এম.আর মাহমুদ


আমি সড়কটির একজন নাখান্দা যাত্রী। প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা ছাড়া কোন গতি আমার নেই। তবে আমি কেন? প্রতিদিন ৫টি ইউনিয়নের অর্ধ লক্ষাধিক যাত্রী এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করছে। সড়কটির নাম একাধিকবার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সড়কের কোন পরিবর্তন হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিকলঘাট হয়ে কাকারা মাঝের ফাঁড়ি পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল হামিদ সড়ক’। পরে এ সড়কটি নাম পরিবর্তন হয়েছে কেন আমার জানা নেই। তারপরও বলতে হয় হযরত শাহ ওমর (রা.) স্মৃতি বিজড়িত পূর্ণভূমি অবিভক্ত কাকারার সর্বস্তরের মানুষ এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে আসছে অনন্তকাল ধরে।

এ সড়কটি এক সময় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন মানোন্নীত হয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগের অধীনে গেছে। সড়কটির পরিধিও বেড়েছে। বরইতলী ইউনিয়নের শান্তি বাজার হয়ে কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা মাঝের ফাঁড়ি সংলগ্ন মাতামুহুরী নদী ব্রীজ পার হয়ে সুরাজপুরের বুকচিরে লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। সড়কটি এখন দীর্ঘ ১৯ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। এ গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি সংস্কারের জন্য কক্সবাজার সড়ক জনপদ বিভাগ ৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু করেছে ভাগ্যবান ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তবে গত ১০ মাসে তাদের কাজের পরিমাণ দেখলে মনে হয় কাঙ্খিত কাজ হয়নি। সড়কটির কাজ চলছে শামুক গতিতে। এক কথায় বলতে হয় ‘তৈলাক্ত বাঁশে যে গতিতে শামুক উঠে সে গতিতেই আবার নেমেও যাচ্ছে।’ বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে সামান্য অগ্রগতি দেখা গেলেও বর্ষায় দেখা যায় চিরচেনা সেই পুরনো অবস্থা। সড়কটির বর্তমান অবস্থা না দেখলে কেউ মন্তব্য করতে পারবে না।

তবে এককথায় বলতে হয় ‘এ যেন হুতুম পেঁচার মাথার দৃশ্য’। কাজ শুরুর পর শীত গেল, বর্ষা গেল, আবার শীত আসছে কোন পরিবর্তন নেই। হয়তো ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জবাব দেবে করোনার কারণে রাস্তার কাজ তেমন অগ্রসর হয়নি। এখন আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হতে যাচ্ছে বলে বিজ্ঞজনদের অভিমত। তখন কি বলে জানি না। এ সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী ৫ ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষের দূভোগ দেখার যেন কেউ নেই। জনপ্রতিনিধিদের দোষ দেব না। কারণ তাদের সু-নজর না থাকলে সড়কটির জন্য সওজ কর্তৃপক্ষ ৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে পুনঃ নির্মাণ কাজ শুরু করত না। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের চরম অবহেলা ও সড়ক জনপদ কর্তৃপক্ষের অর্থপূর্ণ উদারতায় যাত্রীদের অবস্থা ত্রাহী মধুসূদন। এ সড়ক দিয়ে সিএনজিতে করে যাওয়ার সময় সমুদ্রের সাইক্লোনের কথায় মনে পড়ে। যাত্রীরা প্রতিদিনই সাড়ে ৩২ ভাজা হচ্ছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রিয় শিল্পী সিরাজুল ইসলাম আজাদের ভাষায় যাত্রীদের বলতে হয় ‘অজম গর’।

ছাত্র জীবনে জাসদের একটি জনপ্রিয় শ্লোগান এখনও মনে পড়ে ‘আন্দোলন ধ্বংসের তাণ্ডব লীলা নয়, সৃষ্টির প্রসব বেদনা’ এ শ্লোগানের কথা মনে করে ৫ ইউনিয়নের মানুষ নীরবে হজম করছে। এ সড়ক দিয়ে শীর্ষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা নিয়মিত যাতায়াত করছে না বলে হয়তো ৫ ইউনিয়নের দুর্দশা তারা বুঝতে পারছে না। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মনে হয় প্রভাবশালী। না হয় সড়ক জনপদ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা পা ভাঙ্গা মুরগীর মত হয়ে বসে আছে কেন তা বোধগম্য হচ্ছে না। যাক! কপালের লিখন, করা যায় না খণ্ডন’ এ সড়কের ঠিকাদারের বিরুদ্ধে নিম্নমানের পণ্য সমাগ্রীসহ বালি ও মাঠির সাথে মিশ্রণ করে সড়কে দেয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ধারক দেয়াল নির্মাণে নিম্নমানের ইট ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে বেসামাল পাহাড় কেটে রাস্তা ভরাট করছে। বনবিভাগ বাঁধা দিয়েও রক্ষা করতে পারেনি তাদের বনভূমি। এই ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরও নিরব।

ক’দিন পরেই শুষ্ক মৌসুম শুরু হবে। তখন রাস্তার কাজে ব্যবহৃত ট্রাকের ধুলা-বালির কারণে ৫ ইউনিয়নের রাস্তা সংলগ্ন এলাকার লোকজন নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। হয়তো তখন পুনরায় স্মরণ করতে হবে কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার কথা। এ সময় হয়তো জনপ্রতিনিধিও সওজ কর্তৃপক্ষ নির্দিদায় বলবে ‘আমারও ছিল মনে, এ বেঠা জানিল কেমনে?’ এভাবে সড়কটি নিয়ে বছর খানেক আগে ‘গর্ভখালাস সড়কের আর্তনাদ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনলাইন ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন আশা করেছিলাম সড়কটির নির্মাণ কাজ দ্রুত চলবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আমি শুধুমাত্র এ সড়কটি নিয়ে লেখালেখি করা একটি যুক্তিই রয়েছে। আমি ওই এলাকার একজন নাগরিক। সৈয়দ মুজতবা আলীর লিখিত ‘প্রবাস বন্ধু’ প্রবন্ধে আফগান যুবক আবদুর রহমানের ভাষায় বলব ‘ইন হাস্তা ওয়াতানান’ এইতো আমার জন্মভূমি।