মোহাম্মদ ম্যাক্স :
রবার্ট গ্রিনির লেখা ‘ ক্ষমতার ৪৮ টি আইন’ বইটি খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
বইটিতে প্রায় অনেক ক্ষমতাশালী ব্যাক্তির উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। কিভাবে তারা ক্ষমতার চরম শিখরে আরোহন করেছেন আবার কিভাবে অনেকেই সামান্য ভুলের কারনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন তার বিষদ বর্ননা দিয়েছেন।
এই বইয়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে আমার প্রিয় ৬ টি সিবিএন পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হল।
১. নিকোলাস ফকুট লুইস, তার সময়ের ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন দয়ালু, নারীসংগ উপভোগকারী আর সাহিত্য অনুরাগী মানুষ ।
টাকার প্রতি ছিল তার অনেক লোভ যেহেতু তিনি সবসময় রাজকীয় জীবনযাপন করতেন৷
ফকুট খুব চতুর লোক ছিলেন আর সম্রাটের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যাক্তি ।
যখন সে সময়ে, ফ্রান্সের ১৬৬১ সালে, প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হয় , ফকুটকে এই পদে স্থলাভিষিক্ত করার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী ছিলেন।
পক্ষান্তরে সম্রাট এই পদটিই বিলুপ্ত ঘোষণা করেন, ফটুকের মনে হল, তিনি সুযোগ হারাতে যাচ্ছেন।
তাই সম্রাটকে খুশি করতে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল এক পার্টির আয়োজন করলেন।
এই পার্টির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ফটুকের বিশাল অট্টালিকার প্রদর্শন, আর দেখানো হল যে যেন অতিথি আর সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।
ইউরোপের সম নামীদামী মানুষের আগমন ঘটল, এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অনেকই বিখ্যাত কবি কবিতা লিখলেন।
৭ বার ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ডিনারের ব্যাবস্থা করা হল যা ফ্রান্সের ইতিহাসে কখনো খাওনো হয়নি, যেসব আলাদাভাবে এই পার্টির জন্যে করা হয়েছে।
ডিনার শেষে অট্টালিকা পর্যন্ত শোভাযাত্রা শুরু হল যা এই প্রাসাদের শোভা বর্ধন করে।
ফকূট নিজেই সম্রাটকে সাথে নিয়ে সবকিছু দেখালেন, ফুলশয্যা থেকে শুরু করে গুল্ম বাগান ইত্যাদি ।
সারারাত পার্টি চলল, সবাই বলতে লাগল, এটি তাদের দেখা সেরা আয়োজন ।
কিন্তু পরের দিন সম্রাটের আদেশে ফকুটকে আটক করা হল, তার ট্রেজারী থেকে সম্পদ চুরির দায়ে বিচার শুরু হল।
বিচারে তার ২০ বছরের সাজা হল আর দেশের অদুরে একটি সেলে তার সুদীর্ঘ জীবন কাটল।
2 . বন্ধু, কে? তারা হল একজন বিষাক্ত দাঁত আর থাবার প্রাণী, এটি একটি চীনা প্রবাদ।
তুমি সতর্ক না হলেই তোমাকেও ওরা গিলে খাবে, সম্রাট সাং সিংহাসনে বসে তা বুঝতে পেরেছিলেন, সেনাবাহিনীতে থাকা তার বন্ধুরা তাকে মারবে আর কোনরকম বেঁচে গেলে সরকারের বন্ধুদের খাবারে পরিনত হবে সে।
সম্রাট সাং তাই তার বন্ধুদের সাথে কোন লেনদেন রাখতেন না, তার সংগী জেনারেলদের দুরে কোন রাজ্যের ভার দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন।
এটি ছিল তাদের মেরে ফেলার চেয়েও ভাল টেকনিক, যাতে তারা ও পরে প্রতিশোধ নিতে না পারে।
সম্রাটের তার বন্ধুবর মন্ত্রীদের সাথে কোন সম্পর্ক ছিলনা, বরঞ্চ তাদের নিজেদের অজান্তে তারা সম্রাটের মদের কাপে বিষ পান করতেন।
তার বন্ধুদের পরিবর্তে সাং শত্রুদের বেশী কাছে রাখতেন আর তাদের অনেক সুযোগ সুবিধা দিতেন। পক্ষান্তরে বন্ধুরা সম্রাট থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করত আর না পেয়ে ঈর্ষান্বিত হত, অপরদিকে তার শত্রুরা কিছু প্রত্যাশা ছাড়াই সব পেয়ে যেত।
মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত কেউ যখন ক্ষমা পেয়ে যেত, তখন সম্রাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে শেষদিন পর্যন্ত তার আনুগত্য মেনে নিত।
ফলে শত্রু ও বন্ধুতে পরিনত হত।
তাইত এতে করে সাং প্রথমবারের মতো রাজ্যের অভূথ্যান, বিদ্রাহ, গৃহযুদ্ধ থামাতে সক্ষম হন, আর তার এই বংশ প্রাত ৩০০ বছর চীন শাসন করে।
3. প্রায় ১৯২৬ সালের দিকের কথা, এক লম্বা লোক, সে সময়ের শ্রেষ্ঠ গ্যাংস্টার আল কাপোনী সাথে দেখা করতে আসেন।
চমৎকার ভাষা দিয়ে লোকটা পরিচয় দেন যে তার নাম ভিক্টর লাস্টিগ।
তিনি আল কাপোনীকে বললেন, তিনি যদি তাকে ৫০ হাজার ডলার ধার দেন তাহলে তিনি তাকে তার দিগুণ মুনাফা দিবেন।
আল কাপোনী আগন্তুক কাউকে বিশ্বাস করতেন না, তিনি লোকটার দিকে তাকালেন, তার পরিধেয় কাপড় , কথাবার্তা সব শুনে তাকে টাকা দিতে রাজি হলেন।
টাকা গুনে দিয়ে বললেন, এই নাও তোমার টাকা, কথামতে দেখ দিগুণ দিবে ৬০ দিনের মধ্যেই।
লাস্টিগ টাকা নিয়ে শিকাগোর একটি সেফ ডিপোজিট বক্সে রাখলেন আর নিউইয়র্কে আরেকটি ধান্ধা করতে চলে গেলেন।
টাকা সেই বক্সে রয়েই গেল, লাস্টিগ তা দিগুণ করার কথা বাদই দিলেন। দুমাস পরে বক্স থেকে টাকা নিলেন আর আবারও আল কাপোনীর সাথে দেখা করলেন।
‘ আমাকে ক্ষমা করুন জনাব কাপোনী, আমার পরিকল্পনা ব্যার্থ হয়েছে, আমি মুনাফা করতে পারিনি’।
আল কাপোনী দাঁড়ালেন আর নদীর কোন দিকে তাকে ছুঁড়ে মারবেন তা ভাবছিলেন। এদিকে লাস্টিগ টাকা গুনে দিয়ে দিলেন, আবারও ক্ষমা চাইলেন, বললেন যে তার খুব ইচ্ছে ছিল মুনাফার, কিন্তু ভাগ্যই খারাপ, আবারও ক্ষমা চাইলেন।
হতবিহবল হয়ে কাপোনী চেয়ারে বসলেন আর বললেন, ‘ তুমি যেদিন প্রথম এখানে এসেছিলে আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি একজন প্রতারক , আমি ১ লক্ষ ডলার আশা করেছিলাম অথবা অন্য কিছুইনা ‘।
‘ আমি আবারও অনুতপ্ত স্যার’ বলেই লাস্টিগ চলে যেতে প্রস্তুত হলেন।
টাকা গুনে দেখে কাপোনী বললেন, অবাক ব্যাপার , তুমি খুবই সৎ, এই নাও তোমাকে ৫ হাজার ডলার দিলাম।
অবাক হয়ে লাস্টিগ ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে গেলেন৷
মুলত, এসব করে লাস্টিগের এই ৫ হাজার ডলারই লাভ হল।
4. ১৯৭৪ সালে মোহাম্মদ আলি আর জর্জ ফোরম্যানের মাঝে বিশ্ব হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই শুরু হল। সবাই জানত কি হবে। ফোরম্যান আলিকে পাঞ্চ করতে চাইবেন আর আলী সুযোগ না দিয়ে তার আশপাশ থেকে তাকে পাল্টা আক্রমণ করবেন যা আলী স্বাভাবিক করে থাকেন, ১০ বছর ধরে এর পরিবর্তন ও হয়নি।
কিন্ত এবারে মনে হল আলী ফোরম্যানকে সুযোগ দিচ্ছেন, যথারীতি , তিনি অপেক্ষা করলেই আলী আক্রমণে যেতেন।
কিন্তু আলীকে এই খেলার চতুর কৌশলী হিসেবে সবাই জানেন, খেলার আগের দিন তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন যে, প্রথমবারের মত তিনি তার কৌশল বদলাবেন, যদি ফোরম্যান থেকে শুরু করে কেউ এই কথা বিশ্বাস করেন নি আর সেটিকে কৌতুক হিসেবে নিয়েছেন।
এমনকি তার কোচ রিং এর রশি হালকা করলেন, যদি অনেকেই এটিকে একটি ফাঁদ মনে করেছেন।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আলী যা বলেছেন ঠিক সেভাবেই করলেন।
যখন ফোরম্যান আলীর নাচের জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন , সেই সময়ে আলী তাকে আঘাত করে বসলেন। তিনি তার প্রতিদন্ধীর কৌশল ভেংগে দিলেন, ফোরম্যান পাল্টা পাঞ্চ করতে লাগলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলী ফোরম্যানকে নক আউট করে দিলেন।
বিশ্বাস করার যে অভ্যাস তা মানুষের মন থেকে সহজেই যায়না, এই যে ফোরম্যান আলীর ঘোষণার পর ও যে বিশ্বাস করে গেলেন সেই ফাঁদেই ফোরম্যান পা দিলেন।
5. কোন এক দিন ইতালিয়ান পেইন্টার ফ্লিপ লিপ্পি ছোট একটি বোট নিয়ে সাগর ভ্রমণে বের হলেন।
তারা মুলিশ কতৃক আটক হলেন, তাদের চেইন পরানো হল আর বারবারিতে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হল।
১৮ মাস থাকার পর ও ফিলিপ ইতালিতে ফিরে যাওয়ার কোন আশাই দেখলেন না।
ফিলিপ কয়েকবার যে লোকটা তাদের ক্রেতা তাকে লক্ষ করলেন এবং কয়লা দিয়ে তার একটি স্ক্যাচ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
চেইন পরা অবস্থায় তিনি একটি সাদা দেওয়াল মুরিশ কাপড় পরিহিত তার মালিকের স্ক্যাচ বানিয়ে ফেললেন।
মালিক এব্যাপারে শুনলেন, এখানকার স্থানীয়রা এই স্ক্যাচ শিল্পের ব্যাপারে জানতেন না, তাই তারা এটি খোদাপ্রদত্ত মনে করলেন।
এই স্ক্যাচ দেখে মালিক এত খুশি হলেন যে সাথে সাথেই ফিলিপ কে মুক্তি দেওয়া হল আর তাকে তার দরবারে নিয়োগ দেওয়া হল।
এই স্ক্যাচ সবাই দেখতে আসলেন, এক সময় ফিলিপকে সম্মনা জানিয়ে নিরাপদে ইতালি পৌঁছে দিলেন।
ফিলিপ এই ক্ষেত্রে তার ড্রয়িং এর ক্ষমতা ব্যাবহার করে নিজের মুক্তির ব্যাবস্থা করেন।
6. মে মাস ১৯২৫, ফ্রান্সের সবচেয়ে সফল ৫ স্ক্রাপ ব্যাবসায়ীদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিংয়ে ডাকা হল, ফ্রান্সের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেল কার্রল্টন, আমন্ত্রনকারী টেলিগ্রাফ মন্ত্রণালয়ের জেনারেল লাস্টিগ ।
তাদের কোন ধারনা ছিলনা তাদেরকে কেন আমন্ত্রণ জানালো হল, জেনারেল আসলেন আর বললেন, ‘ জনাব আপনাদের দেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ডাকা হয়েছে যা আপনার খুবই গোপন রাখবেন, সরকার আইফেল টাওয়ার ভেংগে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কারন খরচ বেড়ে যাচ্ছে আর এটি জাস্ট অতীতের ছায়া ‘।
। সবাই অবাক হয়ে শুনলেন, এদিকে জেনারেল লাস্টিগ তাদেরকে টোটাল কত টন লোহা আর অন্যান্য ধাতব কি আছে তার একটি নমুনা দিয়ে সরকারের টেন্ডারের ব্যাপারে জানালেন।
তারপর লাস্টিগ তাদের জন্যে অপেক্ষা মান লিমু নিয়ে আইফেল টাওয়ার এর সব তন্ন তন্ন করে দেখালেন আর ৪ দিনের মধ্যেই তাদের অফার জানাতে বললেন।
অবশেষে তাদের মধ্যে একজন টেন্ডার পেলেন আর তাকে ২ দিনের মধ্যেই আড়াই লক্ষ ফ্রাংকের চেক নিয়ে একই হোটেল দেখা করতে বললেন।
আর সেদিনই মন্সুরিকে অনুমোদনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওতা হবে৷
খুশিতে আটখান হলেন মন্সুরি, তিনি পৃথিবীর এক বিখ্যাত স্তম্ভ ভেংগে দিবেন আর খ্যাতি অর্জন করবেন যা অনেক কিছু তার জন্যে।
চেক নিয়ে যাওয়ার সময়ে তার সন্দেহ হল, কেন মিটিং সবসময় হোটেলে , সরকারি কোন অফিসে নয় কেন?
এটি কি একটা প্রতারণা ? আর অন্য কোন অফিসিয়াল নেই কেন?
এদিকে লাস্টিগ তার সুর পাল্টালেন, তার জীবন, কম বেতন ইত্যাদির কথা বলতে লাগলেন।
আর কিছু টাকা ঘুষ চাইলেন, এতে মন্সুরি আবারও বিশ্বাস করলেন, তাকে কিছু এক্সট্রা টাকা গিফট করলেন, চেক দিয়ে চলে গেলেন।
কিছুই দিন সরকারের কাছে থেকে ফোন পাওয়ার আশায় বসে থেকে অবশেষে মুন্সিরি বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে, পরে খবর নিয়ে জানতে পারলেন যে, এরুপ কোন টেন্ডার সরকারের দপ্তরে নেই আর লাস্টিগ নামে কেউ এই মন্ত্রণালয়ে ও নেউ, অর্থাৎ তিনি পুরো টাকাই প্রতারণাই হারালেন৷
মুন্সিরি কিন্তু এব্যাপারটা কোন দিন ও পুলিশকে জানাননি , কেননা এতে তার আরও দুর্নাম হবে আর এটি হবে ব্যাবসায়ীক আত্নহত্যার সামিল।