় আহত ভুক্তভোগী নেছার মাঝি বলেন, ‘জলদস্যুরা আমার ফিশিং ট্রলারে আক্রমণ করলো। তাদের গুলিতে আমার বাম চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ডান পাশের গালে এখনও গুলি রয়ে গেছে। যা এখনও বহন করছি। এই এলাকার জলদস্যু ও সন্ত্রাসীদের কারণে হাজার হাজার মানুষ নির্যাতিত হয়েছে। আজ খুব খুশি হয়েছি ৩৪ জন জলদস্যুর আত্মসমর্পণ দেখে। অবশেষে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও র‌্যাবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

জলদস্যু বাবাকে আট বছর ধরে দেখেননি সন্তান

সকাল থেকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জলদস্যুদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। আত্মসমর্পণ করতে আসা সাহাবুদ্দিনের আট বছরের ছেলে রায়হান। জন্মের পর থেকে সে তার বাবাকে দেখেনি। শিশু রায়হান জানায়, ছোটবেলায় বাবাকে দেখিনি। বুদ্ধি হওয়ার পরেও বাবা দেখতে কেমন তাও জানতাম না। মায়ের কাছে বাবার অনেক গল্প শুনেছি। আমি জানি আমার বাবা খারাপ কোনও কাজ করেনি। এলাকার কিছু দুষ্টু মানুষ বাবাকে ফাঁসিয়ে বাড়িছাড়া করে দেয়। প্রথমবারের মতো বাবাকে দেখার জন্য মায়ের সঙ্গে এখানে এসেছি।’

সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারা বলেন, ‘স্থানীয় একটি মারামারির ঘটনার পর তার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়। মামলার পর তার স্বামী ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে জলদস্যু বাহিনীতে যোগ দেয়। এরপর দীর্ঘ আট বছর সে বাড়ি আসেনি। তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগও ছিল না। সে বেঁচে আছে কিনা চার বছর আগে তাও জানতেন না।’

বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) চট্টগ্রামের বাঁশখালী আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন এ এলাকার ৩৪ জন জলদস্যু।

র‌্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব-৭) উদ্যোগে ১১টি দস্যু বাহিনীর ২৪ জন ও অন্যান্য আরও ১০ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় তারা নিজেদের ব্যবহৃত দেশি-বিদেশি ৯০টি অস্ত্র ও ২ হাজার ৫৬ রাউন্ড গুলি ও কার্তুজ জমা দেন।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘শেখ হাসিনার বাংলদেশে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের দেশে কোনও চোর-ডাকাত থাকতে পারে না। যারা আত্মসমর্পণ করেছেন, তারা যেন সমাজের মূলধারায় ফিরে আসতে পারেন, সেজন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।’

আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুরা হলেন— বাইশ্যা বাহিনীর আব্দুল হাকিম ওরফে বাইশ্যা ডাকাত (৫২), আহামদ উল্লাহ (৪২) ও আব্দুল গফুর ওরফে গফুর (৪৭)। পুতুক বাহিনীর দিদারুল ইসলাম ওরফে পুতিক্যা (৩২), জসিম উদ্দিন (২৬) ও মিজানুর রহমান (২৩)। খলিল বাহিনীরর আব্দুর রহিম (৬৪) ও মাহমুদ আলী প্রকাশ ভেট্টা। বাদল বাহিনীর ওবায়দুল্লাহ (৩৬), রমিজ বাহিনীর ইউনুছ (৫৬), দিদার বাহিনীর তৌহিদ ইসলাম (৩৪), বাদশা বাহিনীর নিজাম উদ্দিন ভাণ্ডারী, ইউনুস (৫১), কামাল উদ্দিন (৪৭), কাদের বাহিনীর আব্দু শুক্কুর (২৮)। জিয়া বাহিনীর সাহাদাত হোসেন দোয়েল (৪১), পারভেজ (৩৩), নাছির বাহিনীর নাছির (৫১), আমির হোসেন (৪৮), সাকের (৪০)। কালাবদা বাহিনীর সেলিম বাদশা (৩৪), আব্দুল গফুর ওরফে গফুর, আবু বক্কর সিদ্দিক (৩১), মামুন মিয়া (২৭)।

অন্যান্য দস্যুবাহিনীর আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে বাইশ্যা (২৯), বেলাল মিয়া (৩০), আব্দুল হাকিম ওরফে বাক্কু (৩৫), রশিদ মিয়া (৩৬), ইসমাইল (২৪), সাহাবুদ্দিন ওরফে টুন্নু (৩২), ফেরদৌস (৫২), রেজাউল করিম (৪০), ইউনুচ (৪২) ও মঞ্জুর আলম (৪২)।

র‍্যাব বলছে, ২০০৪ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব ২৪৮ জন জলদস্যুকে আটক করে। উদ্ধার করে ৭৯৭টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৮৮৪২ রাউন্ড গোলাবারুদ। এছাড়াও ২০১৮ সালে ৪৩ জন জলদস্যু র‍্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে।