বিশেষ প্রতিবেদক:
কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে জোনে অবস্থিত আসাবিক হোটেল জামান সী হাইটস। এই হোটেলটি জমির মালিক ওয়াহিদুজ্জামান বাবু নামের এক ব্যক্তি। তিনি নিজেই এই হোটেল নির্মাণ করেন। নির্মাণ করার পর ২০১৬ সালের হোটেলটি পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া দেন শাহজাহান আনসারীকে। ওয়াহিদুজ্জামান বাবু সালামি নিয়েছিলো দুই কোটি ৫৬ লাখ টাকা। কিন্তু হোটেলটি পরিচালনার ছয় মাস পর ভাড়াটিয়া শাহজাহান আনসারী জানতে পারেন হোটেলটি ৬৪টি ফ্লাটের মধ্যে ছয়টি ছাড়া সব ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়ার আগেই বিভিন্নজনকে বিক্রি করে দিয়েছে বাবু। ভাড়ার দেয়ার বিষয়টি জানতে পেরে একে একে ফ্ল্যাট ক্রেতারা যোগাযোগ করতে শুরু করে ভাড়াটিয়া শাহজাহান আনসারীর সাথে। এ নিয়ে বড় ধরণের জটিলতা তৈরি হয়েছিলো। তবে তিন পক্ষ মধ্যস্থতায় এসে ভাড়াটিয়া শাহজাহান নিয়ন্ত্রণে হোটেল পরিচালিত হয়। কিন্তু শেষ দিকে এসে মেয়াদ শেষ না হতেই ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা সালামি ফেরত না দিয়েই ভাড়াটিয়া শাহজাহান আনসারীকে উচ্ছেদের অপচেষ্টা শুরু করে বাবু।

ভাড়াটিয়া শাহাজাহান আনসারীর ভাই কাশেম আনসারী জানান, বাবু শাহজাহান আনসারীর পূর্ব পরিচিত ছিলো। সে সুবাধে তার কথায় বিশ্বাস করে ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা সালামি দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য হোটেল জামান সী হাইটস ভাড়া নেন শাহজাহান। ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তিপত্রসহ সব ধরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নয় তলা বিশিষ্ট এই ভবনের কক্ষ সংখ্যা ৬৪টি। ভাড়া নেয়ার পর নিজের খরচে পুরো হোটেলের সাজ-সজ্জা করেন শাহজাহান আনসারী। হোটেল পরিচালনার সকল প্রক্রিয়ার শেষ হলে ৬ মাস পর ওই হোটেলের ক্রয় সংক্রান্ত মালিক দাবি করে ভাড়াটিয়া শাহজাহান আনসারীর সাথে একে একে যোগাযোগ শুরু করে বিভিন্ন ব্যক্তি। পরে বিভিন্নভাবে খোঁজ নিয়ে শাহজাহান আনসারী জানতে পারেন, ওয়াহিদুজ্জামান বাবু তাদের সাথে বড় ধরণের প্রতারণা করেছে। ভাড়া দেয়ার আগেই বাবু ৬৪টি ফ্ল্যাটের ৫৮টি বিক্রি করে দেন। এক পর্যায়ে ওই ফ্ল্যাট মালিক দাবিদার লোকজন নিজেরা ভাড়া দাবি করে এবং কয়েকজন এসে ফ্ল্যাট দখলের চেষ্টা চালায়। তবে ফ্ল্যাট মালিকদের সাথে বসে সমাধান করেন এবং হোটেলটি ভাড়াটিয়া শাহজাহান নিয়ন্ত্রণে রেখে পরিচালনা করতে থাকেন।

কাশেম আনসারী আরো জানান, হোটেলটি ভাড়া নিয়ে আমরা ‘খাল কেটে কুমির এনেছিলাম’। হোটেলটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অতীতের পুরোটা সময় আমাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন, হয়রানি করেছে বাবু। বিভিন্ন সময় এসে বহু লোকজন নিয়ে এসে কয়েকটি ফ্ল্যাটে উঠে পড়েন। থেকে যায় মাসের পর মাস। কিন্তু ভাড়া দেয় না। তারপরও আমরা সহ্য করে এসেছি। কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হয়নি বাবু। মেয়াদ শেষ না হওয়ার আগেই সালামির ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ফেরত নিয়ে হোটেলটি দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেন তিনি। এই জন্য আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী এবং পুলিশের তৎকালীণ বিভিন্ন দুর্নীতিবাজ স্তরের কর্মকর্তা। এক পর্যায়ে শুরু হয় প্রশাসনের নির্যাতন আর হয়রানি।

হোটেল জামান সী হাইটস এর স্বত্ব ঠেকাতে আদালতের আশ্রয় নিয়েছে শাহাজাহান আনসারীর পরিবার। তারা উচ্চ আদালতে রীট পিটিশন দায়ের করেছেন। একই আদালতেও একটি মামলা করেন। এই মামলায় আদালত শাহাজাহান আনসারীর ভাড়ামূলে দখলে থাকা হোটেল জামান সী হাইটস- এ কাউকে হস্তক্ষেপনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের নাম উল্লেখ করে আদালত এই আদেশ দেন।

কাশেম আনসারী বলেন, আদালতের নির্দেশ থাকার পরও জোরপূর্বক আমাদের উচ্ছেদ করতে ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও তৎকালীন পুলিশের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তাকে লেলিয়ে দেন বাবু। ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সময় এসে হোটেলের ফ্ল্যাট দখল করে নারী ও ইয়াবা সেবনসহ নানা অবৈধ কাজ চালায়। একইভাবে পুলিশের ওইসব কর্মকর্তারা বাবুর কাছ পক্ষ হয়ে এসে আমাদের নানাভাবে হয়রানি করেছেন। তার মধ্যে একবার সাদা পোশাকে একদল পুলিশ এসে ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে যায়। একই সময় দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করা আমাকে ধরতে চাইলে আমি চিৎকার দিই। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে অমানুষিক মারধর করে দুই তলা থেকে নিচে ফেলে দেয়। ফলে পায়ে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ এক বছর হাসপাতালে কাটিয়েছি। বর্তমানে আমি পঙ্গু জীবন যাপন করছি। আরেকবার সাদা পোশাকের একদল পুলিশ হোটেলে ঢুকে আমার ভাই আবু ছুফিয়ানকে আটক করে নিয়ে যায়। পরে তাকে সাজানোভাবে ইয়াবা ও অস্ত্র মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠায়। এই ঘটনার পরই বাবু নারীসহ ভাড়াটে লোকজন এনে ছয়টি ফ্ল্যাট দখল করে ফেলেছে। এখন পর্যন্ত সেগুলো দখলে রেখে দিয়েছে।

আমি পঙ্গু এবং ছোটভাই আবু সুফিয়ান জেলে থাকায় সর্বশেষ আমার ৮০ বছরে বৃদ্ধ পিতা, মা, শাহজাহান আনসারীর স্ত্রী ও শ্বাশুড়ি মিলে হোটেলটি পরিচালনা করে। কিন্তু বাবু দখলে ছয়টি ফ্ল্যাটে ইশরাত জাহান নামের এক নারীকে নির্যাতনের অভিযোগ করে আমার বৃদ্ধ পিতা, মা, শাহজাহান আনসারীর স্ত্রী ও শ্বাশুড়ি নির্যাতনের পর পর নারী নির্যাতন ও হামলার দুটি মিথ্যা দায়ের করিয়েছে। তবে রহস্যজনক বিষয় হচ্ছে দুটির মামলার মধ্যে ইশরাত জাহান নামের এক নারীকে একটিতে খালাতো বোন এবং একটিতে স্ত্রী উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবেই অমানুষিকভাবে আমাদের নির্যাতন করে যাচ্ছে ওয়াহিদুজ্জামান বাবু।

কাশেম আনসারী জানান, ওয়াহিদুজ্জামান বাবুর উদ্দেশ্য অত্যন্ত অসৎ এবং খারাপ। তিনি সালামির টাকা ফেরত না দিতে তিলে তিলে আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করার অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন। যার অংশ হিসেবে ব্যবসায়িক আলাপের কথা বলে শাহাজাহান আনসারীকে চট্টগ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে কৌশলে তাকে গুম করে এবং পরে ইয়াবা ব্যবসায়ির তকমা দিয়ে ক্রসফায়ারর দেয়ার জন্য সিনহা হত্যার মূল হোতা টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের হাতে তুলে দেন। কিন্তু হায়াত ছিলো বলে প্রাণে গেছে শাহাজান। তবে ক্রসফায়ার না নিতে ওসি প্রদীপকে ২৫ লাখের বেশি টাকা দিতে হয়েছে। এভাবে আমাদের ধারাবাহিকভাবে নানা ষড়যন্ত্র, হুমকি এবং হয়রানির করে যাচ্ছে বাবু। বর্তমানে হোটেলের ছয়টি ফ্ল্যাট দখল করে সেখানে নানা অপকর্ম চালাচ্ছে বাবু। কিছু বললে প্রকাশ্যে বন্দুক (লাইসেন্স করা) দিয়ে গুলি করে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

কাশেম আনসারীর পিতা নূর মোহাম্মদ আনসারী বলেন, ওয়াহিদুজ্জামান বাবুর সাথে লেনদেন করে আমার পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। সে আমাদের আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে শেষ করে দিয়েছে। বর্তমানে আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অতীতে পুলিশের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তার কারণে আমরা কোনো বিচার বা সুরাহা পায়নি। বর্তমানে কক্সবাজারে একজন সৎ ও মানবিক পুলিশ সুপার নিয়োজিত হয়েছে। আমরা তার কাছে বাবুর সীমাহীন নির্যাতনের বিচার চাই।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওয়াহিদুজ্জামান বাবু তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করেন। শাহজাহান আনসারীকে তিনি হোটেলটি ভাড়া নয়; পরিচালনা দায়িত্ব দিয়েছেন বলে দাবি করেন। একই সাথে শাহজাহান আনসারীর পরিবারকে হয়রানির বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন।