সিবিএন ডেস্ক:

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বান্দরবানের আঞ্চলিক গ্রুপগুলোর মধ্যে হানাহানি ও রক্তপাতের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও অপহরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে একের পর এক হত্যাকা‌ণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। গত তিন বছরে বান্দরবানের ২৫ জনকে হত্যা করেছে আঞ্চলিক গ্রুপগুলো। ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই জেলায় সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে।

জানা গেছে, গত ৭ জুলাই বান্দরবান সদর উপজেলার বাজবিলা ইউনিয়নের বাঘমারা বাজারের মারমাপাড়ায় প্রতিপক্ষের গুলিতে জেএসএস সংস্কার (এমএন লারমা) গ্রুপের ছয় জন নেতাকর্মী নিহত হন। আর এতে হঠাৎই অশান্ত হ‌য়ে ওঠে বান্দরবা‌নের পাহাড়। ছয় ব্যক্তিকে হত্যার পর এই এলাকা ছাড়াও বান্দরবানের স্থানীয়দের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

স্থানীয়‌দের ম‌তে, রাজবিলা ইউনিয়নটি দুর্গম ও রাঙামাটির রাজস্থলী সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় এমনিতেই সন্ত্রাসপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বে‌শিরভাগ চাঁদাবাজি-অপহরণ-সন্ত্রাসী তৎপরতা প্রায় সময়ই এসব এলাকায় সংঘটিত হয়ে থাকে। একসময় এই ইউনিয়নের বাঘমারা, জামছড়ি, নাসালংপাড়া, আন্তাহাপাড়া, ক্যনাইজুপাড়াসহ পুরো ইউনিয়নে জেএসএস সন্তু লারমা গ্রুপের একছত্র আধিপত্য থাকলেও গত এক বছর ধরে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে আরও কয়েকটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। গত বছর থেকে নতুন ক‌রে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে মগ লিবারেশন পার্টি নামে একটি গ্রুপ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জনসংহতি সমিতি, মগ লিবারেশন পার্টি ও জেএসএস সংস্কার এমএন লারমা গ্রুপের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের জেরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ কমপক্ষে নিহত হ‌য়ে‌ছে ২৫ জন।

অপহরণের পর সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত সাবেক পৌর কাউন্সিলর চথোয়াই মং মারমার স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামী উ‌জি হেডম্যানপাড়ার খামারবা‌ড়ি‌তে এ‌সে‌ছিল। বাড়ি‌তে ফেরার সময় তা‌কে একদল পাহাড়ি সন্ত্রাসী অ‌স্ত্রের মুখে তু‌লে নি‌য়ে যায়। প‌রে দু‌দিন পর পাহা‌ড়ের জঙ্গল থে‌কে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এখ‌ন পর্যন্ত তার হত্যাকারী‌দের কাউ‌কে ধর‌তে পা‌রে‌নি পুলিশ।’

সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত রোয়াংছড়িতে আওয়ামী লীগ কর্মী অংসিচিং মারমার স্ত্রী জানান, রা‌তের আঁধা‌রে হঠাৎ ক‌রে একদল পাহাড়ি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী আমার স্বামী‌কে এ‌সে গু‌লি ক‌রে। এ‌তে সে ঘটনাস্থ‌লেই নিহত হ‌য়ে‌ছে। এখ‌নও স্বামীর হত্যার বিচার পাই‌নি।

মানবা‌ধিকার কর্মী ও দুর্নী‌তি প্র‌তি‌রোধ ক‌মি‌টির বান্দরবান সভাপ‌তি অংচমং মারমা জানান, এতদিন বান্দরবা‌নের পাহা‌ড়ে জেএসএস সংস্কার (এমএন লারমা) গ্রুপের কিছু তৎপরতা থাকলেও বান্দরবান জেলায় তাদের কোনও কমিটি ছিল না। ত‌বে চল‌তি বছরের মার্চে নতুন কমিটি গঠন করে এই সংগঠনের সদস্যরা প্রথ‌মে বান্দরবান শহরে অবস্থান নিলেও পরে বাঘমারা বাজারে একটি অফিস নিয়ে সেখানে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এর পরপরই গু‌লি‌তে তা‌দের দ‌লের ছয় জন নিহত হয়।

তি‌নি ব‌লেন, ‘নিহত রতন তঞ্চঙ্গ্যা শান্তি চুক্তির আগে জেএসএস সন্তু লারমা গ্রুপের অন্যতম সদস্য হলেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দল ছেড়ে এতদিন স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। কিন্তু হঠাৎ গত বছর ‌জেএসএস সংস্কার (এমএন লারমা) গ্রুপে যোগ দিলে তাকে সংগঠনটির বান্দরবান সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়। সভাপ‌তি হওয়ার পর থেকে বান্দরবানে এমএন লারমা গ্রুপের কর্মকাণ্ড সংগঠিত হতে শুরু করে এবং বাঘমারা, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিসহ বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পায়।’

এ বিষ‌য়ে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক লক্ষীপদ দাশ ব‌লেন, ‘জেলার শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং সরকারে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত করতে হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি অপহরণ, গুম ও চাঁদাবাজিসহ নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে জেএসএস। এক বছরে বান্দরবানে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় অর্ধশতাধিক।’

এ বিষ‌য়ে বান্দরবান পুলিশ সুপার জেরিন আক্তার বলেন, ‘প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ মামলা নিয়েছে এবং কারা এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও দুর্গম এলাকায় বসবাসরত মানু‌ষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে উক্ত এলাকাগুলোতে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বান্দরবান জেলা পুলিশ।’

প্রশাস‌নিক সূ‌ত্রে জানা ‌গে‌ছে, গত ১৫ অ‌ক্টোবর বৃহস্প‌তিবার রোয়াংছ‌ড়ির নতুনপাড়ায় সা‌বেক মেম্বার‌ ছাউপ্রু (৫০) মারমা‌কে গু‌লি ক‌রে হত্যা ক‌রে‌ছে সন্ত্রাসীরা। ১ সে‌প্টেম্বর বান্দরবা‌নের বাঘমারায় গু‌লি‌তে নিহত হয় মংসিং উ মারমা। ৭ জুলাই বান্দরবান সদর উপজেলার বাজবিলা ইউনিয়নের বাঘমারা বাজারের মারমাপাড়ায় প্রতিপক্ষের গুলিতে জেএসএস সংস্কার (এমএন লারমা) গ্রুপের ছয় জন নেতাকর্মী নিহত হয়। ৬ জুলাই গুংগা জলি ত্রিপুরা ( ৪১) নামে এক যুবককে কুহাল‌ংয়ের ১নং এলাকা থে‌কে অপহরণের অ‌ভি‌যোগ ও‌ঠে‌। এছাড়া ২ জুলাই রুয়াল লুল থাং বম (৩০)-কে সদর ইউ‌নিয়‌নের হেব্রনপাড়া থে‌কে অপহরণ করা হয়। এখনও তা‌দের সন্ধান পাওয়া যায়‌নি। ২০২০ সালের ১৫ মে রুমা উপজেলার গালেগ্যা ইউনিয়নের দুই বোট চালককে অপহরণের পর গুম করা হয়েছে। ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি উপজেলার কানাইজোপাড়ায় সংস্কাপন্থী এমএন লারমা গ্রু‌পের সদস্যকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

এছাড়া ২০১৯ সা‌লের ২২ জুলাই দুপুর দেড়টার সময় বান্দরবান সদ‌রের শামুকঝি‌ড়ি এলাকায় গু‌লি ক‌রে রোয়াংছ‌ড়ি তারাছা ইউ‌নিয়ন আওয়ামী লী‌গের সভাপ‌তি মংমং থোয়াই মারমা‌কে হত্যা ক‌রা হয়। ২০১৯ সালের ২৫ জুন রোয়াংছড়িতে আওয়ামী লীগ কর্মী অংসিচিং মারমাকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর আ‌গে, ২২ মে রাতে চ‌থোয়াইমং মারমা‌কে বালাঘাটার চড়ুইপাড়া এলাকা থে‌কে অ‌স্ত্রের মু‌খে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা অপহরণের পর হত্যা ক‌রে। ৭ মে সন্ত্রাসীরা জনসংহতি সমিতির কর্মী বিনয় তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করে। অপহরণ করা হয় ফোলাধন তঞ্চঙ্গ্যা নামের অপর কর্মীকে। এখনও তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৯ মে সন্ত্রাসীরা জনসংহতি সমিতির সমর্থক জয় মনি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ১৯ মে বান্দরবানের রাজবিলায় আওয়ামী লীগের সমর্থক ক্য চিং থোয়াই মারমা (২৭)-কে অপহরণের পর গুলি করে হত্যা করা হয়।