আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ। বাকি ফলাফল ঘোষণা। কে জিতবেন- জো বাইডেন নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প? সারাবিশ্ব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে। ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে এগিয়ে থাকায় ইতোমধ্যেই বাইডেনকে সম্ভাব্য বিজয়ী মনে করছেন অনেকে। তবে সুযোগ রয়েছে ট্রাম্পের সামনেও।

নতুন প্রেসিডেন্ট যে-ই হোন, কিছু সংকট বা বাধার মুখে পড়তে পারে তার প্রশাসন। এ বিষয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। লেখাটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য-

কয়েক মাসের নির্বাচনী উত্তেজনা, প্রচারণায় ১ হাজার ৩৯০ কোটি ডলার ব্যয়, মহামারির তাণ্ডব আর তুমুল বিক্ষোভের পর আমরা এখনও জানি না কে হবেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট? সত্যিই কি জো বাইডেন জিতবেন নাকি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? হাউসে ডেমোক্র্যাট এবং সিনেটে রিপাবলিকানদের জয়ে বিভক্ত হতে পারে কংগ্রেস। যদিও, আগামী জানুয়ারিতে ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হওয়া পর্যন্ত সিনেট নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে।

আগামী দিনগুলোতে ভোটারদের কাছ থেকে ধারণা নেয়া উচিত রাজনীতিবিদদের। এই ভোটাররাই এবছর ১৯০০ সালের পর যেকোনও সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং তারা সহিংসতা ছাড়াই পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। ভোট গণনা অবশ্যই চালিয়ে যাওয়া উচিত এবং দুই দলের মধ্যে বিরোধ আইনি পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি হওয়া দরকার।

তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রাতেই জিতে গেছেন বলে মিথ্যা দাবি করেছেন এবং তার বিজয় চুরি করা হচ্ছে মন্তব্য করে সমর্থকদের উত্তেজিত করে তুলেছেন।

যে ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার কাছ থেকে এ ধরনের উসকানি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, কেন ট্রাম্পের ডাকে সাড়া না দিতে অনেকেই ভোটারদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিক থেকে জো বাইডেনের জয় হতে পারে এই পথে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ।

বিগত ৪০ বছরে মাত্র একবারই যুক্তরাষ্ট্রের কোনও প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যেতে পারেননি। পপুলার ভোটে হারতে চলেছেন ট্রাম্প। শুধু ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের জটিল হিসাবই তাকে চূড়ান্ত পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করছে। তবে এটাও একধরনের প্রত্যাখ্যান।

হোয়াইট হাউস বাইডেনের হলে অবশ্য সুর পুরোপুরি বদলে যাবে। অযাচিত টুইট এবং পক্ষপাতদুষ্ট বিভাজন বন্ধ হবে। বন্ধ হবে ব্যক্তিগত লেনদেন, অভ্যাসগত মিথ্যাচার এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে সরকারি বিভাগের ব্যবহারও। জো বাইডেন যথেষ্ট শালীন ব্যক্তি। ভোট শেষ হতেই তিনি দলমত নির্বিশেষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার শপথ করেছেন। তার বিজয় জলবায়ু থেকে অভিবাসন বিষয়ক মার্কিন নীতি বদলে দেবে। এটিও প্রত্যাখ্যানের একটি রূপ।

এরপরও ভোট ব্যবধান অপ্রত্যাশিতভাবে কাছাকাছি থাকার অর্থ- যুক্তরাষ্ট্রে আধিপত্যবাদ টিকে থাকছে। এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ২০১৬ সালে ট্রাম্পের আশ্চর্যজনক জয় কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার দলের গভীর আদর্শিক পরিবর্তনের সূচনা ছিল মাত্র।

জনগণের প্রত্যাশা এবং করোনাভাইরাসকে অস্বীকার করেও ট্রাম্প ২০১৬ সালের চেয়ে ২০২০-এ কয়েক লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন। নীল ঢেউয়ে ভেসে না গিয়ে প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের আসন বেড়েছে এবং সিনেটের নিয়ন্ত্রণও ধরে রাখবে বলে মনে হচ্ছে। ট্রাম্পের শাসনামলে রিপাবলিকান পার্টি যে মোহতে পড়েছে তা হুট করেই নেমে যাওয়ার কথা নয়। বরং তা ২০২৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত চলতে পারে। আগামী নির্বাচনেও ট্রাম্প নিজে বা তার পরিবারের কোনও সদস্য হোয়াইট হাউসের জন্য লড়তে পারেন।

বহির্বিশ্ব এবারের মার্কিন নির্বাচন সতর্কভাবে প্রত্যক্ষ করছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পবাদ প্রত্যাখ্যান করতে ব্যর্থ হলে দু’টি ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে, আধিপত্য ও জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে যারা ট্রাম্পকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেন, তারা মনে করবেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও তাদের রাজনৈতিক ব্র্যান্ডের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় ব্রাজিলের জেইর বোলসোনারো এবং ফ্রান্সের মেরিন লে পেনের মতো রাজনীতিবিদদের জন্যেও সমস্যা তৈরি করতে পারে। ব্রেক্সিট পার্টির নেতা নাইজেল ফ্যারাগে ইতোমধ্যেই প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা করছেন। ট্রাম্পের জেদী সমর্থন ইঙ্গিত দেয়, অভিবাসন এবং বিশ্বায়নের বিরোধিতা আরও দীর্ঘদিন চলবে।

দ্বিতীয় ইস্যুটি হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে সতর্ক হতে হবে। বৈদেশিক বিষয়গুলোতে সংহতিনাশক এবং জোট ও বহুপাক্ষিকতার প্রতি অনেকটাই বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন ট্রাম্প। বিপরীতে, জো বাইডেন সিনেটর থাকাকালীন সময় থেকেই মার্কিন কূটনীতির প্রচলিত মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি নিঃসন্দেহে মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুনরুদ্ধার এবং বিশ্ব প্রশাসন জোরদারের চেষ্টা করবেন। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় থেকে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও যোগ দেয়াবে বাইডেন সরকার। তবে এসব কিছু ২০২৪ সালে আবারও ফিরে আসতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দৃশ্য আরও জটিল। যদিও এটি দুই পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হবে। তবে সবচেয়ে কঠিন সংকট থাকবে ডেমোক্র্যাটদের সামনে। সিনেট দখলে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ- বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলেও বিভিন্ন বিল পাস বা বিচারক নিয়োগে বাধার মুখে পড়বেন। অবকাঠামো বিল, স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার, পরিবেশ বিষয়ক আইন- সবগুলোই কংগ্রেসে আটকে যেতে পারে।

সমস্যার মুখে পড়বে রিপাবলিকানরাও। ট্রাম্পবাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা যদি বাইডেনকে অপমানিত করতে সিনেটে সব বিলই অবরুদ্ধ করে রাখে, তাহলে সেটি আরও একটি নির্বাচনী চক্র হিসেবে চিহ্নিত হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে তার সমস্যাগুলো সমাধানে বাধা দেয়। রিপাবলিকানরা নিজেদের এটা বলে সান্তনা দেবে যে, ওয়াশিংটনের শাসককে অসম্মান করা তাদের দলকে সহায়তা করছে। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি যতটা স্বল্পদৃষ্টির, ততটাই মানববিদ্বেষী।