মোহাম্মদ ইব্রাহিম মোস্তফা, উখিয়া :
প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে লম্বাশিয়ায় আশ্রয় নিয়ে ছিলাম। গাছপালা কেটে উপরে একটি ছাউনি দিয়ে কোন রকম রাত কাটানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু সূর্য উঠার পরে ওই ছাউনির তলে আর টিকে থাকতে পারলাম না। প্রচন্ড গরমে ছেলে মেয়ে গুলো ছটপট করতে লাগল। ভাত রান্না করার জন্য আমার স্ত্রী রহিমা চুলোই আগুন দিয়ে বলেছিল এভাবে জীবন কাঠানো যাবে না।
এখানে গাছ রোপন করতে হবে। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ডাব্লিউএফফি, এফএও সহ অনেক দাতা সংস্থা এবং BRAC, Arannayak, CNRS, সহ অনেক এনজিও এই কাজের সাথে নিয়োজিত আছে।
ডব্লিউএফফি’র অর্থায়নে এনজিও সংস্থা সুশীলনের ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি সহায়তায় প্রকৃতির সাজে সজ্জিত হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। রোহিঙ্গাদের অনেকেই বললেন, যদি জানতাম গাছপালার জন্য পরিবেশগত উন্নয়নে ক্যাম্পে শান্তির সু-বাতাস বইবে তাহলে গাছপালা কাটতাম না।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উখিয়া টেকনাফে ৮ হাজার ১৬৩ একর বনভূমি রোহিঙ্গারা উজাড় করেছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গারা জ্বালানি মেটাতে ৪
হাজার ২৭ একর সৃজিত বনভূমি ধ্বংস করেছে। আর বসতি স্থাপন করতে গিয়ে ৪ হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক ন্যাড়া করা দিয়েছে। এ ন্যাড়া বনগুলো পূর্বে স্থানে ফিরিয়ে নিতে সরকারের নির্দেশে এনজিও সংস্থা গুলো বিভিন্ন ভাবে পদক্ষেপ নিয়ে গাছ রোপনে রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করছে।
সম্প্রতি মধুরছড়া, লম্বাশিয়া ঘুরে দেখা যায় রোহিঙ্গাদের বাড়ির আনাছে কানাছে গড়ে উঠেছে ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছ। জানতে চাওয়া হলে ক্যাম্প ৮ডব্লিউ’র বাসিন্দা আলম শাহ (২৮) জানান, প্রকৃতির আনন্দর ভাগাভাগি করে আমরা বেঁচে আছি। গত তিন বছরে আমরা প্রচন্ড তাপমাত্রায় যা কষ্ট পেয়েছি এখন তা আর মনে পড়ে না। মনে হয় যেন সরকারের হাতে গড়া একটি পর্যটন পরিবেশ। ওই রোহিঙ্গা আরো জানান, এনজিও সংস্থা সুশীলনের উৎসাহে রোহিঙ্গারা উৎসাহিত হয়ে বাড়ির আনাছে কানাছে গাছ লাগিয়েছে এবং তা সংরক্ষণ করায় গাছগুলো খুব সহসায় বেড়ে উঠে ছায়া দিতে সক্ষম হয়েছে। যা ভোগ করছে ছায়াতলের বাসিন্দারা। তারা মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করতে পারছে মানব জাতির জন্য প্রকৃতির কি অবদান?
ক্যাম্প ৮ডব্লিউ’র হেড মাঝি আব্দুল হাই বলেন, আগে আমরা নিঃশ্বাস ফেলতে পারিনি এবং নিতেও পারিনি। এখন পরিবেশ উন্নয়নের ফলে প্রাণ ভরে শ্বাস নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারছি। তিনি বলেন, পরিবেশগত কারণে ক্যাম্পের রোগ ব্যধি পর্যন্ত কমে গেছে। এখন ঘরে ঘরে উৎসাহ উঠেছে এক ইঞ্চি পরিমাণও খালি জায়গা থাকবে না। রোহিঙ্গারা থাক আর না থাক তাতে সরকারের কিছুই যায় আসে না।
তবে রোহিঙ্গাদের রোপন করা গাছগুলো একদিন রোহিঙ্গাদের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকবে। তিনি বলেন, গাছ উন্নয়নের নেপথ্যে এনজিও সংস্থা গুলোর অবদান অস্বীকার করা যায় না। কেননা তারা যদি ঘরে ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ না করতো তা হলে রোপন করা গাছ দিয়ে জ্বালানি হিসেবে রান্না বান্নার কাজ করতো রোহিঙ্গারা। তাহলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নে চিন্তা করা কঠিন ছিল। কারণ যেখানে রান্নার জন্য কাঠের দরকার সেখানে রোহিঙ্গাদের কাছে গাছের কদর প্রয়োজন মনে করা মানে ভ্রান্ত ধারণা বলে মনে করছে সচেতন মহল।
প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন নিয়ে যিনি ১৮ ঘন্টা কাজ করছেন তিনি এনজিও সংস্থা সুশীলনের সিনিয়র ফরেষ্ট অফিসার মোঃ ফারহান হকের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, মূলত তিনি কাজ করছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশের উন্নয়নের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ও পাখির কল কাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠে ক্যাম্প গুলো। যেখানে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই ওই সমস্ত জায়গায় প্লট আকারে গাছ রোপন করা হচ্ছে। এভাবে প্রায় শতাধিক প্লটে এক কোটির উপরে গাছের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। তারা যেন এ গাছ গুলো তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় বা আনাচে কানাছে রোপন করে ক্যাম্পের পরিবেশ পরিবর্তন করতে সম্মত হয়। তিনি বলেন, যেভাবে ক্যাম্পের চির সবুজের উন্নয়ন হচ্ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ক্যাম্প গুলো হয়ে উঠবে অভায়ারণ্য।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ডব্লিউ, ক্যাম্প-৫ ও ক্যাম্প ১৭ এর ইনচার্জ হাফিজুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গাছ পালা উঠার কারণে ক্যাম্পের পরিবেশের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ইচ্ছে করে ক্যাম্পে হেটে একটু নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তিনি বলেন, ক্যাম্পে গাছ রোপনের জন্য
রোহিঙ্গাদেরকে অনেক চাপ প্রয়োগ করতে হয়েছে। যাকে যেভাবে পারি সেভাবে ম্যানেজ করে গাছ লাগাতে সহায়তা করেছি। যে কারণে আজ রোহিঙ্গা সবুজের সমারোহতে পরিণত হয়েছে।
উখিয়া উপজেলা বনরেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী তরিকুল ইসলাম বলেন, এনজিও সংস্থার সহায়তায় রোহিঙ্গাদের সামগ্রিক উদ্যোগ ক্যাম্পগুলো সবুজায়ন হতে শুরু করেছে। এতে জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।