কাফি আনোয়ার


বার বার ডেট। ফের লেট। কথায় বলে লেট বেটার দেন নেভার। এবার আর লেট না, একেবারে তড়িগড়ি ডেট। এ যেন যস্মিন দেশে যদাচার। এটি সংস্কৃত প্রবচণ হলেও ধাতে- আদতে-সুরতে-মুরতে কিংবা খালসতে একদম সাচ্চা বাঙালিয়ানা। ইংরেজরা বলে When in Rome, do as Roman।
রাজনীতি! তাই বলে এই বাগাড়ম্বরতা কিংবা বাতুলতা বাদ যাবে কে?
মুই বড় নেতা, মোর কথাই তালগাছ। বাকীটা সব ফরমালেটি, রেওয়াজ। করে বলেই করতে হয়।
আজব যবর এক প্রহসন মঞ্চস্থ হলো। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঈদগাঁও কাউন্সিল পর্ব।
প্রহসন স্বল্পদৈর্ঘ্যের হলেও আয়োজন, সংযোজন,বিয়োজন, সেটিং, প্লট, ক্লাইমেক্স, এক্টিং, ডাইরেক্টিং আর নেপথ্যকুশীলবদের অনুপঙখ চরিত্র দৃশ্যায়ন সত্যি চমৎকার।
এটা ক্ষুব্ধ নেতাকর্মিদের প্রতিক্রিয়া।
পোড়খাওয়া, হামলাখাওয়া, মামলা খাওয়া কিংবা পুলিশের ঘাদানি পেদানি খাওয়া অস্থিচর্মসার দলঅন্তঃপ্রাণ সেই তৃণমূল নেতাকর্মীরা বেশ জোরে সোরে তালি বাজিয়ে আহলাদে প্রহ্লাদে আত্মপ্রসাদের ঢেকুর তুলেছে।।

ঘটা করে নয়,বেশ প্রস্তুতি আর এন্তেজাম করেই ঈদগাঁও বিএনপি বহুল কাংখিত, প্রতীক্ষিত কাউন্সিলের যবনিকাপাত হল।
প্রবঞ্চিত কর্মীদের মনে থেকে গেল অতৃপ্তির রেশ, বড়নেতাদের বড় বড়াইয়ের ঝাঁজ, আত্মপ্রবঞ্চনার খেদ, নেতাদের স্বার্থচেতনার নির্লজ্জ স্বার্থপরতার মিথষ্ক্রিয়া।
জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চরিত্রে বানের জলের মত বুর্জোয়া শ্রেণীচেতনার অনুপ্রবেশ এবং তাদের শেকড় পোক্তকরণের অসমপ্রক্রিয়া,ত্যাগী তৃণমূলের অবমূল্যায়ন, সাজানো ছকে গোছানো পথে অবিরত পরিভ্রমণ, সাংগঠনিক উপজেলাকেন্দ্রিক নেতাদের বৈমাত্রেয় আচরণ, পূর্ব-পশ্চিম দিকবিভাজন, স্ববাৎসল্যবৎ পছন্দিকরণ,স্বজনীকরণ, শরীয়তি কিংবা মারেফতী ভ্রাতৃত্বকরণ, কাউন্সিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সংকীর্ণ কূটকৌশল, নেতা স্বপুষ্টদের ছলেবলেকৌশলে জেতানোর জিদ্দি মনোবৈকল্যের ঘাম ঝরানো অনুশীলন দেখেছে কথিত বির্তকিত, বহুল আলোচিত ওই কাউন্সিল।

দলকে ঢেলে সাজানোর বদলে খাদে ফেলানোর ইতরামী, পাতানো কাউন্সিল কাউন্সিল খেলা তৃণমূলের সকল উৎসাহ উদ্দীপনায় বালি ঢেলেছে ।
আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার আক্ষরিক অঙ্গীকার, নীতি আদর্শ, সঠিক নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রাণান্ত আয়োজন একদিকে যেমন বুমেরাং হয়েছে অন্যদিকে তেমনি জাতীয়তাবাদী চেতনার অনুগামী দল ও দলের বাইরে উপজেলা বা জেলা কেন্দ্রিক বর্তমান নেতৃত্বের অসারতা জাতীয় নেতৃত্বের বিদ্যমান সমসাময়িকতার প্রতিধ্বনি বলে মনে করছেন অনেকে।

নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির বাতুল বাহানায় ঘুরে ফিরে একই পথে চক্রাবর্তন কিংবা সূদুরপ্রসারী চিন্তার বাক্যালংকার নীতি মূল্যবোধহীন স্বৈরচেতনার বালখিল্য স্ট্যান্টবাজি ছাড়া আর কি হতে পারে ? জনৈক প্রবাসী নেতার এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সত্যিই কঠিন।

এমনিতে বিএনপি রাজনীতি ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। তার উপর তৃণমূলের লেজেগোবরে দশায় দিবাস্বপ্নচারি কিংবা নিশিস্বপ্নচারি তথাকথিত রাজনৈতিক কিংবা বুর্জোয়া স্বার্থচেতনতার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তাবয়ন কিংবা কথায় কথায় জেলা কর্ণধারকে রেফার বা প্রেফার করে আপন স্বার্থহাসিল কিংবা তালগাছ আমারবৎ সিদ্ধান্ত চাপানোর মত স্বৈরমনা দলীয় কালচার প্রকারান্তরে এই ঘরানার রাজনীতির দেউলিয়ত্বকে পরিগ্রহ করেছে।

ঈদগাঁও ইউনিয়ন বিএনপি’র কাউন্সিল ও সম্মেলনের প্রাকপর্ব এবং উত্তরপর্ব তৃণমূলের ভঙ্গুর, সংকীর্ণ এবং স্বার্থদ্বান্দিক আবহ টোটাল জাতীয়তাবাদী বলয়ের হতাশা ও গন্তব্যহীন পথচলাকে প্রকট করে তুলেছে। তৃণমূলকর্মীদের হতাশার সুর আর স্থানীয় দায়িত্বশীল নেতাদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ও নির্লজ্জ নৈতিকস্খলন সর্বত্র হাসির খোরাক যুগিয়েছে।
পথে ঘাটে মাঠে তথাকথিত নেতার দু’আঙ্গুলের ভি চিহ্ন প্রদর্শন, মিষ্টিবিতরণ, খোশমেজাজের চটুল গল্প সেই হতাশা আর বিভক্তিতে নতুনমাত্রা এনেছে।

অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে যেকোন অনভিপ্রেত বা অনাকাংখিত ঘটনা বা দুর্ঘটনা দলের অন্তঃকোন্দলীয় বিভক্তি ও বৈপরীত্বকে সহজ ও সরলরেখায় স্পষ্ট তুলবে। বিশেষ ব্যক্তিত্ব সভাপতি নির্বাচনকেন্দ্রিক বিতর্ক ঘণীভুত ঘুর্ণাবত্য তৈরী করছে।

সাবেক সভাপতি আবদু সালাম এবং দলের নতুনমুখ প্রবাসীনেতা আবদুশ শুকুরকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দুটি আলাদা আলাদা বলয় পরষ্পরবিরোধি অবস্থান ও বিষোদগার দল এবং দলের বর্তমান ও ভবিষৎ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতৃত্বকে জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে।
বিএনপি নিজেদের তৈরী গঠনতন্ত্র বা গঠনতন্ত্রসিদ্ধ অঙ্গীকার, নীতি আদর্শ নিজেরাই মানেনা এমন একটি অভিযোগ বেশ পুরানো। সেই অভিযোগ ফের নতুন বির্তকের অবতারণা করছে।

ঈদগাঁও ইউনিয়ন বিএনপি’র কাউন্সিলে দলীয় গঠনতন্ত্রের শ্রাদ্ধ করে সাংগঠনিক উপজেলা ইউনিটের কর্তাদের মৌখিক সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনাই নতুন সংবিধান হয়ে উঠেছে। নয়তো কাউন্সিলর তালিকা তৈরীতে দলের গঠনতন্ত্রের নির্দেশনা উপেক্ষিত হল কীভাবে?
এই অভিযোগ তৃণমূলের শতশত নেতাকর্মির।

একজন বিশেষ নেতাকে জিতিয়ে আনতে যদি এত এত গোপনকাহিনী, তোতাকাহিনী, ভাবী ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সুবিধাভোগী কাহিনী, নব মঞ্জুরিত মুকুলকে অঙ্গুরেই বিনষ্ট করার ভীতবাসনা, পায়তাঁরা থাকে তবে দলে গণতন্ত্র চর্চার বা গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্র কোথায়?

পকেট থেকে পকেটে কিংবা বিকাশ থেকে রকেটেই যদি ইউনিয়ন কমিটির ভবিষৎ হয়ে থাকে তবে দল হিসেবে এই দলের ভবিষ্যৎ কোন গিরিখাদের কিনারে? কাউন্সিল কাউন্সিল বুলি উড়িয়ে, ভুঁয়া ধোঁয়া তুলে, ঢাক ঢোল বাজিয়ে, মেদমত্ত শ্বেত গজেন্দ্রগামিনীর উদগারে যদি ইউনিয়ন কমিটির প্রসব হয়ে থাকে আর তৃণমূল নেতাকর্মীরা যদি সেই প্রসবের যন্ত্রণায় কাতরতায় তবে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কারো সংশয় থাকার কথা নয়।

আওয়ামী রাজনীতির প্রেষণ আর হুতাশনে গত এক দশক ধরে বিএনপি আরব্যপুরাণের ফিনিক্স পাখির মত ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে বারবার নিজেকে
পুনর্জন্ম দিতে চাইলে হোচট খাচ্ছে অবিরত। ক্রমাগতভাবে খাদে পড়ে যাচ্ছে ।

ক্ষমতাসীন সরকারও ম্যাকায়াভেলী তত্ত্বে জাতীয়তাবাদী চেতনার এই দলটির বিচরণ, প্রজনন,সংশ্লেষণ, বিজারণ,কর্মসূচী, অংকুরোদগমণের পলিটিক্যাল স্পেস এমনভাবে সংকোচিত করে রেখেছে, নিজ ঘরে বাঘবন্ধি খেলার ফুরসৎও নেই।
গৃহকোণে কোণ ঠাঁসা হতে হতে দলের ভেতর গ্রীক পুরাণের একচক্ষুবিশিষ্ট দানব সাইক্লোপসের মত হিংস্র, স্বার্থান্ধ,বিবেকহীন,নব্য ধনতন্ত্র প্রজাতির দানবের জন্ম হয়েছে। কপালে একচোখবিশিষ্ট ওই সকল দানববধ করতে পারলে এই দলকে উত্তরণের পথ খুঁজতে অন্ধকারেই কাটাতে হবে হাজার বছর।