ইমাম খাইর#
পঞ্চাশোর্ধ বয়সী শফিউল আলম। স্ত্রী, পুত্রবধূসহ ৩ জন মিলে থাকে খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের সোনালী ভবনে। ফেলে আসা সমিতি পাড়ায় বসবাস করে পরিবারের আরো ৪ সদস্য। প্রথম দিকে ছেলের মজুরির টাকায় কোনমতে দু’মুঠো ভাত জুটতো। এখন তাও হচ্ছে না। ফ্ল্যাটে আসার পথে স্থানীয় বখাটেদের মারধর ও হুমকির কারণে মা, বাবা ও স্ত্রীর মুখ দেখা বন্ধ। সুরম্য আট্টালিকা পেলেও তাতে সুখ খোঁজে পাচ্ছে না বয়োবৃদ্ধ শফিউল আলম। পুরনো সেই ঝুপড়িঘরই তার সুখের ঠিকানা মনে করছেন তিনি। কারণ, সেখানে তাকে যন্ত্রণা পোহাতে হয় নি। মাঝেমধ্যে কাজকর্ম পেতেন। খরচের টাকা মিলতো। পরিবারের সব সদস্য সঙ্গে নিয়ে অন্তত ঘুমোতে পেরেছেন। এখন সম্পূর্ণ বিপরীত!
রবিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর বেলা, এসব কথা বলতে বলতে দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে যান জলবায়ু উদ্ভাস্তু শফিউল আলম।
বৃদ্ধের দুঃখভরা বর্ণনা শুনতে লোকজনের জটলা বেধে যায়। ঠিক এমন সময় সেখানে হাজির হন কামিনী ভবনের ৫০৪ নং ফ্ল্যাটের জহির মাঝি (৫৭)। তিনিও তুলে ধরেন দুঃখের কথা।
জহির মাঝি ভাষ্য, সমিতি পাড়ায় থাকতে কাজকর্ম করে পরিবার চালাতে পারতেন। এখন কোন কাজ নেই। পুরোটা বেকার। পরিবারের ৫ সদস্য নিয়ে খুবই কষ্টের দিন কাটাচ্ছেন। তার মতো খেটে খাওয়া ৬০০ পরিবারের মধ্যে অন্তত ৪০০ পরিবার কর্মহীন। অর্থাভাবে অনেকে উপোষ দিন কাটাচ্ছে। এভাবে তারা থাকতে চান না। কাজের তাগিদে ফিরে যেতে চান পুরনো ভিটেমাটিতে।
জহির মাঝির দুঃখ, খুরুশকুলের মানুষজন তাদের জুলুম নির্যাতন করছে। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় তারা আশ্রয়ণ প্রকল্পে এসেছেন। জীবনের নিরাপত্তা না পেলে তারা এখানে থাকতে চান না।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের সবাই পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাদের অধিকাংশ শুঁটকিশ্রমিক, জেলে, ভ্রাম্যমাণ শুঁটকি বিক্রেতা, রিকশা ও ভ্যানচালক, যাঁদের দিনে এনে দিনে খেতে হয়। তাদের অনেকের এখন কাজ নাই।
জলবায়ু উদ্ভাস্তুদের জন্য দেশে এই প্রথম খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবনের প্রতিটিতে আশ্রয় নেবে ৩২টি করে পরিবার। জেলে, শুঁটকিশ্রমিক, রিকশা, ভ্যানচালক, ভিক্ষুকসহ অনেকে এখন এ প্রকল্পের কল্যাণে ফ্ল্যাটের মালিক। উপকূলের ঝুপড়িঘর থেকে তাঁরা ফ্ল্যাটবাড়িতে গিয়ে কী করছেন? পথের মানুষগুলোর দিনকাল এখন কেমন কাটছে, জানার কৌতূহল অনেকের। সরেজমিনে কথা হয় ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত এসব দরিদ্র মানুষের সঙ্গে।
কক্সবাজার পৌরসভার এক সময়ের কমিউনিটি ট্রাফিক পুলিশ নুরুল হক (৪০)। ১ নং ওয়ার্ডের ফদনার ডেইল এলাকায় মুদির দোকান করতো। নুরুল হকের দোকান ‘বুড়ির দোকান’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ভালোই চলছিল সংসার।
গত ২৩ জুলাই স্বপ্নের ফ্ল্যাটের চাবি বুঝে নেন নুরুল হক। কুড়েঘর থেকে ওঠেন দৃষ্টিনন্দন দালানে। কিন্তু সুখ মিলছে না। চার দেয়ালে শূন্য হাতে সময় গুনছেন। কর্মচঞ্চল নুরুল হক বলতে গেলে এখন বেকার। তবু কোন মতে বেঁচে থাকার তাগিদে ভবনের নীচে উন্মুক্ত জায়গায় চাল, ডাল, আলু, তেল ইত্যাদি বিক্রি করে দু’চার পয়সা আয় করে সংসার চালাচ্ছেন। তাও অনিশ্চিত। স্থায়ী দোকান ছাড়া পরিবারের বিরাট ঘানি টানা সম্ভব নয়।
৫ সন্তানসহ ৭ জনের সংসার এখন নীলাম্বরী ভবনের ৩০৩ নং ফ্ল্যাটে। সরকারিভাবে থাকার জায়গা পেলেও কর্ম পান নি নুরুল হক।
তার পাশে চিপস, বিস্কিট, চানাচুর ইত্যাদি নাস্তা সামগ্রী বিক্রি করছেন মুহাম্মদ কালু (৫০)। নীলাম্বরীর ২০৩ নং ফ্ল্যাটে পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে থাকেন। হাজার-দেড়েক টাকা বিক্রি করতে পারলে দুই-তিনশত টাকা লাভ। এসবে নুন পানির সংসার কালুর। কিন্তু এভাবে তো জীবন চলে না। স্থায়ী জীবিকার পথ সৃষ্টি আবেদন কালুর মতো অসংখ্য পরিবারের অসহায় কর্তাদের।
এদিকে, জলবায়ু উদ্ভাস্তুদের অভাব অভিযোগের কথা শুনতে রবিবার (১৮ অক্টোবর) আশ্রয়ণ প্রকল্পে ছুটে যান কক্সবাজার পৌরসভার সংরক্ষিত ওয়ার্ডের (১,২,৩) কাউন্সিলর কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র শাহেনা আকতার পাখি।
এ সময় তার সঙ্গে দেখা প্রতিবেদকের। জানতে চাইলে শাহেনা আকতার পাখি কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন)কে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের প্রায় সকলেই কর্মজীবি ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে সুন্দর ফ্ল্যাট পেলেও তারা এখানে বেকার। কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প গড়ে না তুললে জলবায়ু উদ্ভাস্তুদের জীবন ধারণ ও বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কাউন্সিলর পাখি।
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় আনা পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্প এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিনোদনের পার্ক ইত্যাদি।
উপকারভোগীদের অধিকাংশের পেশা ট্রলার নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণ এবং উপকূলে বিভিন্ন মহালে কাঁচা মাছকে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন। প্রকল্পে আশ্রয় পাওয়া এসব মৎস্যজীবীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং শুঁটকি উৎপাদনের জন্য প্রকল্প এলাকায় তৈরি হবে আধুনিক শুঁটকিপল্লি।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উদ্ভাস্তু হওয়া মানুষগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রী গড়ে তুলেন খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার উত্তরে বাঁকখালী তীর ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে ২০টি দৃষ্টিনন্দন ভবন।
গত ২৩ জুলাই গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম ধাপে তৈরি ২০টি ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাতে স্তান হয়েছে ৬০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার।
আশ্রয়ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশন। এখানে নির্মাণাধীন ১৩৭টি পাঁচতলা ভবনের প্রতিটিতে ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ইউনিট (ফ্ল্যাট) থাকছে। সেখানে আশ্রয় নেবে ৩২টি করে পরিবার।
এ প্রকল্পে ১০ তলার আরেকটি দৃষ্টিনন্দন ভবন হচ্ছে। ভবনটির নামকরণ হয়েছে ‘শেখ হাসিনা টাওয়ার’।
খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য বাঁকখালী নদীর ওপর তৈরি হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৯৫ মিটার দীর্ঘ সেতু ও সংযোগ সড়ক।