শাহিদ মোস্তফা শাহিদ:
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে কক্সবাজার সদরের বৃহত্তর ঈদগাঁওর
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক- টিউশন ফি আদায় বন্ধ হয়নি। করোনাকালে আর্থিক সংকটে পড়া অভিভাবকরা সন্তানের টিউশন ফি কমানোর মৌখিক আবেদন করেও কোনো ছাড় পাচ্ছেন না কেউ। ছলে-বলে-কৌশলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে মাসিক বেতন ও টিউশন ফি কড়ায়-গন্ডায় আদায় করে নিচ্ছে ঈদগাঁও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অনেকে শিক্ষার্থীদের বাসায় বসিয়ে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হোম ওয়ার্ক দিয়ে ও পরীক্ষা নিয়ে ফলাফল প্রকাশের কথা বলে ক্যাম্পাসে ডেকে টিউশন ফি আদায়ে বাধ্য করছে। অনেকে বাড়ি বাড়ি শিক্ষক পাঠিয়ে টিউশন ফি’র জন্য অভিভাবকদের চাপ দিচ্ছে। অনেকে আবার ভার্চুয়াল পরীক্ষার ফিও আদায় করছে। না দিলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে জরিমানাসহ এইসব ফি আদায়ের হুমকি দিচ্ছে অনেক কর্তৃপক্ষ।

অভিভাবকদের এসব মৌখিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া মাসিক টিউশন ফির টাকা দিয়েই শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়। তাই এই ফি আদায় না করলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব হবে না।শিক্ষার্থীদের মাঝে করোনা ভাইরাসের সংক্রামণ ঝুঁকি এড়াতে গত ১৮ মার্চ থেকে সারা দেশের মতো কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁওয়ের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। ৮ মাস পেরোলেও সরকারের সবুজ সংকেত নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে। এ অবস্থায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা পড়েছেন বাড়তি চাপে।

স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র রিফনের বাবা সেলিম উল্লাহ জানান, তার মেঝ ছেলে ঈদগাঁওয়ের একটি সুনামধন্য স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকরা ভার্চুয়াল ক্লাস নিচ্ছেন। ৮ মাস অতিক্রম হলেও এখন পর্যন্ত কোনো টিউশন ফি দাবি করেনি।

কিন্তু তিনি বলেন, ‘আমার আরেক ছেলে স্থানীয় আরেকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। স্কুল বন্ধের পর থেকে প্রতি মাসেই টিউশন ফি আদায়ের জন্য ফোন করছেন শিক্ষকরা। ভার্চুয়ালে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বললেও আমি ছেলেকে পরীক্ষা দেওয়াইনি। কারণ, বাসায় বসে পরীক্ষার কোনো মূল্য দেখছি না আমি। পাশে বসিয়ে পড়ানোই যেখানে দায়, সেখানে এই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ভার্চুয়ালের কী বুঝবে? কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ নিয়মিত মাসিক টিউশন ফির জন্য চাপ প্রয়োগ করছে।’

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই শিক্ষার্থীর মতো একই অবস্থা বৃহত্তর ঈদগাঁওয়েতে বেঙের ছাতার মতো গজে উঠা প্রত্যেকটি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনের। কিছু কিছু কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা অভিভাবকদের ঠিকানা সংগ্রহ করে বাসায় গিয়ে মাসিক টিউশন ফি আদায় করছেন। অভিভাবকদের আর্থিক সংকট না থাকলেও চাপ প্রয়োগে ফি আদায়ের নজিরও রয়েছে।

ঈদগাঁও দরগা পাড়া এলাকার রায়হান, মাধ্যমিক স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র মো রিয়াদসহ একাধিক শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা জানান, করোনায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকে প্রতিমাসের টিউশন ফি পরিশোধের জন্য চাপ দিয়ে আসছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ভার্চুয়ালে মাসিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেও ফি আদায় করছে। করোনাকালে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের সঠিকভাবে গাইডলাইন না দিয়ে অনলাইন ক্লাসের নামে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।’

অভিভাবকদের অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় কয়েকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সাথে,তারা যেমনটি বললেন মাসিক ফি আদায় না করতে সরকারি ভাবে কোন প্রজ্ঞাপন হয়নি, তাই শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন দিতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক ফি নেওয়া হচ্ছে।

ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান ‘শিক্ষকদের চাপপ্রয়োগের কারণে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭ মাসের মাসিক ও পরীক্ষা ফি বাবদ ২৪ শ টাকা পরিশোধ করেছি। চলতি মাসেরটাও পরিশোধ করতেও বলা হচ্ছে। স্কুল বন্ধ; কাস বন্ধ। অথচ ফি দিতে হবে পুরোপুরি এটা খুবই পীড়াদায়ক।’

তিনি আরও জানান, শিক্ষার্থীদের বাসায় বসিয়ে ভার্চুয়ালে পরীক্ষা নেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আজ পরীক্ষার রেজাল্ট নেওয়ার জন্য বাধ্য করেছে স্কুলে আসতে। যদিও এখনো পরীক্ষার কোনো ফি দাবি করেনি, তবু বলবো, ‘অনলাইনে পরীক্ষা নিতে পারলে রেজাল্ট কেন অনলাইনে দেওয়া গেল না? করোনা ঝুঁকি নিয়ে কেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্কুল আসতে হলো? এটা টিউশন – মাসিক আদায়েরই একটা কৌশল।’

অভিভাবকদের ভাষ্য, ‘করোনাকালে ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখা না থাকলেও শিক্ষকদের সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। ছেলেমেয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে আমরা যেন গলায় কাঁটা নিয়েছি। যতই করোনায় আর্থিক সংকটে থাকি না কেন, তাদের পাওনা ঠিকই মেটাতে হবে। নইলে হয়তো পরিবেশ স্বাভাবিক হলে শুনবো, ছেলের ভর্তি বাতিল হয়েছে। তাই আমরা মাসিক- টিউশন ফি দিতে বাধ্য।’

এমপিওভুক্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ৩/৪ জন অভিভাবকের অভিযোগের বিষয়ে কয়েকজন সহকারী শিক্ষকের সাথে কথা হয় তারা জানান , ‘করোনা মহামারীতে কমবেশি সব শ্রেণির মানুষ আর্থিক সংকটে রয়েছেন।

ঈদগাঁওতে প্রায় স্কুলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ছেয়ে নন এমপিও শিক্ষক কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। সরকার থেকে যে বেতন পান, সেটিও সামান্য। শিক্ষার্থীদের মাসিক- টিউশন ফি দিয়েই শিক্ষক এবং কর্মচারীদের বেতন চলে। যদি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই মাসিক- টিউশন ফি নেওয়া বন্ধ করে দিই, তাহলে শিক্ষক ও কর্মচারীরা তাদের পরিবার নিয়ে এই মুহূর্তে কোথায় যাবেন?’

পাঠদান বন্ধ থাকলেও টিউশন ফি পরিশোধে চাপ প্রয়োগের বিষয়ে শিক্ষাবিদরা বলেন, মাসিক বেতন বা টিউশন ফি পরিশোধে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকদের চাপ প্রয়োগ করা অন্যায়। আবার বেতন বা ফি না দেওয়ার জন্য সরকারও কাউকে নিষেধ করেনি। কারণ, শিক্ষার্থীদের বেতনেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয়।

তবে তিনি বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী বা অভিভাবককে চাপ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেকে এনে ফি পরিশোধের নামে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না।

প্রাপ্ত তথ্যে ও খোঁজ খবর নিয়ে আরো জানান, ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতন, ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, পোকখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, গোমাতলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, সাগরমনি উচ্চ বিদ্যালয়, নাপিত খালী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, জাহানারা ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভারুয়া খালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, চৌফলদন্ডী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কিন্ডার গার্ডেন স্কুল সমূহে অনেকটা জোর করে মাসিক ফি আদায় করে আসছে। তারা ফি আদায়ের কোন রশিদপত্রও দিচ্ছে না শিক্ষার্থীদের হাতে। কোন কোন স্কুলে ২/৩ হাজার টাকা করে আদায় করে আসছে বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও সুরাইয়া আক্তার সুইটি বলেন, করোনা ভাইরাসেরসংক্রমণের কারণে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ক্লাস নিয়েছিল শিক্ষকরা। তাই শিক্ষকদের প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে যেহেতু সরকারি ভাবে মাসিক ফি আদায় না করতে কোন প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। যারা দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থী তাদের বিষয়টি পরবর্তীতে দেখব বলে জানান তিনি।