আব্দুর রহিম , পঞ্চগড় থেকে:


পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার টুনিরহাট অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি খবরটি টক অব দ্যা টাউন হিসেবে ভেসে বেড়াচ্ছে গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে। বিষয়টি দেশের প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ হয়েছে। ঋণ জালিয়াতির তথ্য উদঘাটনে টানা তিন দিন সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহিতা, ভুক্তভোগি ও অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজন এবং ওই ব্যাংকের কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত নিয়েই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের লস্করপাড়া এলাকার নির্মাণ শ্রমিক আমিনার রহমান, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মাঠকর্মী তবিবরের বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে অভিযোগকারী আমিনারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন,‘‘আমি সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংক টুনিরহাট শাখায় গিয়ে জানতে পারি যে, ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর আলু ফলনের জন্য নাকি আমি ৬৭ হাজার টাকা কৃষি ঋণ নিয়েছি। আসলে আমি কোন ঋণ গ্রহণ করিনি এবং আমি কৃষকও নই, আমি মূলত একজন রাজমিস্ত্রি। ’’ তিনি আরো বলেন,’আমার চাচাতো ভাই শরিফুলের নামেও ৬৫ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে এই ঋণ জালিয়াতের সাথে তবিবর জড়িত নয় বলে আমার মনে হচ্ছে। কারণ, আমার চাচা আব্দুল তার একটি ঋণ আটকে আছে বলে আমাকে জানান। সেখানে আমার একটি স্বাক্ষর হলে তার ঋণ উত্তোলনে সহজ হবে বলেন আমি আমার চাচার কথামত স্বাক্ষর করি। এখন জানতে পারছি, ওই ঋণটা আমার নামেই হয়েছিল।

অগ্রণী ব্যাংক, টুনিরহাট শাখার মাঠকর্মী তবিবর রহমানের (৪০) বিরুদ্ধে পঞ্চগড় সদর থানায় এক লেখিত অভিযোগ এনেছে একই এলাকার রেজাউল ইসলাম। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ‘২০১৭ সালে আমি তবিবর রহমানের মাধ্যমে অগ্রণী ব্যাংক টুনিরহাট শাখা থেকে ৩৩ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করি এবং তা পরিশোধও করি। পরে আবারও ৪০ হাজার টাকা ঋণ নেই। এভাবেই ওই ব্যাংকের সাথে নিয়মিত ঋণ লেনদেন করে আসছি। সম্প্রতি আবারো ঋণ করতে গেলে তবিবর আমার নামে ৯০ হাজার টাকার ঋণ করিয়ে আমাকে মাত্র ৪০ হাজার টাকা দিয়েছে। বাকী টাকা আত্মসাধ করেছে। এবিষয়ে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ইব্রাহিম আলীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, কোন গ্রাহক যদি ঋণ থাকা অবস্থায় নতুন ঋণ গ্রহণ করতে চান তবে তার পূর্বের ঋণের সুদাসলে পরিশোধ করে গ্রহণ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে রেজাউলের আবেদনকৃত নতুন ঋণ যদি ৯০ হাজার টাকা হয়ে থাকে, তবে তার পূর্ব ঋণ শোধ করে যা পাবে, তাই তাকে দেওয়ার নিয়ম। অভিযোগকারী রেজাউল, মাঠকর্মী তবিবর রহমানের সাথে গত ৩ অক্টোবর গলেহা বাজারে ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়েও পড়ে। এক পর্যায়ে রেজাউল এর হাত থেকে তবিবরকে বাচাতে এসে তবিররের ছোট ভাই হাবিবুর রহমানের সাথে মারামারির মত ঘটনাও ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই জানিয়েছেন। সরেজমিনে উভয় পক্ষের সমর্থনকারী এবং নিরপেক্ষ জনমানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ‘ তবিবরের বাবা শমারু মোহাম্মদ পাঁচ বছর আগেও ভ্যান-রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। হঠাৎ করে ১২-১৩ লাখ টাকা মূল্যের বাড়ি করলো কিভাবে? জনমানুষের এমন চিন্তার সত্যতা যাচাই করতে যাওয়া হয়েছিলো ঘাটিয়াপাড়া গ্রামের অভিযুক্ত তবিবরের বাড়িতে, তবিবরকে পাওয়া যায়নি। তার আত্মীয় স্বজনেরা জানান, তবিবর রংপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার স্ত্রীর কর্মস্থলে গিয়েছেন। এসময় তার মা তমিজা বেগম বলেন, ‘তবিবরের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ হয় তবিবর উচ্চ রক্তচাপ জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে রংপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে’। এসময় সাংবাদিকরা তবিবরের মা তমিজা বেগমকে প্রশ্ন করেন, মাত্র কয়েক বছর আগেও রিক্সা-ভ্যানই ছিলো আপনাদের পরিবারের আয়ের উৎস। এত দ্রুত কিভাবে এত সুন্দর বাড়ি করলেন?

একথা শুনেই তমিজা বেগম ঘর থেকে বেশ কিছু নথিপত্র নিয়ে আসেন। যেগুলো বিভিন্ন ব্যাংক ও বেসরকারি সংস্থার ঋণ বহি। নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, অভিযুক্ত তবিবর, তার মা তমিজা বেগম, তার ভাই হাবিবুর রহমান, আরেক ভাই রিংকু, বাবা শমারু মোহাম্মদসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের ঋণের অংক ২০ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে তবিবর ২ লাখ ৫০ হাজার, তার বাবা শমারু মোহাম্মদ ২ লাখ ৭০ হাজার, ছোট ভাই হাবিবুর ৩ লাখ ৮৫ হাজার, রিংকু ২ লাখ ১০ হাজার, দুলু ৮৭ হাজার, তবিবরের ফুপাতো ভাই সাদ্দাম ১ লাখ ৮০ হাজার, হাবিবুরের স্ত্রী শিরিন ১ লাখ ৮০ হাজার, মা তমিজা ৮৫ হাজার, তবিবরের স্ত্রী রুবিনা (ঋণ গ্রহণের পরে যিনি মারা গেছেন) ২ লাখ ২০ হাজার, তার ফুপা মোবারক ৭৮ হাজার, এবং ফুপু ৭৩ হাজার টাকা।ঋনদাতা প্রতিষ্ঠান গুলো হলো- আরডিআরএস, গ্রামীণ ব্যাংক, গলেহা ঐক্য কল্যাণ সমিতি, আশা, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এবং অগ্রণী ব্যাংক। এই হিসেব দাঁড় করানোর পর তবিবরের মা তমিজাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনাদের এই বাড়িটি নির্মান করতে আনুমানিক কতটাকা ব্যয় হয়েছে? জবাবে তমিজা বলেন, ‘আনুমানিক না বাবা, গুণে গুণে ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।’ ব্যাংকের ঋণ দালালির সাথে জড়িত দফাদার পাড়ার মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তান, সিপাহি পাড়া গ্রামের সামছুজ্জামান এবং ফারুক হোসেন পলাতক থাকায় তাদের কোন বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে গলেহা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক, সিপাহী পাড়া গ্রামের হাসিবুল ইসলাম বলেন, ‘তবিবর অত্যন্ত ভদ্র এবং শান্ত মেজাজের ছেলে। তার বাবা দরিদ্র ছিলো এটা যেমন সত্য, তেমনি তবিবর ও তার পরিবার বর্তমানে প্রথম সারির কৃষক। প্রতিবছর টমেটো ফলনে ৫ ভাইয়ের আয় আসে প্রায় ১০-১২ লাখ টাকা । এছাড়া তবিবর ব্যাংকের পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থায় পার্টটাইম জব করে। তার স্ত্রী বেসরকারি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত। ভাই গুলোও বিভিন্ন পেশায় জড়িত। আয় রোজগার রয়েছে, তাদের বাড়ি সুন্দর হতেই পারে।’ তালমা রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ও তবিবরের পাশের গ্রামের মোজাম্মেল হক বলেন, ‘তবিবর মাই ডিয়ার ছেলে। তার ছোট ভাই এবং বাবার আচরণ সন্তেষজনক নয় বলে কোন ঘটনা যাতে রটনায় পরিণত না হয়। তা বিবেকবানদর দেখা উচিত। বর্তমান সমাজ অন্যের ভালো দেখতে চায়না বলে মনে হচ্ছে।’ সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য দেবেশ্বর রায়ের সাথে কথা হলে তিনি বলেন,‘ জানতাম, তবিবর ও তার পরিবার আক্সগুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে’। কিন্তু এত টাকা ঋণ করেছে তা তো জানতাম না।

এ বিষয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, পঞ্চগড় সদর থানার উপ-পরিদর্শক কাইয়ুম আলী বলেন, ৩ অক্টোবরের ঘটনা দেখিয়ে গত ২১ অক্টোবর একটি মামলা করেছে রেজাউল। তদন্ত চলছে যা সত্য তাই প্রতিষ্ঠা পাবে।